Cvoice24.com

সেন্ট মার্টিনের জলপথে গাঙচিলের নৃত্য

মুহাম্মদ আব্দুল আলী, সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে

প্রকাশিত: ১৮:৫২, ২১ মার্চ ২০২১

 

বসে আছি জাহাজ ছাড়ার অপেক্ষায়। গাঙচিল উড়ছে চারপাশে। যদিও প্রথম দিকে গাঙচিলগুলো স্বাভাবিকভাবেই উড়ছে ভেবেছি, পরে বুঝলাম এরা জাহাজ যাত্রীদের ছুঁড়ে ফেলা চিপ্স, বিস্কুটের লোভে ডানা ঝাপটাচ্ছে মাঝ সাগরে! জাহাজের চারদিকে উড়ছে নিয়মিত বিরতি দিয়ে। যাত্রীরাও ছুঁড়ে মারছে চিপ্স, বিস্কুট আর দেখছে গাঙচিলের কাণ্ড। দুই পক্ষের এক পক্ষ বিনোদন নিচ্ছে আর অন্য পক্ষ ক্ষুধার তাড়নায় ডানা ঝাপটিয়ে অবিশ্রান্ত উড়ছে।

যাত্রীদের মধ্যে যারা প্রেমিক-প্রেমিকার জুটি, প্রেমিকাকে প্রেমিক আর প্রেমিক প্রেমিকাকে চিপ্স, বিস্কুট কিনে দিচ্ছে। যদিও চড়া দাম নিচ্ছে এসবের, তবুও যে বিনোদন বলে কথা। বিনোদনের কাছে চড়া দাম কিছুই না। কখনো নিজে আবার কখনো দুইজনের হাত জুটি করে ছুঁড়ছে গাঙচিলের উদ্দেশে। ক্ষণে ক্ষণে বাঁধভাঙা হাসিতে মেতে ওঠছে। কি না সুন্দর সেই দৃশ্য। এ দৃশ্য দেখে রোমান্টিক হয় না এমন মানুষ বিরল। আমারও ইচ্ছে জাগে, কিন্তু সময় তো সুযোগ দিচ্ছে না এই খেলায় মেতে উঠতে। কেউ যেন লিখেছেন—

‘নীলাকাশ ছুঁয়ে যায় বিষণ্ণ গাঙচিল।
একদিন ভেবেছিল-হয়তো
দিগন্তের বিষণ্ণ মেঘেই
ডানা মেলে আঁধার ছুঁয়ে যাবে!’

যাত্রীদের মধ্যে কি যে আনন্দ উল্লাস, অন্যদিকে গাঙচিলের অবিশ্রান্ত উড়াউড়ি—যেন ক্লান্তি নেই। প্রায় দেড়-দুই ঘণ্টা অবিরত উড়াউড়ি। এবার বোধয় কেউ কেউ ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, নাফ নদীর বুকে ঢলে পড়ছে আর ঢেউনৃত্যে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। একে একে কমে যাচ্ছে গাঙচিলের সংখ্যা। যত্রীদেরও এই বিনোদন তৃপ্তি কমে যাচ্ছে ক্রমশ। ঘণ্টা দেড়েক আগে যে দৃশ্যে সতেজতা ছিল তা যে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।

নাফের শেষ প্রান্তে সাগরে প্রবেশ করছে জাহাজ। ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে তীরদৃশ্য। সাগরের এই কেমন বাতাস, প্রচণ্ড বাতাস। গাঙচিল নেই, এবার সেই জাগায় রাজত্ব করছে ছোট ছোট গাঙচিলের ঝাঁক। সাগরে প্রবেশের সাথে সাথেই যেন জাহাজের বডি লেঙ্গুয়েজ পরিবর্তন হয়ে গেলো। মৌজাগুলো যেন সেই বডি লেঙ্গুয়েজের শব্দমালা। সামান্য দুলছে জাহাজ। এবার বাংলাদেশ স্থলভাগ অদৃশ্য হয়ে গেলো, দেখে দেখে অসহায়ত্ববোধ করছি, অপর প্রান্তে মিয়ানমারের স্থলভাগও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আনন্দ-ভয় দুটোই কাজ করছে মনে।

সাগরের বুক ছেদ করেই চলছে জাহাজ। ঘণ্টা খানেক পর এবার সেই ছোট গাঙচিল পাখিও গায়েব হয়ে গেলো। এবার সাগরে ঢেউয়ের আকার বড় হওয়ায় ভীষণ দুলছে জাহাজ। ক্যাপ্টেন সাইরেন্স বাজিয়ে সংকেত দিচ্ছেন যাত্রীদের, যাতে সবাই বসে যায়। নতুন অনুভূতির মধ্যে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। সমুদ্র কি তাহলে উত্তাল হয়ে উঠলো! তীব্র হাওয়ায় উড়ছে চুল। এই যেন প্রচণ্ড রোদের মাঝেও নীলা সাগরের ঠাণ্ড হাওয়া। সাগরের রাগ-বিরাগের সাথে যেন যুদ্ধ করে চলছি, এগোচ্ছি লক্ষ্যস্থল সেন্টমার্টিনের দিকে। সাগরের ঢেউ আজ আমাকে দুলিয়েছে। চরম। সাগরের কাছে কি জানতে চাইবো!কিইবা জানার আছে! সেই অনেক কথা, জানার।

এবার সুদূরে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট আকারের কোস্ট গার্ডের জাহাজ। ধবল কুয়াশায় মতো ঝাপসা দেখাচ্ছে, ঠিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। দূরবীন দিয়ে দেখার শখ, কিন্তু পূর্ব প্রস্তুতির অভাব, তাই সম্ভব না। খালি চোখে দেখার চেষ্ট করছি। যাত্রীদের মাঝে এবার অন্যরকম আনন্দ উল্লাস দেখা গেছে। যারা এর আগে গিয়েছিলেন এই প্রবাল দ্বীপে, তারা যেন সব জান্তা। কতো না কিছু গাইডলাইন দিচ্ছে। কিন্তু এই কে শুনে সেসব বয়ান! যারা এই প্রথম আসছে তাদের মধ্যে এক ধরনের উৎসাহ উদ্দীপনা বিরাজ করছে। তারা জেটিতে পৌঁছার আগেই দূর থেকে খালি চোখে দর্শন করে নিচ্ছে। অবশেষে পৌঁছলাম ঐতিহাসিক এই প্রবাল দ্বীপে। কি না আনন্দ, উল্লাস!

সেন্ট মার্টিনের গল্প পরেই বলি, অন্য এক গল্পে। পরদিন ফের রওনা হলাম তিনটার জাহাজে, সেই একই জাহাজে। সাগরের বুক ছিঁড়ে নাফের মোহনায় পৌঁছে জাহাজ তখন সূর্য লালিচা বর্ণ ধারণ করেছে।

ভোরের টুকটুকে যে লাল টিপ নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের কপালে দেখা গেছে আজ সন্ধ্যায় বাংলাদেশের টেকনাফের কপালেই তারে দেখছি। এই সন্ধ্যায় গাঙচিলের উড়াউড়িই ছিল পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। অপলক তাকিয়ে থাকা, তাদের সাথে খেলা করা, খাবারের লোভ দেখানো এই অন্যরকম বিনোদন। গোধূলী বেলার পূর্ব হলুদ এবার সূর্য লাল হয়ে আসছে। গাঙচিলেরা ডানা ঝাপটায়, যাত্রীরা তাদের খেলায় মেতে ওঠে। এই গাঙচিলের বিনোদনের আনন্দ কাউকে ঘুমাতে দেয় না। সূর্য তার অস্তিত্ব হারায় দূর বহু দূরের ধোঁয়াশা পাহাড়ের আড়ালে।

জাহাজের সম্মুখ পানের মৌজার ভায়াবহ দৃশ্যে ভয় পেলেও লোভ সামলাতে পারিনি। গিয়ে সহযাত্রীদের সাথে দাঁড়িয়েছি। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে ফেলি ভয়ে। প্রচণ্ড বাতাস। এই বাতাসে ফুরফুরে মেজাজে কপি খেতে ইচ্ছে করলো, ভেতর গিয়ে চড়া দামে কপি নিলাম। শখের বশে দমও বশ মানে। মনে হলো যেন প্রেমিকা তার প্রেমিককে প্রথম চুমুতে যে ভয়-সুখের নির্যাস গ্রহণ করে ঠিক এই ঢেউয়ের ভয় কাটিয়ে সুখ পেয়েছি আমি। ইতি টেনেছে গাঙচিলের খেলা, ডানা ঝাপটায় না আর। তারা ফিরে গেলো নিড়ে নিড়ে, আমরাও ফিরি বাড়ি উদ্দেশে। সন্ধ্যার আঁধার এসে ঘিরে ধরলো চারদিক। মিটিমিটি আলো জ্বলছে নাফ নদীর পাড়ে পাড়ে।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়