বান্দরবানে একাডেমিক ভবন নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ
ক্যমুই অং মারমা, বান্দরবান
বান্দরবান সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজে নতুন ৭ তলা বিশিষ্ট একাডেমিক কাম ওয়ার্কশপ ভবন নির্মাণকাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে। নিম্নমানের সামগ্রী ও নির্মাণ কাজেও করা হয়েছে অনিয়ম। এলাকাবাসীর অভিযোগ, নিয়ম অনুযায়ী নির্মাণাধীন প্রকল্পের এরিয়ায় কাজের বিবরণসহ তথ্যসম্বলিত সাইনবোর্ড টানানোর কথা থাকলেও তা মানা হযনি। ফলে এই কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নির্মাণাধীন ভবনের সামনে স্তূপ করে রাখা হয়েছে বিভিন্ন মানের ইট ও নিম্নমানের ইটের খোয়া। দোতলা ও তিনতলায় চলছে দেয়ালের গাথুঁনির কাজ। যেখানে ব্যবহার করা হয়েছে দুই ও তিন নম্বর ইট। ভবনের মূল স্থাপনার পিলারের ঢালাই চলছে স্থানীয় বালু দিয়ে। নির্মাণকাজে দেখভালের দায়িত্বে থাকা আরমান নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার নিয়ে প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করে বললেন, আপনারা ঠিকাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাউকেই পাওয়া যায়নি সেখানে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ অর্থবছরে ১০ কোটি ১০ লাখ ৪৭ হাজার টাকায় বান্দরবান সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজে ৭ তলা বিশিষ্ট একাডেমিক কাম ওয়ার্কশপ ভবন নির্মাণের জন্য টেন্ডার আহ্বান করে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর বান্দরবান। টেন্ডারে ভবনটির নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পায় চট্টগ্রামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আইডিয়াল নিয়াজ হাসনাত জেবি। পরবর্তীতে ওই প্রতিষ্ঠানকে একই বছরের ৩১ আগস্ট প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য কার্যাদেশ দেয়া হয়। যা ২০২৩ অর্থ বছরের ৩১ ফেব্রুয়ারি শেষ হবার কথা।
স্থানীয়রা জানায়, ভবনটি নির্মাণের সময় কিছুদিন প্রকৌশলীদের আনাগোনা থাকলেও বেশির ভাগ সময় তাদের অনুপস্থিতিতে ঠিকাদার তার নিয়মে কাজ চালিয়ে গেছেন। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন মাঝেমধ্যে সেখানে গেলেও বেশির ভাগ সময় দোকানেই বসে থাকেন। ফলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তাদের ইচ্ছে মত কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে।
আনোয়ার হোসেন নামে এলাকার এক বাসিন্দা জানান, নিয়ম অনুযায়ী নির্মাণাধীন প্রকল্পের এরিয়ায় কাজের বিবরণসহ তথ্য সম্বলিত সাইনবোর্ড টানানোর কথা থাকার কথা। কিন্তু এখানে কোন সাইনবোর্ড আমরা দেখছি না। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এ ভবন নির্মাণে অনিয়ম করার উদ্দেশ্যে তথ্যসম্বলিত সাইনবোর্ড টানাচ্ছে না।
সালাউদ্দিন নামে আরেক বাসিন্দা জানান, নির্মাণাধীন ভবনের প্রয়োজনীয় তদারকি না থাকায় সিডিউল অনুযায়ী কাজ হয়নি। ভবন নির্মাণের শুরু থেকে বিভিন্ন কাজে অনিয়ম করেছে তারা। মূল স্থাপনার পিলার, গ্রেডবিম ঢালাইয়ের সময় এক ব্যাগ সিমেন্টে তিন বস্তা কংকর ও দেড় বস্তা বালু দেয়ার নিয়ম থাকলেও দেয়া হয়েছে দুই থেকে আড়াই বস্তা বালু। এছাড়াও ৫০ শতাংশ সিলেট বালু (এফএম ২.৫)‘র সাথে ৫০ শতাংশ স্থানীয় বালু সংমিশ্রণে ঢালাই দেয়ার কথা। কিন্তু ৭০ শতাংশ স্থানীয় বালু দিয়ে শুধুমাত্র ৩০ শতাংশ সিলেটের বালু ব্যবহার করা হয়েছে। এতে ভবনের টেকসই নিয়ে সন্দেহ আছে বলে জানান তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নির্মাণাধীন ভবনে নিয়োজিত এক শ্রমিক জানান, ভবনের গাঁথুনীর জন্য যে ইট আনা হয়েছে তারমধ্যে বেশির ভাগই দুই ও তিন নম্বর ইট। এরমধ্যে এক নম্বর ইটগুলো লোক দেখানোর জন্য ভবনের সামনে স্তূপ করে রাখা হয়েছে এবং দুই ও তিন নম্বর দিয়ে গাঁথুনীর কাজ করা হচ্ছে। পিলার ও গাঁথুনীর কিউরিংয়ের জন্য যে পরিমাণ পানি দেয়ার কথা তা শতকরা ৩০ শতাংশও পানি দেয়া হয়নি।
এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ, ঠিকাদারের লোকজনের সাথে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দায়সারাভাবে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ভবনের কাজ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তদন্তের দাবি জানান তারা।
অন্যদিকে ধীরগতিতে চলছে এ ভবনের নির্মাণের কাজ। দেড় বছর মেয়াদের কাজ তিন বছরেও শেষ না হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে নানা কার্যক্রম, ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আইডিয়াল নিয়াজ হাসনাত জেবি‘র স্বত্বাধিকারী আবুল হাসনাতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মুঠোফোনে তিনি বলেন, বান্দরবানের ইটভাটার মালিকরা এক নম্বর ইটের টাকা নিয়ে নিম্নমানের ইট সরবরাহ করেছে। পরে প্রকৌশলীদের উপস্থিতিতে বাছাই করে ভালমানের ইট ব্যবহার করা হয়েছে এবং এখন বান্দরবানের বাইরে থেকে ভালোমানের ইট এনে কাজ করা হচ্ছে।
পিলার ঢালাইয়ের কাজে সিলেটের বালু ব্যবহার করার কথা, কিন্তু ওই বালু কেন ব্যবহার করছেন না এমন প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যান তিনি। পিলার ও গাঁথুনীর পরবর্তীতে কিউরিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত পানি দেয়ার কথা, কিন্তু কেন দেয়া হচ্ছে না প্রশ্নে তিনি বলেন, নির্মাণ কাজ দেখভালের জন্য যে লোক রেখেছিলাম সে নিয়মিত পানি দিত না। তাই তাকে ছাটাই করে দেয়া হয়েছে এবং নতুন লোক কাল-পরশুর মধ্যে যোগদান করলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে বলে জানান তিনি।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের বান্দরবানের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বলেন, নানা সমস্যার কারণে কাজে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তদন্তে যাব, যদি নির্মাণ কাজের গুণগতমান ঠিক না থাকে এবং নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে থাকে তা ভেঙে ফেলা হবে।