Cvoice24.com

বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিকদের গুলিতেই পাঁচ শ্রমিকের মৃত্যু—দাবি পুলিশের 

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ২০ এপ্রিল ২০২১
বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিকদের গুলিতেই পাঁচ শ্রমিকের মৃত্যু—দাবি পুলিশের 

চমেক হাসপাতালে নিহত শ্রমিককে বুকে নিয়ে সহকর্মীর আহাজারী। ফাইল ছবি।

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এস আলমের যৌথ মালিকানাধীন এস এস পাওয়ার প্লান্টে পুলিশের গুলিতে পাঁচ শ্রমিক নিহত হলেও পুলিশ এখন বলছে তাদের গুলিতে নয়; শ্রমিকদের গুলিতেই তারা নিহত ও আহত হয়েছে। এমন দাবি করেছে বাঁশখালী থানায় ঘটনার পর দায়ের করা পুলিশের মামলার এজহারে। যদিও ঘটনাস্থলে আহত একাধিক শ্রমিক জানিয়েছিলেন, পুলিশই তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে।  

পুলিশের গুলি করার বিষয়টি এজহারে স্বীকার না করলেও ওই সময়ে গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছিলেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি, এসপি, ওসি সকলেই। এমনকি এসপি রশীদুল হক একটি পত্রিকাকে বলেছিলেন, ‘পুলিশকে লক্ষ্য করে শ্রমিকরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কয়েকজনের হাতে অস্ত্রও ছিল। সম্পদ রক্ষা ও আত্মরক্ষার্থে পুলিশ সদস্যরা গুলি ছোড়েন। এর আগে টিয়ার গ্যাস, ২৭০ টি রাবার বুলেট নিক্ষেপ করা হয় ‘  

ন্যায্যতা রুখতে পরিকল্পিত হামলা— দাবি শ্রমিকদের

কিন্তু বাঁশখালী থানার গণ্ডামারা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই রাশেদুজ্জামান বেগ অজ্ঞাত ২৫০০ জনের বিরুদ্ধে করা মামলায় উল্লেখ করেছেন, শ্রমিক ও বহিরাগতরা মিলে গুলি করে এবং তাতে পাঁচ শ্রমিক নিহত হয়। সেই মামলায় আসামি করা হয়েছে শ্রমিকদেরও। অথচ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নতদন্তকারী চিকিৎসক বলেছিলেন, খুব কাছ থেকেই গুলি করা হয়েছে। ফলে নিহতদের শরীরের এদিকে ঢুকে অন্যদিকে বের হয়ে যায়। 

ঘটনার দিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আনোয়ারুল হক জানিয়েছিলেন, আহত শ্রমিকদের সবাই গুলি বা স্প্লিন্টারে বিদ্ধ। তবে পুলিশ সদস্যরা আহত হয়েছেন ইটের আঘাতে। 

এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে শ্রমিকরা যেসব গুলির খোসা উদ্ধার করে সাংবাদিকদের দেখিয়েছেন, তার সাথে পুলিশের রাইফেলের গুলির খোসার মিল রয়েছে বলে জানা গেছে।  

বাঁশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিক বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে পাঁচজন নিহত

সংঘর্ষের পর শনিবার রাতে গণ্ডামারা পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মো. রাশেদুজ্জামান বেগ অজ্ঞাত দুই থেকে আড়াই হাজার জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। পুলিশের মামলার এজহারে বলা হয়েছে, শনিবার সকাল ৯ টা থেকে ৯ টি দাবি নিয়ে জড়ো হয়ে শ্রমিকরা আন্দোলন করছিলো। একই সময় বিপুল সংখ্যক বহিরাগত কাঁটাতারের বেড়া ভেঙ্গে প্রকল্প এলাকায় প্রবেশ করে। পরে শ্রমিক ও বহিরাগতরা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অভ্যন্তরে ভাংচুর করে। বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করে আনুমানিক ১৫ কোটি টাকার ক্ষতি সাধন করে এবং প্রায় ১০ কোটি টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায় বলে এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। গণ্ডামারা এস এস পাওয়ার প্লান্টে অজ্ঞাতনামা দুই থেকে আড়াই হাজার শ্রমিক - বহিরাগত প্লান্টের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্য আক্রমণ করে মারধর করত গুরুতর জখম করে ও গুলি বর্ষণ করে ৫ জন শ্রমিককে হত্যা করে।

যদিও শ্রমিকেরা দাবি করেছেন, তারা যখন ন্যায় সংগত দাবি নিয়ে কথা বলছেন তখন পুলিশ নিরস্ত্র শ্রমিকদের উপর বিনা উস্কানিতে গুলি চালিয়ে তাদের পাঁচ সহকর্মীকে হত্যা করেছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রিগারম্যান হিসেবে কর্মরত জাহিদুল ইসলাম নামে এক শ্রমিক বলেন, 'পুলিশ গুলি করে আমার সহকর্মীদের হত্যা করেছে। পুলিশ নিজেরা পাওয়ার প্লান্টের ভিতরে একটি কারে আগুন দিয়ে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে গুলি চালায়।'

মামলার এজহারের এক পর্যায়ে পুলিশ অবশ্য স্বীকার করেছে তারাও গুলি ছুঁড়েছে। তারা বলেছে, শ্রমিকেরাই আগে পুলিশ ও পাওয়ার প্ল্যান্টে কর্মরত চীনা শ্রমিকদের উপর হামলা করে। এক পর্যায়ে শ্রমিকদের বাসস্থান বাংলা লিভিং হতে (নির্মাণাধীন পাওয়ার প্লান্টের অভ্যন্তরে শ্রমিকদের থাকার জায়গা) পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় শ্রমিকরা। এসময় চীনা শ্রমিকদের জানমাল ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্পদ রক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালায়। 

বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিক আন্দোলনের নেপথ্যে...

মামলার তথ্য মতে, গুলির ঘটনার সময় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কোন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না। গণ্ডামারা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই রাশেদুজ্জামান বেগের নির্দেশে গুলি করা হয়। গুলির কথা স্বীকার করলেও পাঁচ শ্রমিক তাদের সহকর্মী ও বহিরাগতদের গুলিতে নিহতের দাবি করেছে এজহারে। তবে শ্রমিকদের হামলায় কোন চীনা শ্রমিক আহত হয়নি বা পুলিশ গুলিবিদ্ধ হওয়ার কোনো ঘটনা নেই; নেই কোন অস্ত্র উদ্ধারও এ কয়েক দিনে। যদিও তিন পুলিশ সদস্য ইটের আঘাতে আহত হয়েছিলেন। 

এছাড়া, যানবাহনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে শিল্প গ্রুপ এস আলমের মালিকানায় নির্মাণাধীন এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রধান সমন্বয়ক ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে ২২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় এক হাজার ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেছেন, শ্রমিক ও বহিরাগতরা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ১৫ কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করেছে। মামলায় বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার নাম উল্লেখ আছে।  

লুটপাট করতেই বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা-অগ্নিসংযোগ!

পুলিশের গুলিতে শ্রমিক নিহতের বিষয়ে ঘটনার দিন রাতে সিভয়েসের প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, ‘দেখুন একটা ঘটনা ঘটে গেলে শ্রমিকরা তাদের সুবিধামত কত কথা বলবে। পুলিশ কখনো ইচ্ছা করে গুলি করে না। পুলিশ সব সময় আত্মরক্ষার মুডে থাকে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে পুলিশকেই আক্রমণ করে শ্রমিকরা। পুলিশও জানমাল রক্ষার্থে তাদের থামাতে গেলে গুলি করতে বাধ্য হয়।’ 

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘এ ঘটনায় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। দুটি মামলাও হচ্ছে। তদন্তে সব উঠে আসবে। এছাড়া সেখানে প্রায় সাড়ে ৮ শতাধিক চীনা নাগরিক কাজ করছে। তাদের কেউ যদি কোনও অঘটনের শিকার হতো তখন কি জবাব দিতাম আমরা চীনকে? পুলিশ সামগ্রিক বিষয় মাথায় নিয়েই আত্মরক্ষার্থে গুলি করে উত্তেজিত শ্রমিকদের নিবৃত্ত করেছে। হয়তো তখন পাঁচজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।’ 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়