Cvoice24.com

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে হালদার মা মাছের ভবিষ্যৎ! 

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৪:৫১, ১১ জুন ২০২২
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে হালদার মা মাছের ভবিষ্যৎ! 

ডিম ছাড়তে মা মাছ বজ্রপাত আর বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে হালদা নদীতে।

দেশীয় কার্প জাতের মাছের অন্যতম  প্রাকৃতিক প্রজননকেন্দ্র হালদা নদী। ডিম ছাড়তে মা মাছ বজ্রপাত আর বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে এখানে।

এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুন মাসের যেকোনো পূর্ণিমা ও অমাবস্যার কয়েক দিন আগে ও পরে জোয়ার ও ভাটার সময়ে মা মাছ হালদা নদীতে ডিম ছাড়ে। তবে এবার হালদায় মা মাছের ডিম ছাড়ার নির্ধারিত জো (প্রজনন মৌসুম) শেষের পথে। অথচ এখনো পর্যন্ত পুরোদমে ডিম ছাড়তে পারেনি মা মাছ। যদিও নদী পরিবেশ নিরাপদ থাকায় এ বছর ডিম সংগ্রহ বাড়ার সম্ভাবনা দেখেছিলেন গবেষকরা। কিন্তু পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলের অভাবে এখনো পর্যন্ত পুরোদমে ডিম ছাড়েনি মা মাছ। 

যদিও মে মাসের ১৪ তারিখ যতসামান্য বজ্রবৃষ্টি হওয়ায় একদফা নমুনা ডিমের চেয়ে কিছুটা বেশি ডিম পাওয়া যায়। কিন্তু এ বছর প্রজনন মৌসুমের শেষ পর্যন্ত প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যতা বজায় না থাকলে অর্থাৎ পর্যাপ্ত পরিমাণে বজ্রসহ বৃষ্টি না হলে হালদায় কার্পজাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ) মা মাছের ডিম না ছাড়ার নজির তৈরি হতে পারে বলে ধারণা গবেষকদের। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে হালদার মা মাছ।

এদিকে, এপ্রিলের শেষদিকে বৃষ্টি হবার কথা ছিল। সেসময় বৃষ্টি হলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না। পরবর্তীতে আরও তিনটি জো চলে যায় কিন্তু তখনও বৃষ্টি হয়নি। বর্তমানে ১০ জুন থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত আরও একটি জো চলছে। শনিবার (১১ জুন) এ জো এর দ্বিতীয় দিন। অথচ এখনো পর্যন্ত বৃষ্টির দেখা নেই। পরবর্তী ২৬ জুন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে শেষ জো'তেও যদি পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হয় তবে মা মাছ আর ডিম ছাড়ার সুযোগ পাবে না।

এ বিষয়ে হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া সিভয়েসকে বলেন, 'আমার ২২ বছরের অভিজ্ঞতায় কখনো জুন মাসের জো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। যদি এ জো'তেও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হয় তাহলে ডিম ছাড়তে না পেরে মাছের বডিতে ডিম অ্যাবজার্ভ হয়ে যাবে। জুন পর্যন্ত যে এখনো পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়নি এটা নজিরবিহীন ঘটনা। এটাই প্রথমবারের মতো ঘটনা। প্রতি বছর এসব নিয়ে তো আমরা পর্যালোচনা-বিশ্লেষণ করি। ২২ বছরের মধ্যে এ প্রথমবার দেখলাম জুনের অর্ধেক চলে যাচ্ছে এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়নি, পাহাড়ি ঢল নামেনি।' 

বৃষ্টিপাতের অভাবে দেশীয় মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'শুধু হালদার মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে তাই না, আমাদের যে দেশীয় মাছগুলো আছে সেগুলো ব্রিডিং করার মতন বিল গুলোতে এখন পানিও হয়নি। যে কারণে শুধু হালদা নদীর মাছই নয় আমাদের খাল-বিলের দেশীয় মাছগুলোর প্রজননেও ব্যাহত হচ্ছে।' 

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাছের প্রজনন ব্যাহত হয়েছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'কম বৃষ্টিপাত এটা অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই হয়েছে। এখন মাছগুলো যদি প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের এডাপটেশন করতে পারে তবে পজিটিভ রেজাল্ট পাওয়া যেতে পারে। এখন হালদা নদীর পরিবেশ ভালো এবং মা মাছের আনাগোনাও আছে। শেষ জো পর্যন্ত বৃষ্টির দেখা না পেলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে হালদার মা মাছ।'

অন্যদিকে, হালদার পানির গুণগত মান ও অন্যান্য প্যারামিটার আদর্শমানের ভেতরে থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র প্রাকৃতিক বিপর্যয় অর্থাৎ পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল না হওয়ার কারণে হালদায় মা মাছ ডিম ছাড়তে পারছে না। গতবছরও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে হালদায় ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল তলানিতে। এর কারণ হিসেবে গবেষকরা বলেছেন, দীর্ঘ সময় থেকে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকা এবং ঘূর্ণিঝড় ইয়াস পরবর্তীতে স্বাভাবিকের চেয়ে নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়াই ডিম কম পাওয়ার মূল কারণ ছিল।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্যানুসারে, ২০২১ সালে হালদায় ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল সাড়ে ছয় হাজার কেজি। ২০২০ সালে ছিল ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি। যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংগ্রহকৃত ডিম। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে হালদায় ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল সাত হাজার কেজি। তবে, ২০২০ সালের হালদা নদীতে ডিম সংগ্রহের প্রকৃত তথ্য নিয়ে গরমিলের অভিযোগও পাওয়া যায়। 

কিন্তু সব মিলিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তনে বা ঋতু পরিবর্তনসহ নানা কারণে হালদা নদীতে মা মাছের ডিম ছাড়ার স্থান কমে যাচ্ছে। গত বিশ বছরেও যেখানে প্রায় বার থেকে পনেরটি ডিম ছাড়ার স্থান ছিল তা বর্তমানে চার থেকে পাঁচটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। আবার প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিনিয়ত ভাসান জাল কিংবা ঘেরা জাল বসিয়ে অহরহ মা মাছ নিধন করা হচ্ছে। যদিও প্রশাসন নিয়মিত অভিযান বা নজরদারিতে রাখছে। কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশ অনূকুলে না থাকায় অনেক সময় মা মাছ ডিম না ছেড়ে তার পেটেই রেখে দেয় আর এতে দূরদূরান্ত থেকে ডিম ছাড়তে আসা মা মাছ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তবে গতবারের মতো এ বছরেও নদীর পরিবেশ নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে আর এ কারণে প্রচুর মা মাছের বিচরণ রয়েছে হালদায়।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়