Cvoice24.com


করোনার বিষে মেলাহীন চট্টগ্রাম 

প্রকাশিত: ১৪:৪৯, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০
করোনার বিষে মেলাহীন চট্টগ্রাম 

ছবি: সংগৃহীত

বছরজুড়ে হরেক রকমের ঐতিহ্যবাহী মেলা ও সাংস্কৃতিক উৎসবে মুখর হয়ে থাকতো এ চট্টগ্রাম। তবে চলতি বছরে সকল ঐতিহ্যকে গ্রাস করেছে করোনাভাইরাস। বিশ্ব মহামারী এ করোনাভাইরাস পৃথিবীর সকল দেশের মতো বাংলাদেশেও বিরাজমান রয়েছে। যার ফলে বছরব্যাপী স্থগিত করা হয়েছে সকল জনসমাগম, মেলা সহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হলো ‘মেলা’। বহুকাল থেকে নানা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। ‘মেলা’ শব্দটি শুনলেই মানুষের মনে অন্যরকম সুখানুভূতি হয়। এ শব্দে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য, সামাজিক, ধর্মীয়, বাণিজ্যিক সহ বিভিন্ন আশা আকাঙ্খা। তেমনি থাকে স্বাদ আহ্লাদের বিষয়ও।

মেলাকে কেন্দ্র করে এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। একসময় গ্রামীণ সমাজ জীবনের পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মেলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আশপাশের অনেক পরিচিত মানুষদের দেখা মিলতো ‘মেলায়’। সামাজিক সম্প্রীতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই পারস্পরিক যোগাযোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। এছাড়া মেলার অর্থনৈতিক গুরুত্ব তো রয়েছেই।

সাগর, নদী, পাহাড় ঘেরা নগরীর পথে-প্রান্তরে প্রাচীন যুগ থেকে হয়ে আসছে এমন সব মেলার আয়োজন। আবার কখনও বট-পাকুড়ের ছায়ায়, নদীর পাড়ে, হয়তো মন্দিরে বা তীর্থস্থানে, না হয় সাধু-সন্যাসী, পীর-ফকিরদের আস্তানায় এবং গ্রামের খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এসকল মেলা।
 
গ্রামীণ মেলার মূল বেচাকেনার জিনিস হলো স্থানীয় কারুশিল্পীদের উৎপাদিত পণ্য এবং কৃষিপণ্য। যেমন- পাট, বাঁশ, বেত, চামড়া হরেক রকমের কারুপণ্য ও বাচ্চাদের খেলনার বিপুল সমাবেশ গ্রামীণ মেলাকে বর্ণাঢ্য করে তোলে। এর পাশাপাশি মেলায় খাদ্রসামগ্রীর আয়োজন হিসেবে থাকে খাজা, গজা, মওয়া সহ নানা রকমের জিনিস। এছাড়াও থাকে নাগরদোলা, পুতুলনাচ, সার্কাস সহ হরেক রকমের আয়োজন। 

যেমনটা দেখা যায় ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলিখেলায়। চট্টগ্রামের মানুষ অপেক্ষমান থাকে ১২ বৈশাখের। যেদিন থেকে শুরু হয় জব্বারের এ বলিখেলা। লালদিঘী ময়দানকে কেন্দ্র করে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অনুষ্ঠিত হয় এ মেলা। বছর ঘুরে এলেই শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধের মনেও লাগে এ আনন্দের ছোয়া। যুগ যুগ ধরে এ মেলা উপলক্ষে চট্টগ্রামের শিশু কিশোরদের মাটির তৈরি ব্যাংকে টাকা জমানোর মত একটি সংস্কৃতিও রয়েছে। বছরজুড়ে জমানো টাকা দিয়ে শখের জিনিসপত্র কিনে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা। পুরো বছরের ঘর গেরস্থালির তৈজসপত্র কিনতে যায় ঘরনির দল। তাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্রেরও যোগান দেয় এ মেলা। পুরো নগরজুড়ে সৃষ্টি হয় এক উৎসবমুখর পরিবেশ। কারো হাতে বাঁশি, কেউবা কিনে ফুল। কেউ যায় নাগরদোলা চড়তে, কেউ বা মাটির জিনিস কিনতে।

গ্রামীণ মৃৎশিল্প ও কারুপণ্যের বিকিকিনি মেলার অন্যতম আকর্ষণ। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা মৃৎশিল্পের দোকান থেকে কিনে নেয় তাদের শখের হাঁড়ি, মাটির পুতুল, হাতি, ঘোড়া সহ নানা ধরণের খেলনা। এক শ্রেণির মানুষের উপচে পড়া ভিড় জমে মেলার খাবার কিনতে। আবার কেউ ব্যস্ত জমানো টাকা দিয়ে পরবর্তী বছরের জন্য মাটির ব্যাংক কিনতে। চলতি বছরে এমন এক সংস্কৃতিকে দংশন করেছে মাহামারি করোনাভাইরাস।

এদিকে গত ৫ মার্চ বাণিজ্য মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হলেও করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে এ মেলার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। এ মেলার পাশাপাশি চলতি বছরের সকল মেলার আয়োজনও স্থগিত করার নির্দেশ দেন জেলা প্রশাসন। এছাড়াও সংক্রমণ ঠেকাতে আয়োজন করা হয়নি স্বাধীনতা মেলাও। বাংলার সংস্কৃতি, বাঙালির আবেগ ও উৎসব, পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ পালনে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল। যার ফলে বৈশাখী মেলার আয়োজনও ছিল বন্ধ।

চট্টগ্রামের প্রাচীন ঐতিহ্য জব্বারের বলিখেলাও হয়নি চলতি বছরে। শুধু লোকজ মেলা নয় বিভিন্ন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত শহরাঞ্চলের মেলাও হয়নি। মোবাইল মেলা, কম্পিউটার মেলা, আইটি মেলা, আবাসন মেলাও অনুষ্ঠিত হয়নি। অন্যদিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত হয়নি বিজ্ঞান মেলা, শিল্প মেলা, কৃষি মেলা, স্বাধীনতা মেলার আয়োজনও। শুধু ঐতিহ্যবাহী মেলা নয় এ করোনা ভাইরাসের প্রকোপে বিজয় মেলাও স্থগিত হয়।

এ সকল মেলা অনুষ্ঠিত না হয়ে অনেক পেশার মানুষের যেমন কর্মসংস্থান নষ্ট হয়েছে। তেমনই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে মেলা কেন্দ্রীক ব্যবসায়ীদের। এ মেলাগুলোকে কেন্দ্র করে চারু, কারু ও অন্যান্য কুটির শিল্পীরা দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রস্তুতি নেয়। তৈরি করে বিভিন্ন ধরণের প্রয়োজনীয় ও সাজসজ্জার সামগ্রী। তাছাড়া কামার, কুমার থেকে শুরু করে বাঁশ-বেতের শিল্পী, লোকশিল্পজাত পণ্য, হস্তশিল্পজাত শিল্পীরা নিপুণ হাতে তৈরি করে বিভিন্ন সামগ্রী। যা করোনার কারণে রয়ে গেছে তাদের বাড়ির আঙ্গিনায়।

-সিভয়েস/আরএস/এমএম

সিভয়েস প্রতিবেদক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়