জবাই করে খুন করা হয়েছিল রাউজানের হৃদয়কে
নিজস্ব প্রতিবেদক
পুরনো ঝগড়ার প্রতিশোধ নিতেই জবাই করে খুন, মাংস কেটে লাশ গুম করার মুক্তিপণ নেওয়ার নৃশংস সব বর্ণনা উঠে এসেছে হত্যায় অভিযুক্ত আরও দুই আসামিকে গ্রেপ্তারের পর। রাউজানের কিশোর হৃদয় (১৯) হত্যা মামলায় জবাইকারী উচিংথোয়াই মারমা (২৩) এবং তার অন্যতম সহযোগী ক্যাসাই অং চৌধুরীকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৭)। আসামিদের জবানবন্দি তুলে ধরে র্যাব বলছে, এ হত্যায় উমংচিং মারমাসহ অন্তত ৯-১০ জন সহযোগী অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে র্যাব ২জন ও পুলিশ ৫ জনসহ মোট ৭ আসামিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে এবং অবশিষ্ট আসামিদের গ্রেফতারের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর আগে পাহাড়িরা হৃদয়কে খুন করে খেয়ে ফেলেছে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। এমন বীভৎস হত্যাকাণ্ডে এলাকায় এখনও শোকের ছায়া এলাকায়।
গতকাল শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে অভিযান চালিয়ে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে উচিংথোয়াই মারমাকে (২৩) গ্রেপ্তারের পর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিকেল ৫টার দিকে আসামি ক্যাসাই অং চৌধুরীকে (৩৬) নতুন ব্রিজ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। গ্রেপ্তারকৃতরা খুনের বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দি দিয়েছে বলে দাবি করছে র্যাব।
এ দুই আসামির বয়ানে উঠে এসেছে কদলপুরের হৃদয়কে খুনের কারণ, খুনের বর্ণনা ও লাশ গুমের ভয়ংকর বর্ণনা।
অপহরণ: কিশোর হৃদয় মুরগীর খামারটির ব্যবস্থাপনার কাজ করত। তাদের মধ্যে কিছু বিষয়ে মনোমালিন্য হলে খামারের মালিক তা মীমাংসা করে দেয়। উমংচিং মারমা ও অংথুইমং মারমা হৃদয়কে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনায় অংশ নেয় আরও সদস্য। গত ২৮ আগস্ট উমংচিং রাত ১০টায় একটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে কদলপুর এলাকায় মাজার গেটে এসে উমংচিং মারমা ফোন করে হৃদয়কে রাস্তায় আসতে বলে। তার কথায় হৃদয় রাস্তায় এলে উমংচিং মারমাসহ অন্যরা তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে গামছা দিয়ে মুখ বেঁধে হৃদয়কে আগে থেকে ঠিক করে রাখা পূর্ব নির্ধারিত রাউজানের একটি উঁচু পাহাড়ের সেগুন বাগান এলাকায় নিয়ে যায়।
মুক্তিপণ: গত ২৮ আগস্ট হৃদয়কে অপহরণের পর বেঁধে রেখে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে। ৩০ তারিখে হৃদয়ের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হয় মুক্তিপণ চেয়ে। ২৯ আগস্ট রাতে হৃদয়কে জবাই করে হত্যার পর ফিরে এসে উমংচিং মারমা তার বন্ধু উচিংথোয়াই মারমার মোবাইলে সিমকার্ড ঢুকিয়ে মুক্তিপণের টাকা চেয়ে হৃদয়ের বাবাকে ফোন দেয়। এরপর ১ সেপ্টেম্বর অপহরণকারী কথা অনুসারে বান্দরবানে গিয়ে উচিংথোয়াই মারমাকে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দেন। আসামি উচিংথোয়াই মারমা দেড় লাখ একাই নেয় ও বাকী ৫০ হাজার টাকা অন্যদের ভাগ করে দেয়।
হত্যা: অপহরণের পর হৃদয়কে ওই পাহাড়ের সেগুন বাগানে নিয়ে যায়ার পর উচিংথোয়াই মারমা ও ক্যাসাই অং চৌধুরী আগে থেকেই উপস্থিত থাকে। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী উমংচিং মারমা হৃদয়কে হত্যার দায়িত্ব দেয়। উচিংথোয়াই মারমা নিজ হাতে ধারালো ছুরি দিয়ে জবাই করে হৃদয়ের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং ক্যাসাই অং চৌধুরীসহ অন্য আসামিরা হৃদয়ের হাত-পা ও মুখ চেপে ধরে জবাই করতে সহযোগিতা করে।
লাশ গুম: জবাইয়ের পর হৃদয়ের লাশ প্রথমে পাহাড়ের চূড়ায় কলাপাতা দিয়ে ঢেকে রেখে দেয়। পরবর্তীতে আসামি উচিংথোয়াই মারমাসহ অন্য খুনিরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে বাঁচতে হত্যাকাণ্ডের আলামত ধ্বংস করার জন্য হৃদয়ের লাশের শরীর থেকে মাংস কেটে আলাদা করে ফেলে দেয় এবং হাড়গোড় গহীন পাহাড়ের জঙ্গলে ছিটিয়ে রেখে চলে আসে।
গ্রেফতারকৃত সুইচিংমং ও অংথুইমং ও উমংচিং মারমার নেতৃত্বে অপহরণ, হত্যা, আলামত ধ্বংস করার জন্য লাশগুম এবং মুক্তিপণ আদায় করে মর্মে চট্টগ্রামের বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর ৩য় আদালতে স্বীকারোক্তি প্রদান করে। উল্লেখিত ঘটনাটি প্রাথমিকভাবে অপহরণ মামলা হিসেবে চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানায় রুজু করা হয়। পরবর্তীতে আদালতে দেয়া জবানবন্দি অনুসারে হৃদয়কে হত্যার বিষয়টি উদঘাটিত হলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক অপহরণ মামলার ধারার সাথে হত্যা মামলার ধারা সংযোজন করার জন্য বিজ্ঞ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, চট্টগ্রাম বরাবর আবেদন করেন।
সাক্ষীদের সামনে গ্রেফতারকৃত উচিংথোয়াই মারমা স্বীকার করে যে, সে নিজ হাতে ধারালো ছুরি দিয়ে হৃদয়কে জবাই করে শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে এবং অপর আসামী ক্যাসাই অং চৌধুরী হৃদয়ের দুই পা চেপে ধরে জবাই করতে সহযোগীতা করে। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে তাদের সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছে র্যাব।