Cvoice24.com

লুটপাট করতেই বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা-অগ্নিসংযোগ!

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৯:৪৫, ১৮ এপ্রিল ২০২১
লুটপাট করতেই বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা-অগ্নিসংযোগ!

বাঁশখালীতে এস আলমের মালিকানাধীন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিক আন্দোলনের নেপথ্যে স্থানীয় এক ডাকাত চক্রের হাত দেখছে কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকদের দাবি আদায়ে আগের দিন ঐক্যমত হলেও স্থানীয় ওই ডাকাতচক্র তাদের উস্কে দিয়ে চীনা পল্লীতে হামলার পরিকল্পনা করে। হামলা হলেই যাতে সেখানে লুটপাট চালাতে পারে সেই পরিকল্পনা নিয়েই আন্দোলনকে উস্কে দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে। এই ফাঁদে পা বাড়ায় শ্রমিকের সঙ্গে পুলিশও। শ্রমিকদের আন্দোলন পুলিশ প্রথমে থামাতে ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় দফায় শক্তি বৃদ্ধি করে তাদের থামাতে এলেও সংঘর্ষে জড়ায় শ্রমিকরা। এতে পুলিশের গুলিতে পাঁচ শ্রমিক নিহত হয়। সংঘর্ষের পর এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১০ কোটি টাকার সম্পত্তি লুট হওয়ার দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ।

পুলিশ, তদন্ত কমিটি, মামলার এজাহার সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পুলিশের মামলায় আসামি অজ্ঞাত হলেও এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষের মামলায় ২২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সেই মামলায় স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রশীদকে প্রধান আসামি করে নুরুল আলম ও তৈয়বকে আসামি করা হয়েছে। তারা সকলেই বাঁশখালীর গণ্ডমারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড় ঘোনার বাসিন্দা। প্রায় ৬০০ একর জমিজুড়ে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে অংশে চীনা পল্লী সেখানটার অবস্থান পশ্চিম বড়ঘোনা। ওই পল্লীতে প্রায় সাড়ে ৮ শতাধিক চীনা নাগরিক বাস করে। এছাড়া অন্যপাশে বাস করে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাঙালি শ্রমিক।

এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের চীফ কোর্ডিনেটর ফারুক আহমেদ বাদি হয়ে স্থানীয় রশীদ, নুরুল আলম, তৈয়বসহ ২২ জনের নাম উল্লেখ করে আজ্ঞাত আরও ১ হাজার ৫০ জনকে আসামি করে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরের একটি মামলা করেন। তিনি মামলার এজহারে ১০ কোটি টাকার সম্পদ লুট এবং ১৫ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করেন।  

রবিবার জেলা প্রশাসন ও পুলিশের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তদন্ত কমিটিকেও বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ মালামাল লুট করতেই এই আন্দোলনকে উস্কে দেওয়ার কথাটি জানিয়েছে। এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মোস্তাইন বিল্লাহ আদিল সিভয়েসকে বলেন, ‘শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া মানার বিষয়ে আগের দিনের বৈঠকে সব চূড়ান্ত হলেও পরের দিন হঠাৎ কেন এ পরিস্থিতি— তা বোধগম্য নয়। আমরা পরে শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জেনেছি, স্থানীয় ডাকাত দলের নেতা রশীদের নেতৃত্বে একটি চক্র চীনা পল্লীতে লুটপাট করার জন্যই শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে আন্দোলনের নামে একটা গণ্ডগোল পাকায়। সেই ফাঁদে পা দিয়ে কয়েকজন শ্রমিকও প্রাণ হারালো, অন্যদিকে সেই চক্রটি তাদের স্বার্থ হাসিল করেছে। আমাদের প্ল্যান্ট থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার সম্পদ লুট করেছে আর ১৫ কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তাদের টার্গেট ছিল, চীনা নাগরিকরা যেখানে থাকে সেখানে হামলা করে লুটপাট করা। যদি পুলিশ সঠিক সময়ে অ্যাকশনে না যেত তাহলে কমপক্ষে ২০ জন চীনা নাগরিক মারা যেত। তাদের লক্ষই ছিল সেরকম। আমরা ভিডিও ফুটেজ দেখেছি সেখানে লুঙ্গি পরা অনেক স্থানীয় মানুষজন প্রবেশ করেছে। প্রশাসন সব কিছু শক্ত হাতে দমন করেছে বলে বড় কোনও অঘটন ঘটেনি। এরপরও আমরা আমাদের বক্তব্য তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছি। তারাও তাদের মত করে সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করবে। তদন্তেই সব উঠে আসবে।’

এসময় ২০১৬ সালের হোতা স্থানীয় চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা লিয়াকত আলীর কোনও সম্পৃক্তা প্রাথমিকভাবে নেই বলে জানান তিনি। এদিকে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, শ্রমিকদের আন্দোলন ও হামলার ঘটনার জন্য স্থানীয়রা ২০১৬ সালের আন্দোলনের হোতা গণ্ডমারার চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা লিয়াকত আলীর ইন্ধন থাকার কথা বললেও তাকে আসামি করা হবে কি না তার জন্য শনিবার রাতভর দফায় দফায় বৈঠক করেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি পুলিশ। অবশেষে ভোর রাতে তাকে বাদ দিয়েই এই মামলা দুটি করা হয়। 

শ্রমিক নিহত ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গতকাল থেকে এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ রয়েছে। চীনা নাগরিকরা নিরাপদে রয়েছে। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়ন করা হয়েছে বলে জানান বাঁশখালীর ওসি শফিউল কবীর।  

যদিও শ্রমিকরা গতকাল ঘটনার দিন বলেছিলেন, রোজার ইফতার ও নামাজের সময় চাওয়া, বকেয়া বেতন আদায় ও ছাঁটাইয়ে নিয়ম মানাসহ ১২ দফা দাবিতে শ্রমিকরা যখন চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য জড়ো হয়েছিল তখনই তাদের ওপর পুলিশ পরিকল্পিতভাবে হামলা করেছে। তাদের দাবি, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিকে অন্যদিকে প্রভাবিত করতেই কোম্পানি পুলিশ দিয়ে পরিকল্পিতভাবে হামলা করেছে। 

শনিবার (১৭ এপ্রিল) পৌনে ১২টায় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেতন-ভাতা সংক্রান্ত বিক্ষোভ থেকে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের গুলিতে মারা যান পাঁচ শ্রমিক। আহত হন আরও ১৭ শ্রমিক ও তিন পুলিশ সদস্য। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চার সদস্যের পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের পক্ষ থেকে একটি ও পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মোট দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের এক বৈঠকে নিহতের পরিবারকে কোম্পানির পক্ষ থেকে ৩ লাখ টাকা করে ও আহতদের ৫০ হাজার টাকা সহায়তা প্রদান করার ঘোষণা দেওয়া হয়। 

এর আগে শনিবার রক্তক্ষয়ী এই সংঘাতের পেছনে স্থানীয় ‘স্বার্থান্বেষী’ মহলের ইন্ধন আছে বলে আশংকা করে প্রশাসন। উসকানিদাতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসক। 

দুই সংস্থার পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত দলও বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। শ্রমিকদের বিক্ষোভের আড়ালে চীনের নাগরিকদের ওপর আক্রমণ ও তাদের বাসস্থানে লুটপাট কেন হল সেটি তদন্তে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসনের তদন্ত দল। 

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি প্রধান ও চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তার বলেন, ‘স্থানীয় কিছু স্বার্থান্বেষী মহল উসকানি দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে আমরা ধারনা করছি। এদেশের অগ্রগতি-উন্নয়ন অনেকের চক্ষুশূল। তাই এখানে চীনা শ্রমিকদের উপর হামলার বিষয়টি আমাদের বিশেষ বিবেচনায় আছে। তদন্ত শেষ হলে সব বলা যাবে।’

শ্রমিকদের দাবি আদায় থেকেই এ আন্দোলনের সূত্রপাত নাকি এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের বক্তব্য অনুযায়ী লুটপাট করতেই এ ঘটনা ঘটানো হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম ও অপারেশন) জাকির হোসেন খান বলেন, ‘ আমরা সব কিছু মাথায় নিয়ে তদন্ত করছি। তদন্তকালীন সময়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি নয়। 

এদিকে বাঁশখালী থানার ওসি বাঁশখালী থানা ওসি শফিউল কবীর বলেন, মামলা হয়েছে। এখন তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। 

বেসরকারি খাতে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এসএস পাওয়ার লিমিটেড ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রকল্পের ৭০ শতাংশের মালিকানা আছে এস আলম গ্রুপের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশের মধ্যে চীনের সেপকো থ্রি ২০ শতাংশ এবং চীনের অপর প্রতিষ্ঠান এইচটিজি ১০ শতাংশ। চুক্তিতে ৪৫ মাসের মধ্যে প্রকল্প সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে হিসাবে ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর কেন্দ্রটিতে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, পিডিবি ২৫ বছর ধরে এই কেন্দ্রে উৎপাদিত সব বিদ্যুৎ কিনবে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ৬ টাকা ৬০ পয়সার মতো। 

এস আলম সহ চীনের দুই প্রতিষ্ঠান প্রায় ২৫০ কোটি ডলারের এ প্রকল্পের মালিক হলেও নির্মাণাধীন প্রকল্পে শ্রমিক সরবরাহের কাজ করে মূলত বেসরকারি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো— মাহি এন্টারপ্রাইজ, এনআরএম এন্টারপ্রাইজ, রকিব এন্টারপ্রাইজ, আলী এন্টারপ্রাইজ, আদিবা এন্টারপ্রাইজ, ইমা এন্টারপ্রাইজ, উজ্জ্বল এন্টারপ্রাইজ। 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়