Cvoice24.com

আমন্ত্রিত অতিথিদের আতঙ্ক কাটেনি এখনো
বিয়ের অনুষ্ঠানে ‘বেনজিরকাণ্ড’, কীসের ইঙ্গিত

সিভয়েস২৪ প্রতিবেদক
১৩:৩৬, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
বিয়ের অনুষ্ঠানে ‘বেনজিরকাণ্ড’, কীসের ইঙ্গিত

সাজ সাজ রব, আনন্দময় পরিবেশ— সবই ছিল বিয়ের অনুষ্ঠানে। হঠাৎ বাইরে শোরগোল মিছিল-স্লোগান। অনুষ্ঠানে ঢুকে বরের বাবাকে মারধরের পর পুলিশে সোপর্দ। আতঙ্কে অতিথি নারী-শিশু-বয়স্কদের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি এমনকি পালিয়ে বাথরুমে আশ্রয়। অনুষ্ঠান পণ্ডের প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর আমন্ত্রিত অতিথিরা ছাড়া পেলেন ভোররাতে। 

শনিবার রাতে চট্টগ্রামের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপিদের ‘ধরতে’ এসে এমনই নজিরবিহীন কাণ্ড ঘটানো হয়েছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা’ পরিচয়ে।

প্রশ্ন উঠেছে, সামাজিক অনুষ্ঠানে যদি কোনো  ‘অপরাধী’ অংশ নেয় তাদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া যায়। তবে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সামাজিক অনুষ্ঠানে ‘অসামাজিককাণ্ড’ কতটা যৌক্তিক!

অবশ্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্তরা বলছেন, জুলাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত আওয়ামী নেতাকর্মীদের কোনো ছাড় নেই। আওয়ামী লীগের নেতারা স্বাধীনভাবে সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন, চলাফেরা করবেন—ছাত্র-জনতা তা মেনে নেবে না। তাই পুলিশকে খবর দিয়ে ওই কনভেনশন সেন্টার ঘেরাও করেন তারা।

মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলছেন, ‘ব্যক্তিগত শত্রুতা হাসিল করতে ভবিষ্যতেও সামাজিক অনুষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর আশঙ্কা তৈরি হলো। নতুন জীবনের শুরুতেই এমন ঘটনা বর-কনের পরিবার আর তাদের ব্যক্তিগত জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

ঘটনাটি মর্মান্তিক উল্লেখ করে অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আরো বলেন,‘ বর কনের জীবনের জন্য এটি খুবই দুঃখজনক ঘটনা। বিয়ের আয়োজন যারা করেছেন তাদের পরিবারের জন্যও এটি মর্মান্তিক ঘটনা। ভবিষ্যতে অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কারো সাথে শত্রুতা থাকলে যাচাই বাছাই ছাড়া এরকম ঘটনা হতে পারে। যেখানে অনেক রাঘব বোয়ালরা জাল থেকে চলে গেছে, সেখানে চুনোপুটিদের নিয়ে এভাবে করার মানে হয় না। এক্ষেত্রে অনুষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য বর-কনের পরিবার চাইলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।’

যদিও আইনের দ্বারস্থ না হওয়ার কথা জানিয়েছেন কনের দাদা সাবেক সিটি মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম।

যা হয়েছিল বিয়ের অনুষ্ঠানে

শনিবার (২ ফেব্রুয়ারি) রাতে চট্টগ্রাম নগরের টাইগারপাস এলাকার নেভি কনভেনশন হলে সাবেক চসিক মেয়র মনজুর আলমের ছেলের ঘরের নাতনি সৈয়দা মাহবুবা হোসনে আরার সঙ্গে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক ফখরুল আনোয়ারের ছেলে সৈয়দ মিনহাজুল আনোয়ারের বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বর্তমান চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনও। 

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানান, রাত ৯টার দিকে হঠাৎ করেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শতাধিক যুবক কমিউনিটি সেন্টারের বাইরে জড়ো হন। তারা এ সময় ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’—ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন। তারা ফখরুল আনোয়ারকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে ফখরুল আনোয়ারকে আটক করে। সাবেক মেয়র মনজুর আলম নাতনির বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও ঘটনার কোনো এক ফাঁকে কনভেনশন সেন্টার দ্রুত ত্যাগ করেন বলে জানা গেছে। 

নজিবুল-সনির খোঁজে আগতরা, নৌ-বাহিনীর ‘অ্যাকশন’

আওয়ামী লীগ নেতা ফখরুলকে আটকের আগেই খবর ছড়িয়ে পড়ে, ওই কমিউনিটি সেন্টারে সাবেক এমপি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী এবং খাদিজাতুল আনোয়ার সনিসহ বিপুলসংখ্যক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী রয়েছেন। তাদের খোঁজে নেভি কনভেনশনে প্রবেশের চেষ্টা করে কয়েকজন যুবক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে, লাঠি এবং রড হাতে তাদের মারধর করেন সেখানে দায়িত্বরতরা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতারা অভিযোগ করেছেন—কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে নজিবুল বশর ও সনিকে খুঁজতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের কয়েকজনকে লাঠি-রড হাতে মারধর করেছেন দায়িত্বরতরা। তাদের দাবি—কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠানে ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য নজিবুল বশর ও খাদিজাতুল আনোয়ার সনি। তাদের ‘সেইফ এক্সিট’ দিয়েছে ওরা। 

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মুহাম্মদ ফয়সাল আহম্মেদ অবশ্য সিভয়েস২৪’কে বলেছিলেন, ‘সাবেক সংসদ সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনি আছেন—এমনটা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু তিনি সেখানে ছিলেন না।’

অতিথিদের হেনস্তার অভিযোগ, রাতভর আটকে বিক্ষোভ

বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী অভিযোগ করে বলেছেন, বিয়ের অনুষ্ঠানে ওই দুজনের কেউ ছিলেন না। তবে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে অধিকাংশ সটকে পড়েন। কিছু যুবক ঢুকে পড়ে পাত্রের বাবা ফখরুল আনোয়ারকে লাঞ্ছিত করেন। অতিথিদেরও কাউকে কাউকে অপদস্থ করেছেন। এ সময় অনেক নারী অতিথির পরিহিত স্বর্ণালঙ্কারও ছিনতাই হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাত ১১টা নাগাদ এসব খবর ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাসহ হাজার হাজার ছাত্র-জনতা নেভি কনভেনশন হলের বাইরে জড়ো হয়। কমিউনিটি সেন্টারে প্রবেশ এবং বহির্গমনের দুটি পথ এ সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাইরে শিক্ষার্থীদের মারধরের প্রতিবাদে তারা নানা রকম স্লোগান দেন।

আতঙ্কে বাথরুমে লুকিয়ে ছিলেন নারী-শিশু-বয়স্করা

বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া একজন জানিয়েছেন, কমিউনিটি সেন্টারটিতে শনিবার রাতে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিলো। হঠাৎ ছাত্র-জনতার স্লোগান এবং হট্টগোলে ভেতরে নারী-শিশু-বয়স্কদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেক নারী-পুরুষ ভয়ে কমিউনিটি সেন্টারের বাথরুমে শিশুকে নিয়ে লুকিয়ে ছিলেন। বাইরে ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানে আসা অতিথিরা ভেতরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তবে দায়িত্বরতদের তৎপরতায় ভেতরে আগতদের কেউ প্রবেশ করতে পারেনি।

এদিকে ঘটনার পরপরই সেখানে ছুটে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ। তিনি উপস্থিত ন-বাহিনী সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং জানান, রাতের মধ্যেই যৌথবাহিনী গঠন করে অভিযান পরিচালনা করে নজিবুল বশর এবং সনিকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে হবে। না হয় তারা সেখানেই রাতভর অবস্থান করবেন। 

লাঠিসোঁটা হাতে বাইরে কারা?

ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা এক সংবাদকর্মী জানিয়েছেন, সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ, রিজাউর রহমানসহ কয়েকজন কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে ঢুকে দফায় দফায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বৈঠক করে। ওই সময় বাইরে হাজারও ছাত্র-জনতা নগরের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসে। টাইগারপাস এলাকায় লাঠিসোঁটা হাতে কিছু যুবক ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দিচ্ছিলেন। মধ্যরাতে ওই সড়ক দিয়ে আসা-যাওয়া করা যানবাহনেও তল্লাশি চালায় তারা। এতে টাইগারপাস এলাকায় গাড়ি চলাচল প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। 

ভোররাতে পরিস্থিতি ‘ঠান্ডা’, কড়া পাহারায় বের হন অতিথিরা

প্রত্যক্ষদর্শী ওই সংবাদকর্মী জানান, ভোরের দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বৈঠকের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে চার দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। এ সময় সেখানে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এরপর কড়া নিরাপত্তায় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের গাড়িগুলো চেক করে তাদের বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। একে একে ভেতরে আটকা পড়া সবগুলো গাড়ি বেরোনোর পর আস্তে আস্তে ওই এলাকা খালি হয়ে যায়।

চার দাবি না মানলে ফের ‘অ্যাকশনের’ হুঁশিয়ারি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ তার ফেসবুক পোস্টে চার দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো—সাবেক সংসদ সদস্য নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী এবং সনিকে গ্রেপ্তারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে তা নিশ্চিত করতে হবে, নৌবাহিনী কর্তৃক হামলায় আহত ছাত্রদের চিকিৎসার ব্যয়ভার নৌ কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে, ছাত্রদের হামলায় জড়িত নৌ সদস্যদের বরখাস্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে এবং নেভি কনভেনশনে প্রোগ্রাম উপলক্ষে টাইগারপাসে সৃষ্ট ট্রাফিক জ্যাম দূর করতে হবে। 

এ প্রসঙ্গে জানতে রাসেল আহমেদের মুঠোফোনে রবিবার একাধিকবার ফোন এবং ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, তাদের দাবিগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন না করলে ছাত্রসমাজ কঠোর অবস্থানে যাবে।

কারাগারে বরের বাবা

ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে আটক আওয়ামী লীগ নেতা ফখরুল আনোয়ারকে (৫৮) হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।

রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রামের ৬ষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরিফুল ইসলাম শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।

সিভয়েস২৪/