Cvoice24.com

হালদায় ডিম সংগ্রহ কমলেও রেণু উৎপাদন বেড়েছে

শারমিন রিমা

প্রকাশিত: ১০:৫২, ২৪ জুন ২০২২
হালদায় ডিম সংগ্রহ কমলেও রেণু উৎপাদন বেড়েছে

দেশের একমাত্র কার্পজাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ) মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদী। এবছর হালদায় নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের পরিমাণ প্রায় সাড়ে সাত হাজার কেজি এবং রেণু পোনা উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৩০ কেজি। গতবারের তুলনায় এবার প্রায় এক হাজার কেজি ডিম কম পেয়েছে সংগ্রহকারীরা। ডিম সংগ্রহের পরিমাণ কম হলেও অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার রেণুর উৎপাদন বেড়েছে। যেখানে গতবারের তুলনায় প্রায় ২৫ কেজি বেশি রেণুর উৎপাদন হয়েছে এবছর। শুধু উৎপাদন নয় এবছর কোনো রেণু নষ্টও হয়নি। 

হালদার দুই পারে চলছে রেণু ফোটানোর ‘উৎসব’

তবে গতবার রেণু নষ্ট হওয়ার পেছনের কারণ ছিল প্রজননের সময় ঘূর্ণিঝড় হওয়া এবং নদীর পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া। অথচ এবছর নদীর পরিবেশ নিরাপদ থাকায় ডিম সংগ্রহ বাড়ার সম্ভাবনা দেখেছিলেন গবেষকরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলের অভাবে মা মাছ একবারে ডিম ছাড়েনি; থেমে থেমে চার দফায় ডিম ছাড়ে মা মাছ। অর্থাৎ মা মাছের ডিম ছাড়ার জন্য যে পরিমাণ বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন ছিল সে পরিমাণ বৃষ্টি এবার হয়নি। আর বৃষ্টি না হওয়ায় এবার ডিমের পরিমাণও কম ছিল। গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবছর প্রায় তিনমাস পর বৃষ্টির দেখা মিলেছে। যা গত ২১ বছরের বৃষ্টিপাতের রেকর্ড ভেঙেছে। আর যথাসময়ে পর্যাপ্ত এ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে মা মাছের প্রজননে। 

হালদায় ডিম সংগ্রহে ভাঙলো একযুগের রেকর্ড

এদিকে, হালদা নদীতে এবছর মা মাছ প্রথম দফায় ডিম ছাড়ে গত ১৬ মে দিনগত রাত এবং দ্বিতীয় দফায় ১৭ মে দিবাগত রাতে। তৃতীয় দফায় ডিম ছাড়ে ১৭ জুন রাতে এবং চতুর্থ দফায় ওইদিন (১৭ জুন) বিকেলে। এ চার দফায় হালদা নদীতে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছে। যদিও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া ডিমের সঠিক হিসাব জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্টরা। 

জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, চার দফায় এবছর ৭ হাজার ২০০ কেজি নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে এবং ডিম থেকে রেণু পোনা উৎপাদন হয়েছে ১২৯ কেজি। যেখানে হালদায় গতবার মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৫০০ কেজি। রেণু পোনা হয়েছিল ১০৫ কেজি। 

হালদায় ডিম ছেড়েছে মা মাছ

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা মৎস অফিসের এক কর্মকর্তা সিভয়েসকে বলেন, ‘এবার ডিম সংগ্রহ কম কিন্তু রেণু বেশি। গতবার ডিম নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু এবার ডিম নষ্ট হয়নি। তাই রেণু পোনার উৎপাদন ভালো হয়েছে। কিন্তু সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাবে এবার আশানুরূপ ডিম পাওয়া যায়নি। যেটা গতবছর হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার কারণে প্রচুর রেণু নষ্ট হয়েছিল। আর এবার কিন্তু সেটা হয়নি।’

ডিম ছাড়ার জন্য উপযোগী হালদা নদীর পানি, বাড়তে পারে ডিম সংগ্রহ— বলছে গবেষণা

এক প্রশ্নের জবাবে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘এবার বিক্ষিপ্তভাবে ডিম দেওয়ায় সবাই (ডিম সংগ্রহকারী) একসাথে নদীতে নামতে পারেনি। ডিম কম সংগ্রহ হওয়ার এটা একটা কারণ হতে পারে। তাছাড়া মা মাছের ডিম ছাড়ার কুম নষ্ট হয়ে গেছে আর সে বিষয় নিয়ে আমাদের কোনো গবেষণাও নেই। এরপরেও আমাদের সব প্রস্তুতি ছিল তাও কেন কম ডিম দিলো তা বলতে পারবো না।’

হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া সিভয়েসকে বলেন, ‘ওরা (মা মাছ) ডিম ছাড়তে চায়। যখন প্রকৃতি অনুকূল অবস্থায় থাকে তখনই ডিম ছাড়তে চেয়েছে। কিন্তু যখন দেখলো প্রকৃতি অনুকূলে না তখন আর ডিম ছাড়েনি। যার কারণে এবার চার দফায় মা মাছ ডিম ছাড়ে। আর সেকারণেই ডিম সংগ্রহের পরিমাণটা কম। তাছাড়া যেটুকু ডিম এবার সংগ্রহ হয়েছে তা শেষ দফায় হয়েছে।’

হালদায় মা মাছ ডিম ছাড়লেও হতাশ ডিম সংগ্রহকারীরা

ডিম কম হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে এ গবেষক বলেন, ‘প্রথমত চার দফায় ডিম ছেড়েছে। যদি একবারেই ডিম ছাড়তো তবে ডিম সংগ্রহের পরিমাণ বাড়তো। আর চারবারে ডিম ছাড়ার প্রধান কারণ এ বছর যথেষ্ট পরিমাণ বৃষ্টি হয়নি। হালদায় ডিম ছাড়ার জন্য শুধু একটা প্যারামিটার থাকে না। অনেকগুলো ফেক্টর বা প্যারামিটার কাজ করে। আমরা টোটাল ফেক্টরটাকে তিনভাগে ভাগ করতে পারি। ফিজিক্যাল, বায়োলজিক্যাল আর কেমিক্যাল। সবগুলো ফেক্টরেই স্ট্যার্ন্ডাড মেইনটেইন করতে হয়। যে বছর প্রকৃতিসহ হালদায় সবগুলোর আদর্শমান বজায় থাকে সে বছর খুব ভালো ডিম হয়। যদি কোনো একটা ফেক্টরে তারতম্য ঘটে তবে ডিমের পরিমাণ কমে যায়। গতবছর ডিম কম পাওয়ার কারণ ছিল স্যালাইনিটি। এবার হালদায় পানিসহ সবকিছুর গুণগতমান ভালো থাকার পরেও প্রকৃতি অনূকূলে ছিল না। অর্থাৎ মা মাছের ডিম ছাড়ার জন্য যে পরিমাণ বৃষ্টির প্রয়োজন ছিল সে পরিমাণ বৃষ্টি এবার হয়নি। আর বৃষ্টি না হওয়ায় এবার ডিমের পরিমাণ কম ছিল।’

বৃষ্টিপাতের অভাবে দেশিয় মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শুধু হালদার মা মাছের প্রজনন ব্যাহত হয়েছে তা নয়; সব ধরনের দেশিয় মাছের প্রজনন ব্যাহত হয়েছে। গত সপ্তাহে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে সেটা হওয়ার কথা ছিল এপ্রিলে। যা প্রায় তিনমাস পর কাঙ্খিত বৃষ্টি হয়েছে। আমার হালদা নিয়ে কাজ করার প্রায় ২১-২২ বছরের জীবনে এবারই এমন ঘটেছে। এরকম দেরিতে বৃষ্টি আর কখনোও পাইনি। কম বৃষ্টিপাত এটা অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই হয়েছে।’

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে হালদার মা মাছের ভবিষ্যৎ!

এ বিষয়ে জেলা মৎস কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী সিভয়েসকে বলেন, ‘এ বিষয়ে এখন আপনাদের বলতে পারবো না। কারণ মিনিষ্ট্রি (মন্ত্রণালয়) থেকে নিষেধ আছে। আগে উনাদের বলবো, তারপর মিনিষ্ট্র যখন অনুমোদন দিবেন তারপরে আপনাদের জানাবো।’

হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির হিসাব মতে, হালদায় গতবার মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৫০০ কেজি। রেণু পোনা হয়েছিল ১০৫ কেজি। ২০২০ সালে রেকর্ড পরিমাণ ডিম সংগ্রহ হয়েছে হালদা নদী থেকে। যা ছিল গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংগ্রহকৃত ডিম। তার আগের বছর (২০১৯ সালে) প্রায় ১০ হাজার কেজি ডিম থেকে রেণু মিলেছিল ২০০ কেজি। প্রতি কেজি রেণু ৮০ হাজার টাকা দর হিসাবে যার বাজার মূল্য ছিল প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর আগে ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়, যা থেকে রেণু মিলেছিল ৩৭৮ কেজি। ২০১৭ সালের ২২ এপ্রিল ১৬৮০ কেজি ডিম পাওয়া যায় হালদায়। ২০১৬ সালের ২ মে নমুনা ডিম মেলে ৭৩৫ কেজি। ওই বছর তিনবার নমুনা ডিম দিলেও আর ডিম ছাড়েনি মা মাছ। ২০১৫ সালের ২০ এপ্রিল ও ১২ জুন দুই দফায় মিলে মোট ২ হাজার ৮০০ কেজি, ২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল ১৬ হাজার ৫০০ কেজি, ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল ৪ হাজার ২০০ কেজি এবং ২০১২ সালে ২১ হাজার ২৪০ কেজি ডিম মেলে হালদায়।

সিভয়েস/এসআর

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়