Cvoice24.com

এমপির বিরুদ্ধে মন্তব্য করে জেলে আ.লীগ নেতা, মামলার প্রক্রিয়ায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৭:০৭, ২৭ জুন ২০২২
এমপির বিরুদ্ধে মন্তব্য করে জেলে আ.লীগ নেতা, মামলার প্রক্রিয়ায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

চেয়ারম্যান রুস্তম আলীকে কারাগারে পাঠানোর প্রতিবাদে উপজেলা আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ মিছিল।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে এমপির বিরুদ্ধে মানহানিকর বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ৫ বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রুস্তম আলীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা। এই মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ কারও প্রভাব ও চাপে মামলা নিয়েছে এবং চার্জশিট দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা। পুরো ব্যাপারটিকে ‘বাড়াবাড়ি’ হিসেবে মন্তব্য করছেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। 

অন্যদিকে আইনজ্ঞরা বলছেন— কারও মানহানির ঘটনায় সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির মামলা সাধারণত আদালত নেয়না। কিন্তু থানায় প্রায়ই এসব মামলা নিয়ে নেয়। একপর্যায়ে এসে যার মানহানি হয়েছে তিনি বলে বসেন, মামলার বাদিকে তিনি চেনেন না। কিন্তু এর মধ্যেই বিবাদি হয়রানির শিকার হয়, আর থানা আদালতের সময়ও নষ্ট হয়। 

এর মধ্যে ফটিকছড়ি আসনের সংসদ সদস্য নজিবুল বশার মাইজভাণ্ডারী বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলেছেনও— তিনি মামলার বাদিকে চেনেন না। যদিও মামলার এজহারে বাদি ওমর ফারুক নিজেকে তরিকত ফেডারেশনের কর্মী বলে দাবি করেছেন। তবে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, ওমর ফারুক স্থানীয়ভাবে বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত।

পুলিশ ‘আওয়ামী লীগ নামধারী নেতাদের চাপে’ মামলাটি নিয়েছে জানিয়ে ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন মুহুরী সিভয়েসকে বলেন, ‘ভূজপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে আমি মামলা হওয়ার সাথে সাথেই কথা বলছি। পুলিশ আমাকে বলছে যে একজন সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি এই বিষয়ে একটা অভিযোগ দায়ের করেছে। এটা এমপি সাহেবের বিরুদ্ধে কথা বলে আমরা এটা রাখসি। কিন্তু আপনাদের দুই একজন তথাকথিত আওয়ামী লীগ নেতা এটা নিয়ে খুব ইন্টারেস্টেড। মামলা হওয়ার জন্য।’ 

এই মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ কোন নিয়ম কানুনের ধার ধারেনি মন্তব্য করে নাজিম উদ্দিন মুহুরী বলেন, ‘আমি জানি যে একজন সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি কারও বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে কোর্টে যেতে হবে এবং যার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তিনি নিজে দাঁড়িয়ে এই মামলা রুজু করতে হবে। সেরকম একটা বিষয় আছে। আবার থানায় যদি মামলা করে তাহলে কিভাবে করতে হবে? থানায় সর্বোচ্চ অভিযোগ করতে পারে। থানা সেটা তদন্ত করে কোর্টে পাঠাবে। তদন্তের ভিত্তিতে মামলা হতে পারে নাও হতে পারে। কিন্তু এখানে সেরকম আইনের ধার ধারে নাই। কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি মামলাটা নিয়েছেন।’

এই ধরনের ঘটনায় যার মানহানি হয়েছে তিনি ছাড়া সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির অভিযোগে মামলা নেওয়ার সমালোচনা করে মানবাধিকার আইনজীবী এডভোকেট জিয়া আহসান হাবীব সিভয়েসকে বলেন, ‘এসব মামলার ক্ষেত্রে যিনি ভিকটিম উনাকেই বাদি হতে হবে। পাওয়ার অব এটর্নি দিয়ে মামলা করলে আদালত নেয়না। তবে থানা এটা নিয়ে ফেলে। কিন্তু এটা উচিত না। আদালততো এসব মামলা নেয়না কিন্তু থানা কেন নিচ্ছে? থানা নেয়ার ফলে এসমস্ত মামলা বেশি হচ্ছে। পরে দেখা যায় যার বিরুদ্ধে কথা বলেছে উনি বলে যে আমিতো মামলা করি নাই। উনি অস্বীকার করে। কিন্তু ততক্ষণে বিবাদি কষ্টতো পেলো, পুলিশের সময় নষ্ট হলো, আদালতের এতগুলো সময় নষ্ট হলো।’

মামলা নেওয়ার পরেও বিভিন্নভাবে আলাপ আলোচনা করেও সুফল মেলেনি জানিয়ে ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন মুহুরী বলেন, ‘পরবর্তীতে আমি উনার (ভূজপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) সাথে মিনিমাম ১০ বার কথা বলেছি, রুস্তম ভাইয়ের সাথেও আমার আলাপ আলোচনা হয়েছে। আমাদের নানক ভাই (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য) আসছিল একবার রামগড়ে। নানক ভাইয়ের সাথেও আমরা কথা বলেছি। নানক ভাই এমপি সাহেবকে বিষয়টা জানিয়েছে রুস্তম ভাই সাথে ছিল। এমপি বলেছে, এই মামলায় আর সেরকম কোন অসুবিধা হবেনা। পরবর্তীতে একটা অনুষ্ঠানে আমি নিজেও এমপি সাহেবের সাথে কথা বলেছি। উনি আমাকে বলছেন মামলা নিয়ে উনি মাথা ঘামাচ্ছেন না। এটা চলে যাবে, এরকম কিছু বলছেন। কিন্তু পরবর্তীতে কার প্ররোচনায় এই মামলার চার্জশিট হয়ে গেছে আমি নিজেও জানিনা।’

মূলত বাগানবাড়ি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান ভেঙ্গে দিয়ে বিএনপি জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে আওয়ামী লীগের ভেতরের একটি মহল এসব করতে পুলিশকে বাধ্য করেছে মন্তব্য করে নাজিম উদ্দিন মুহুরী বলেন, 'এরমধ্যে রুস্তম ভাই হাইকোর্ট থেকে জামিন নিল। আমরা ভাবছি নিম্ন আদালতে গেলে হয়তো মামলাটা মীমাংসা হবে এটা আর কন্টিনিউ করবেনা। কিন্তু পরে দেখলাম একটা তালগোল পাকিয়ে ফেলা হয়েছে। বাদি একজন বিএনপির লোক, এখন কেউ কেউ বলছে তরিকত ফেডারেশনের লোক। আবার তরিকত ফেডারেশন বলছে তাদের লোক না। মূল বিষয় হলো রুস্তম আলীকে পরাজিত করার জন্য যিনি জানে প্রাণে চেষ্টা করেছে, সেখানে গিয়ে নৌকা মার্কা ভোট না দেয়ার কথা বলেছে, রুস্তম আলীকে এলাকা থেকে তাড়ানোর কথা বলেছে রুস্তম আলীকে চোর ডাকাত বলেছে তারাই এই মামলাটি পুলিশকে বাধ্য করে করেছে। রুস্তম আলী ওই ইউনিয়নের ৫ বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান।'

এই বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করা হবে জানিয়ে মুহুরী বলেন, 'সমালোচনা করার অধিকারতো সবারই আছে। হয়তো তিনি (রুস্তম আলী চেয়ারম্যান) বলেছেন যদি সেরকম অপরাধও হয়ে থাকে আমরা রাজনীতি করি, তিনি রাজনীতি করেন, যারা মামলা করেছে তারাও রাজনীতি করে। যদি এখানে কোন ভুল হয়েও থাকে রাজনৈতিকভাবে এটা সমাধান করা যেত। এই ব্যাপারটা স্পেশালি কারা কিভাবে করছে আমরা পার্টি থেকে তদন্ত কমিটি করবো। ফটিকছড়ির মানুষও জানে কারা এই বিষয়ে লাভবান। এখানে বিএনপি জামায়াতের লোকও জড়িত আছে। তাদের পারপাস সার্ভ করছে আমাদের দলেরও কিছু লোক। মূলত বাগান বাড়িতে আওয়ামী লীগের যে দূর্গ সেটা নষ্ট করার জন্যই এখানে ষড়যন্ত্র হয়েছে। মামলার বাদির বিরুদ্ধেও আমরা ব্যবস্থা নিব।' 

এদিকে পুরো বিষয়টিকে বাড়াবাড়ি দাবি করে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান আতা সিভয়েসকে বলেন, ‘রাজনীতিতে এই ধরনের অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ করে।  এগুলো নিয়ে সতর্কতার সাথে মন্তব্য করা উচিত। সেটা একটা বিষয় আছে। আবার একটা মন্তব্য করছেন বলে ভাণ্ডারী এমপি হয়ে এভাবে ট্রিট করাতো দরকার ছিল না। এগুলো বাড়াবাড়ি। এসবে আমাদের সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। এগুলো আমি সমর্থন করতে পারিনা। এটুকু সমালোচনা করার জন্য তাকে জেলে যেতে হলো। এটা লঘু পাপে গুরুদণ্ড হলো।'

তবে ঘুরে ফিরে এর জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিরোধকেই মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে এই সমস্যা সমাধানে সাংগঠনিক উদ্যোগ নিবেন জানিয়ে শেখ আতা বলেন, 'মামলা রুজু হওয়া ,তদন্ত, চার্জশিট হওয়া এগুলো আইনি ব্যাপার। এখানে সংগঠনের খুব বেশি করার সুযোগ নেই। তবু স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে আলাপ করে সিনিয়র নেতারা এটা মিমাংসা হয়তো করতে পারতো। কিন্তু সেখানকার পরিবেশটা একটু ভিন্ন। সেখানে স্থানীয় বিরোধ আছে। পরিবেশটা আন্থেলদি। আমরা এখন রুস্তম চেয়ারম্যানকে আইনি সহায়তা দিব। পরবর্তীতে এটা নিয়ে আমরা কাজ করবো। আমরা জেলা আওয়ামী লীগ এসব পারষ্পরিক বিবাদ একজনকে একজনের কলংকিত করার যে মানসিকতা  সেটাকে পরিহার করার জন্য আমাদেরকে একটা নিদৃষ্ট সাংগঠনিক প্রক্রিয়া শুরু করা দরকার বলে আমি মনে করি। 

এই মামলার বিষয়ে মামলার বাদি ওমর ফারুকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। 

অন্যদিকে ফটিকছড়ি আসনের সংসদ সদস্য ও তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশার মাইজভান্ডারীর বক্তব্য জানতে তার মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি কল রিসিভ না করায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে এর আগে অন্য একটি সংবাদ মাধ্যমকে সাংসদ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে বাদির কখনও দেখাই হয়নি। এটা লোকাল পলিটিকস। রুস্তম বা তার পক্ষের কেউ যদি আমার সঙ্গে দেখা করত, তাহলে আমি বাদিকে পুলিশ দিয়ে খুঁজে বের করে মামলা তুলে নিতাম। কিন্তু কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।’

প্রসঙ্গত ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি রাতে বাগান বাজার ইউনিয়নের বড়বিল মতিননগর জামে মসজিদের মাঠে অনুষ্ঠিত মাহফিলে বক্তব্য রাখতে গিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীকে জড়িয়ে অপমানজনক মন্তব্য করার অভিযোগ করে  রুস্তম আলীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন তরিকত ফেডারেশন কর্মী ওমর ফারুক। থানা পুলিশ তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। আদালত আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে উচ্চ আদালত থেকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন নেন সাবেক চেয়ারম্যান রুস্তম আলী। উচ্চ আদালতের জামিনের মেয়াদ শেষে রুস্তম আলী গত ২১ জুন মঙ্গলবার চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতের বিচারক জহুরুল কবিরের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করলে আদালত জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়