Cvoice24.com

ঘর থেকে তুলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়, রাঙ্গুনিয়ার ত্রাস সালাম গ্রেপ্তার

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৪:৪২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
ঘর থেকে তুলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়, রাঙ্গুনিয়ার ত্রাস সালাম গ্রেপ্তার

প্রথমে টার্গেট করে, তারপর সংঘবদ্ধ হয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়ে টার্গেট করা ব্যক্তির ঘরে। চেয়ে বসে চাঁদা। সেই চাঁদার পরিমাণ শত কিংবা হাজার টাকা নয়, লাখ থেকে শুরু করে কোটি টাকা। তাৎক্ষণিক দিতে না পারলে সময় বেধে দেয়া হয়, সময়ের মধ্যে দিতে না পারলে দিন দুপুরে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় গভীর জঙ্গলে। আত্মীয় স্বজনের কাছে মুক্তিপণ চেয়ে শুরু করে নির্যাতন। মুক্তিপণ আদায় করেই ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে এসব ঘটনা কাউকে না বলতে দেওয়া প্রাণনাশের হুমকি।

সর্বশেষ গত ১৪ সেপ্টেম্বর অপহরণের ৬৩ ঘণ্টা পর পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে উদ্ধার হওয়া নুরুল আলমের ভাইয়ের করা মামলায় ওই সন্ত্রাসী দলের মূল হোতা আব্দুস সালাম ওরফে হাত কাটা সালামকে (৬০) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সকালে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মীরেরখীল পাহাড়ি এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে চন্দ্রঘোনা থানা পুলিশ। তিনি ওই এলাকার নজির আহমদের ছেলে। সরফভাটার ত্রাস এই হাত কাটা সালামকে সন্ত্রসীদের নেতৃত্ব দেয়ার নেপথ্যের নায়ক হওয়ায় এলাকায় ‘বাবা’ হিসেবেও পরিচিত। 

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নে দাপিয়ে বেড়ানো সংঘবদ্ধ স্থানীয় এই সন্ত্রাসীরা সালামের পরিকল্পনায় চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ থেকে শুরু করে হত্যাও করে ফেলে।

জানা গেছে, গত ১০ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ১টার দিকে ১০ থেকে ১২ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসীর অস্ত্রের মুখে চন্দ্রঘোনা থানার ধলিয়া মুসলিম পাড়ার ‘মিম কৃষিজীবী খামারে’ ঢুকে নুরুল আলমকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। গত ১৪ সেপ্টেম্বর অপহরণের ৬৩ ঘণ্টা পর পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে উদ্ধার হয়েছিল নুরুল আলম। নুরুল আলমের বাড়ি রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নে।

চন্দ্রঘোনা থানা পুলিশ জানায়, গত ১৮ দিন আগে আব্দুস সালামসহ আরও বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী মিলে রাউজান উপজেলার বাসিন্দা নুরুল আলমকে (৩৫) অপহরণ করে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেয়। ঘটনার নেপথ্য নায়ক ছিল গ্রেপ্তার আব্দুস সালাম। গ্রেপ্তার আব্দুস সালাম এলাকায় ‘বাবা’ নামে পরিচিত। তার পরিকল্পনায় সংঘবদ্ধ স্থানীয় একটি সন্ত্রাসী চক্র নুরুল আলমকে তার খামার বাড়ি থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে ১ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। পরে মোটা অংকের মুক্তিপণের বিনিময়ে রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি এলাকা থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়।

এ ঘটনায় নুরুল আলমের ভাই মো. কুতুব উদ্দিন গত ১২ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে অজ্ঞাতনামা ১০ থেকে ১২ জন সন্ত্রাসীকে আসামি করে চন্দ্রঘোনা থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় উল্লেখ করা হয়, রাঙ্গুনিয়ার দাগি সন্ত্রাসী একাধিক ডাকাতি, অপহরণ ও অস্ত্র মামলার আসামি এমদাদ এ ঘটনায় জড়িত। এমদাদ পদুয়ার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের জয়নগর গ্রামের আব্দুল নবীর ছেলে। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

চন্দ্রঘোনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, ‘গ্রেপ্তার আব্দুস সালাম অপহরণ ঘটনার মূল নায়ক। তার মাধ্যমেই মুক্তিপণ হিসেবে মোটা অংকের টাকা নিয়ে ছাড়া হয়েছে অপহৃত নুরুল আলমকে। তার অনেক বড় সন্ত্রাসী বাহিনী রয়েছে। তাকে আজ (বুধবার) আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।’ ঘটনায় জড়িত চক্রের অন্যান্য সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার অভিযান চলছে বলে জানান ওসি ইকবাল।

এদিকে আব্দুস সালামকে গ্রেপ্তারের খবরে এলাকার মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করছে। তার বিরুদ্ধে এলাকায় খুন, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, অপহরণ এমনকি কোরবানির সময় একাধিক গরু, ছাগল ও মহিষ চুরিরও অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে সরফভাটা ইউপি চেয়ারম্যান শেখ ফরিদ উদ্দিন চৌধুরীকে বারবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটায় ওসমান বাহিনীর ওসমান ২০১৯ সালে প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহতের পর তোফায়েল বাহিনী নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এরই মধ্যে গত ১০ এপ্রিল মো. মফিজ নামে আরেকজন প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হওয়ার পর থেকে এলাকায় ওই তোফায়েল বাহিনীর আধিপত্য বিস্তার করে। এতে এলাকার মানুষের ঘুম হারাম হয়ে যায়। গ্রেপ্তার আসামি সালাম-তোফায়েল বাহিনী দিন-দুপুরে চাঁদাবাজি, খামারের গরু, মহিষ ও ছাগল চুরি থেকে সব ধরনের লুটপাট শুরু করে। এমনকি তাদের ভয়ে অনেকে এলাকা ছেড়ে চলেও গেছে বলেও জানা গেছে। শুধু তাদের পরিকল্পনায় অনেক হত্যা অভিযোগও রয়েছে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, একেকদিন একেক পরিবারকে লাখ-পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে এই সন্ত্রাসীরা। এমনকি দিতে না পারলে তুলে নিয়ে দুর্গম পাহাড়ে বেঁধে মারধর করার অভিযোগও রয়েছে। এই মারধরের বিষয়ে কাউকে কিছু বললে মেরে ফেলারও হুমকি দেয় এই সন্ত্রাসী বাহিনী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার একজন বলেন, ‘মীরেরখীল গ্রাম নয় শুধু পুরো সরফভাটার মানুষ রাতে ভয়ে ঘুমাতে পারে না। কারণ, কখন কিভাবে কার ঘরে ঢুকে কি দাবি বসে— সেই ভয়ে থাকে সবাই। অনেকের কাছে দুই লাখ-পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে বসে। আর তা যে কোনভাবে ব্যবস্থা করতে হয়। যদি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবস্থা করতে না পারে তাহলে বাড়িতে এসে নানা হুমকি-ধমকি দেয়, এমনকি মারধরও করে। প্রাণের ভয়ে এসব ঘটনা কাউকে জানায় না, থানা গিয়েও কোন অভিযোগ করে না কেউ।’

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, ‘মানুষ ভয়ে-আতঙ্কে থাকলেও জনপ্রতিনিধিরা কোন পদক্ষেপ নেন না কিংবা দেখেও না দেখার ভান করে থাকে, যদিও তারা সবই জানেন। বলতে গেলে, এটা মগের মুল্লুক হয়ে গেছে। যখন যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে অথচ জনপ্রতিনিধিরা নিশ্চুপ। মানুষ ভোট দিয়ে এই জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন করেছে কেন তাহলে, যদি জনগণের নিরাপত্তা দিতে না পারে? এভাবে চুপ থাকলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?’

বিশেষ সূত্রে জানা যায়, এলাকায় দিন-দুপুরে দাপিয়ে বেড়ায় এই সন্ত্রাসী দল। তাদের মধ্যে সবাই স্থানীয় বলে জানা গেছে। তবে স্থানীয় প্রভাবশালী যুব নেতাদের আশ্রয় পশ্রয়ে এরা এসব করতে সাহস পায়, এমনকি আদায়কৃত চাঁদার একটি অংশ এসব নেতাদের দেয়া পকেটে যায় বলে জানায় ওই সূত্র।

এর আগে গত ২৯ জুলাই সরফভাটায় উকিল আহমদ হত্যা মামলার পলাতক আসামি ইউনুসকে আদালতের পরোয়ানামূলে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সোপর্দ করা হলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

জানা যায়, সন্ত্রাসী ইউনুস ২০১৬ সালের ১ মার্চ সকালে রাঙ্গুনিয়ার জঙ্গল সরফভাটার কালিছড়ি এলাকায় নিজেদের সেগুন বাগানে অবস্থান করছিলেন পশ্চিম সরফভাটা গঞ্জম আলী সরকার বাড়ির আবুল কালামের পুত্র উকিল আহমদ (৫৫) ও তার ছেলে মো. ইসমাইল (১৬)। স্থানীয় মো. আলীকে বিক্রির গাছ দেখাতেই তারা সেখানে যান। সেখানে আগে থেকে ওঁত পেতে থাকা ১০-১৫ জন দুর্বৃত্ত অতর্কিতভাবে ধারালো কিরিচ ও দা নিয়ে বাবা-ছেলের উপর হামলা চালায়। সন্ত্রাসীরা বৃদ্ধ উকিল আহমদকে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে ঘটনাস্থলেই হত্যা করেন। 

এরপর ধাওয়া করে নিহতের ছেলে মো. ইসমাইলকে কুপিয়ে ডান পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তার একটি হাতও প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ঘটনায় উকিল আহমদের স্ত্রী মমতাজ বেগম বাদী হয়ে ইউনুসসহ ২৪ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়