Cvoice24.com

ন্যায্যতা রুখতে পরিকল্পিত হামলা— দাবি শ্রমিকদের

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ১৭ এপ্রিল ২০২১
ন্যায্যতা রুখতে পরিকল্পিত হামলা— দাবি শ্রমিকদের

পুলিশের গুলিতে নিহত শ্রমিকের লাশ নিয়ে আরেক শ্রমিকের আর্তনাদ।

রোজার ইফতার ও নামাজের সময় চাওয়া, বকেয়া বেতন আদায় ও ছাঁটাইয়ে নিয়ম মানাসহ ১২ দফা দাবিতে শ্রমিকরা যখন চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য জড়ো হয়েছিল তখনই তাদের ওপর পুলিশ পরিকল্পিতভাবে হামলা করেছে বলে অভিযোগ করেছেন এস আলমের মালিকানাধীন এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের শ্রমিকরা। তাদের দাবি, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিকে অন্যদিকে প্রভাবিত করতেই কোম্পানি পুলিশ দিয়ে পরিকল্পিতভাবে হামলা করেছে। আর এতে পাঁচ শ্রমিক মারা যান। 

যদিও পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি বলছেন, শ্রমিকরা এখন তাদের সুবিধামত কত কথা বলবে। পুলিশ কাউকে ইচ্ছা করে গুলি করে না। আত্মরক্ষার্থেই মূলত গুলি ছুড়ে। সেখানে সাড়ে আট শতাধিক চীনা নাগরিক কাজ করে তাদের যদি কোনও ক্ষতি হতো তখন সরকার চীনকে কী জবাব দিতো?

শনিবার (১৭ এপ্রিল) পৌনে ১২টায় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেতন-ভাতা সংক্রান্ত বিক্ষোভ থেকে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের গুলিতে মারা যান পাঁচ শ্রমিক। আহত হন আরও ১৭ শ্রমিক ও তিন পুলিশ সদস্য। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চার সদস্যের পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের পক্ষ থেকে একটি ও পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মোট দুটি মামলা দায়ের করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের এক বৈঠকে নিহতের পরিবারকে কোম্পানির পক্ষ থেকে ৩ লাখ টাকা করে ও আহতদের ৫০ হাজার টাকা সহায়তা প্রদান করা হবে বলে জানান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সুমনী আক্তার।

এতো কিছু ঘটছে যাদের নিয়ে তারা কী বলছেন এ আন্দোলন ও নিহতের বিষয়ে। এমনই কজন শ্রমিকের সাথে কথা বলে সিভয়েস। 

রিগার পদে কাজ করা জাহিদ হোসেন নামে একজন বলেছেন, দুই মাসের বেতন বাকি, রোজায় ইফতারের সময়ও দেয় না। প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার শ্রমিক কাজ করলেও তাদের পারিশ্রমিকসহ নানাভাবে বঞ্চিত করা হতো। সকাল থেকে তারা সবাই জড়ো হয়ে দাবি আদায় নিয়ে কথা বলছিলেন বিদ্যুৎকেন্দ্রে। সকাল ৯টার পর পুলিশ এসে তাদের জোর করে বাসার ভেতর ঢুকিয়ে দিতে লাগছিল। পুলিশ শ্রমিকদের উদ্দেশ্য করে বলে, তোমরা ঘরে ঢুকে যাও, তোমাদের দাবিগুলো পূরণ করা হবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর পুলিশ সেখানে থাকা একটি প্রাইভেট কারে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপরপরই রাবার বুলেটের পাশাপাশি সরাসরি গুলি ছুড়ে। গুলিতে একের পর এক শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হচ্ছিল। তখন উত্তেজিত শ্রমিকরা সবাই বের হয়ে আসে।  

সাইদুল আসলাম হৃদয় নামে অপর এক শ্রমিক জানিয়েছেন, তারা কোনও ছুটি পেতেন না। যত ঘণ্টা কাজ করতেন তত ঘণ্টার বেতন দেওয়া হতো। কেউ অসুস্থ হয়ে কাজে যোগ দিতে না পারলে তাদের বেতন কেটে রাখা হতো। এছাড়া চীনা শ্রমিকরা উন্নতমানের জীবন যাপন করলেও তাদের বাসস্থান দূরের কথা টয়লেট পর্যন্ত ব্যবহার উপযোগী করা হয়নি। এছাড়া ইফতারের সময় ও জুমার নামাজেরও সময় চাইলে তা দেওয়া হতো না। 

মোহাম্মদ আশিক নামে অপর এক ওয়েল্ডার জানিয়েছেন, এমনও শ্রমিক আছে নিজের খাওয়া নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করলেও ঘণ্টায় ৫০ টাকায় চাকরি করতে হতো। আবার অনেককে ১২০ টাকাও দিতো। সেখানে শ্রমিকদের নানাভাবে বঞ্চিতের পাশাপাশি চীনা শ্রমিকরা নির্যাতন করতো। এসব শ্রমিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বললেও তারা চীনাদের পক্ষেই থাকতো। তাই দাবি আদায়ে সকলেই একজোট হলে সেই দাবি আদায় নস্যাৎ করতেই পুলিশকে দিয়ে কোম্পানি পরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদের ওপর গুলি করেছে। সেখানে গাড়িসহ নানা স্থাপনা জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য কোম্পানি ও পুলিশকে দায়ী করেছেন শ্রমিকরা। 

তাদের দাবিগুলো ছিল— ১. ১০ তারিখ বেতন দিতে হবে। ২. পানি ও বাথরুম ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। ৩. রমজান মাসে ৮ ঘন্টা করে ডিউটি করাতে হবে, কেননা ১০ ঘণ্টা ডিউটি করলে ইফতারের সময় পাওয়া যায় না। ৪. শুক্রবার অর্ধ কর্ম দিবস দিতে হবে, জুমার নামাজ পড়া ও বিশ্রামের সুযোগের জন্য। ৫. ঈদের বোনাস ৫০ % দিতে হবে। ৬. কোন শ্রমিক কাটিংয়ের (ছাঁটায়ের) ১ মাস আগে বলতে হবে এবং ছাঁটাইয়ের পর তার পাওনা বেতন দিতে হবে। যখন তখন হুট করেই ছাঁটাই করা যাবে না। ৭. অগ্নিকাণ্ডে কোন শ্রমিকের ক্ষতি হলে সম্পূর্ণ খরচ বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে বহন করতে হবে। ৮. স্কেল অনুসারে শ্রমিকদের বেতন দিতে হবে। ৯. ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও শ্রমিকরা বীমা ভাতা পান না; তাই ইন্সুরেন্স সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ১০. কোন চাইনিজ বাঙ্গালি শ্রমিকদের গায়ে হাত দিতে পারবে না। ১১. সকাল ৭টা থেকে ডিউটি দিতে হবে এবং ১২. সকল দাবি পূরণ হলে ডিউটিতে যোগ দেওয়া।   

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন সিভয়েসকে বলেন, ‌‘দেখুন একটা ঘটনা ঘটে গেলে শ্রমিকরা তাদের সুবিধামত কত কথা বলবে। পুলিশ কখনো ইচ্ছা করে গুলি করে না। পুলিশ সব সময় আত্মরক্ষার মুডে থাকে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে পুলিশকেই আক্রমণ করে শ্রমিকরা। পুলিশও জানমাল রক্ষার্থে তাদের থামাতে গেলে গুলি করতে বাধ্য হয়।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘এ ঘটনায় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। দুটি মামলাও হচ্ছে। তদন্তে সব উঠে আসবে। এছাড়া সেখানে প্রায় সাড়ে ৮ শতাধিক চীনা নাগরিক কাজ করছে। তাদের কেউ যদি কোনও অঘটনের শিকার হতো তখন কি জবাব দিতাম আমরা চীনকে? পুলিশ সামগ্রিক বিষয় মাথায় নিয়েই আত্মরক্ষার্থে গুলি করে উত্তেজিত শ্রমিকদের নিবৃত্ত করেছে। হয়তো তখন পাঁচজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।’ 

বেসরকারি খাতে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এসএস পাওয়ার লিমিটেড ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রকল্পের ৭০ শতাংশের মালিকানা আছে এস আলম গ্রুপের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশের মধ্যে চীনের সেপকো থ্রি ২০ শতাংশ এবং চীনের অপর প্রতিষ্ঠান এইচটিজি ১০ শতাংশ। চুক্তিতে ৪৫ মাসের মধ্যে প্রকল্প সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে হিসাবে ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর কেন্দ্রটিতে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, পিডিবি ২৫ বছর ধরে এই কেন্দ্রে উৎপাদিত সব বিদ্যুৎ কিনবে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ৬ টাকা ৬০ পয়সার মতো।  

এস আলম সহ চীনের দুই প্রতিষ্ঠান প্রায় ২৫০ কোটি ডলারের এ প্রকল্পের মালিক হলেও নির্মাণাধীন প্রকল্পে শ্রমিক সরবরাহের কাজ করে মূলত বেসরকারি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো— মাহি এন্টারপ্রাইজ, এনআরএম এন্টারপ্রাইজ, রকিব এন্টারপ্রাইজ, আলী এন্টারপ্রাইজ, আদিবা এন্টারপ্রাইজ, ইমা এন্টারপ্রাইজ, উজ্জ্বল এন্টারপ্রাইজ। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৭ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। তবে বেশিরভাগ শ্রমিক সরবরাহ করছে মাহি এন্টারপ্রাইজ। প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ থেকে ঘণ্টা প্রতি ১৩০ টাকা করে নেওয়া হলেও তাদের থেকে ১০ টাকা করে রেখে দিয়ে ১২০ টাকা করে দেওয়া হচ্ছিল। এনিয়েও ক্ষোভ ছিল আন্দোলনরত শ্রমিকদের মাঝে। 

এদিকে রাষ্ট্রীয় অভ্যন্তরীণ একটি গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৭ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারায় বেসরকারিভাবে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে ইফতার, নামাজ সূচি নির্ধারণ ও বেতন-ভাতা নিয়ে স্থানীয় শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করলে কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদেরকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। পরবর্তীতে ঘটনাস্থলে পুলিশ এলে, শ্রমিকরা পুলিশ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের উপর হামলা করে। এতে পুলিশসদস্যরা গুলি চালায়। এ সময় পুলিশের গুলিতে ৫ জন স্থানীয় শ্রমিক নিহত হয়। এ ঘটনায় ৩ জন পুলিশ সদস্যসহ ৩০ আহত হয়েছেন বলে প্রাথমিক ভাবে জানা যায়। গুরুতর আহতদের মধ্যে ৭ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের অবস্থা আশংকাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। বিদ্যুৎকেন্দ্রে দায়িত্বরত বিদেশী কর্মীগণ নিরাপদে রয়েছেন বলে জানা যায়। বর্তমানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। 

গতকাল বাদে মাগরিব তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইফতার, নামাজ সূচি নির্ধারণ ও বেতন-ভাতা সংক্রান্ত ১০ দফা দাবি দাওয়া নিয়ে স্থানীয় শ্রমিকদের সাথে প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের মতবিরোধ থেকে বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়