Cvoice24.com

মাত্র ৬ দিন আগে সদলবলে পদত্যাগ করলেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা
নজিরবিহীন দ্বন্দ্ব, জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন হচ্ছে না

রবিউল রবি, সিভয়েস২৪
১৮:৩০, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
নজিরবিহীন দ্বন্দ্ব, জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন হচ্ছে না

চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের বাকি ৬ দিন। এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন মুখ্য নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ সকল কর্মকর্তা। ফলে, আইনজীবী সমিতির নির্বাচন আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। মূলত আওয়ামী এবং বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা। এদিকে এমন পরিস্থিতিতে আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি সাধারণ সভায় অ্যাডহক কমিটি গঠনের পথে হাঁটছে সমিতি।  

মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বরাবর চিঠি দিয়ে এ তথ্য জানান নির্বাচনী কর্মকর্তারা। চিঠিতে মুখ্য নির্বাচনী কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সোলায়মান, নির্বাচনী কর্মকর্তা উত্তম কুমার দত্ত, তারিক আহমদ, সাম্যশ্রী বড়ুয়া এবং মো. নুরুদ্দিন আরিফ চোধুরীর স্বাক্ষর রয়েছে।

ওই পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করা হয়, গত ১৪ জানুয়ারি সমিতির গঠনতন্ত্রের বিধানমতে সমিতির নির্বাচনে সুষ্ঠ, সুন্দর ও নিরপেক্ষতার সহিত দায়িত্ব পালনের জন্য আমাদের মনোনীত করা হয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচনী কর্মকর্তারা প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত এবং ব্যালট পেপার ছাপানো সহ নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতি নির্বাচনের অনুকূলে না থাকা স্বত্বেও আমরা অত্যন্ত আশাবাদী এবং উৎসাহ নিয়ে আমাদের অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলাম। 

পদত্যাগপত্রে বলা হয়, আজ (মঙ্গলবার) আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োগের প্রস্তাব করে একটি দরখাস্ত দেয়। অপরদিকে ঐক্য পরিষদ বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সমর্থক আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের মনোনয়ন বাতিলের জন্য আবেদন করেন। দুটি আবেদনই সমিতির গঠনতন্ত্র বর্হিভূত। তাছাড়া নির্বাচন কমিশন চায় না সমিতির কোন সদস্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হেনস্তার শিকার হোক।

আরও বলা হয়, উভয়পক্ষের পারস্পরিক অবস্থান নির্বাচনের প্রতিকূলে হওয়ায় এবং নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে বিভিন্নভাবে হেনস্তা, ভয়ভীতি ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এমতাবস্থায়, আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন সুষ্ঠ পরিবেশে সম্পন্ন করার কোন সুযোগ বা পরিবেশ না থাকায় নির্বাচন কমিশন সর্বসম্মতভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে অপরাগতা প্রকাশ করে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

পদত্যাগ করার বিষয়টি নিশ্চিত করলেও মূখ্য নির্বাচনী কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সোলায়মান সিভয়েস২৪’এর কাছে এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। 

আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। নির্বাচন উপলক্ষে গত ১৪ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যকরী কমিটি। নির্বাচনে ২১টি পদের জন্য ৪০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ছিল। ভোটাধিকার প্রয়োগের কথা ছিল মোট ৫ হাজার ৪০৪ আইনজীবীর।

জানা গেছে, বিএনপি সমর্থিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সমর্থিত বাংলাদেশ ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল যৌথভাবে আইনজীবী ঐক্য পরিষদ নামে যৌথ প্যানেল ঘোষণা করেছিল। অপরদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সমর্থিত সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ প্যানেল ঘোষণা করে প্রচারণায় নেমেছিল। তবে কৌশল করে এবার প্যানেলের নাম রাখা হয়েছিল ‘রশিদ-জাবেদ-মাহতাব পরিষদ’।

গত ২৬ জানুয়ারি  বিক্ষোভ মিছিল ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার ও যাতে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, সেই ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা।

এদিকে, সাধারণ আইনজীবীরা বলছেন, চট্টগ্রাম আদালতে আইনজীবীদের মধ্যে এমন দ্বন্দ্ব-বিভেদ ১৩০ বছরের ইতিহাসে নেই। আওয়ামী সরকার পতনের পর কোনঠাসা হয়ে পড়েন ওই পন্থি আইনজীবীরা। এরমধ্যে সম্প্রতি আদালত প্রাঙ্গণে বহিষ্কৃত ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন ঘিরে হওয়া সংঘর্ষে আসামি করা হয়েছে ৭০ জনেরও বেশি আইনজীবীকে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে একজন আইনজীবী বলেন, ‘৩২ বছর এই আদালতে প্র্যাক্টিস করি আমি। এর মধ্যে কত সরকার এলো গেল। আমাদের আইনজীবিদের মধ্যে সবসময় ভাতৃত্বের সম্পর্ক ছিল। এমনকি রাজনৈতিক বিভাজনও সেভাবে প্রভাব ফেলেনি। সবসময় একজন আইনজীবি অন্য আইনজীবিকে সহায়তা করেছে।’

আরেক আইনজীবী বলেন, ‘বর্তমান সমিতির দুই নেতাই বিএনপিপন্থী আইনজীবী। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নির্বাচনে তারা জয়ী হয়েছেন। চট্টগ্রাম আদালতে রাজনৈতিক সম্প্রীতি কেমন ছিল তার একটা ভাল উদাহরণতো এটি। এখানে রাজনৈতিকভাবেই কখনো আইনজীবীরা এভাবে মুখোমুখি হয়নি। একে অন্যের প্রতি মারমুখী হয়নি। এখন যে গোষ্ঠিগত বিভাজন এটাতো খুব বিব্রতকর। এখানে দুই পক্ষেরই দায় আছে। প্রথমত চিন্ময়ের জামিন নিয়ে এত কট্টর অবস্থানে যাওয়া সনাতনী আইনজীবীদের উচিৎ হয়নি। আবার যে আইনজীবী হত্যার শিকার হলেন এটিওতো মেনে নেওয়ার মত না। এর পর এখন যা হচ্ছে সেগুলো কেবল অস্বস্তি ছড়াচ্ছে। কাউকে ভালমন্দ বলার মত অবস্থাও নেই।’

জানতে চাইলে আইনজীবী সমিতির বর্তমান সভাপতি অ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন চৌধুরী সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘চিঠিতে লিখেছেন আইয়ামী লীগ এবং বিএনপি পন্থী আইনজীবীদের দুই পক্ষের উত্তেজনা বা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে একজন আরেকজনের মুখোমুখি। এমন পরিস্থিতে নির্বাচন পরিচালনা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যে কারণে তারা পদত্যাগ করেছেন সবাই।’

এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি আমাদের সমিতির নির্বাচন হচ্ছে না। এখন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ১১ ফেব্রুয়ারি সাধারণ সভা ডাকা হবে। সেখানে অ্যাডহক কমিটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এছাড়া আগামীকাল (বুধবার) আমাদের কমিটির মিটিং আছে। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’

বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আইনজীবী ঐক্য পরিষদ প্যানেল থেকে সভাপতি প্রার্থী হওয়া আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ–সমর্থিত সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের প্রার্থীদের কাছ থেকে নির্বাচন কর্মকর্তাদের কাছে হুমকি গিয়েছে। এছাড়া, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মী কিংবা সাধারণ আইনজীবীরা যে আওয়ামীপন্থীদের মনোয়ন বাতিলের জন্য আবেদন-সমাবেশ করেছে; তার সঙ্গে আমাদের প্রার্থীদের কোনো যোগসূত্র নেই।’

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ–সমর্থিত সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ থেকে প্যানেল ঘোষণা হয়নি দাবি করে ‘রশিদ-জাবেদ-মাহতাব পরিষদ’ প্যানেল থেকে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ফখরুদ্দিন জাবেদ সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘আইনজীবী সমিতির ১৩২ বছরের ইতিহাসে ৩২টি নির্বাচন হয়েছে। এখন পর্যন্ত সবগুলো নির্বাচন সুষ্ঠ এবং নিরপেক্ষভাবে হয়েছে। এবার বহিরাগতরা মিছিল-মিটিং করেছে। আমরা আভাস পেয়েছি বহিরাগতরা কোর্ট-টাই পড়ে নির্বাচনের দিন প্রবেশ করবে। তাই আমরা নির্বাচনের দিন আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর উপস্থিতি চেয়েছি। আর নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগের ঘটনা সমিতির ইতিহাসে এবারই প্রথম।’

নির্বাচনে নির্বাহী সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করা একজন আইনজীবী বলেন, 'চেম্বার বাদ দিয়ে গত একমাস যাবত নির্বাচনের পেছনে সময় ব্যয় করেছি। দলীয় দ্বন্দ্বের জেরে এখন নির্বাচন হবে না। কতগুলো টাকাও খরচ করেছি। সময়-অর্থ—সব এখন বৃথা যাবে।'