Cvoice24.com

সরফভাটায় রাতের আঁধারে গাছ কাটা নিয়ে জনমনে ক্ষোভ, ফেসবুকজুড়ে সমালোচনার ঝড়

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ২৪ মার্চ ২০২১
সরফভাটায় রাতের আঁধারে গাছ কাটা নিয়ে জনমনে ক্ষোভ, ফেসবুকজুড়ে সমালোচনার ঝড়

সরফভাটায় রাতের আঁধারে তিন শতাধিক গাছ কেটে দিল দুর্বিত্তরা। জনমনে ক্ষোভ, ফেসবুকজুড়ে সমালোচনার ঝড়।

‘একজন প্রতিনিধির কাজ কি? এভাবে দস্যুতামী করাকে সমর্থন করা নাকি এর সুষ্ঠু বিচার করা? এখন দেখা যাচ্ছে জনপ্রতিনিধি নিজেই বড় করে স্ট্যাটাস দিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে রসিয়ে লিখে ওই দুর্বৃত্তদের আরও উস্কে দিচ্ছেন, অন্যায়-অপরাধকে সমর্থন দিচ্ছেন।’ কিংবা ‘জনপ্রতিনিধির দেয়া ওই স্ট্যাটাস কি জনপ্রতিনিধি হিসেবে দিয়েছেন নাকি রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে দিয়েছেন নাকি ভূমিদস্যুদের সমর্থক হিসেবে দিয়েছেন?’

সম্প্রতি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নে রাতের আঁধারে তিন শতাধিক গাছ কাটাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকজুড়ে এমন অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ক্ষোভ প্রকাশ করছে এ ধরনের কাজের জন্য। মূলত স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যানের ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাস, সরাসরি ওই দুর্বৃত্তদের সমর্থন করায় তাদেরকে দায়ী করছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ। গত বৃহস্পতিবার সরফভাটার এ গাছ কাটা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে।

এর আগে শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে ২টার মধ্যে উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নে তিন শতাধিক গাছ কেটে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত বাগান মালিকদের পক্ষে মোজাহেরুল হক চৌধুরী নামে এক বাগান মালিক রাঙ্গুনিয়া থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। গাছ কাটার খবরে রাতেই ঘটনাস্থলে পুলিশ গেলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায় বলেও জানান তারা।

এদিকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নানা তর্ক-বিতর্ক, লেখালেখিসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তবে অধিকাংশ লেখালেখিতে সরফভাটার বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যানকে ইঙ্গিত করেই নানান প্রশ্ন ও অভিযোগ তুলছেন। 

‘সরফভাটায় ভূমিদস্যুদের তাণ্ডব, জনপ্রতিনিধির কলকাঠি!’ শিরোনামে লেখা একটি স্ট্যাটাসে প্রশ্ন তুলে মুহাম্মদ শাহেদ হাসান নামে একজন লিখেছেন, ‘খেলার মাঠ কি রাতে অন্ধকারে গিয়ে গাছ কেটে দখল করতে হয়? এতগুলো গাছ যদি নিজেদের হতো তাহলে তারা নিজেরাই কখনো মেনে নিতেন? দখলকারীরা কি আইনের উর্ধ্বে? সকারের উর্ধ্বে?’

জনপ্রতিনিধি দুর্বৃত্তদের ও অন্যায়-অপরাধকে সমর্থন দিয়ে আরও উস্কে দিচ্ছেন জানিয়ে তিনি লিখেন, ‘একজন প্রতিনিধি কাজ কি? এভাবে দস্যুতামী করাকে সমর্থন করা নাকি এর সুষ্ঠু বিচার করা? এখন দেখা যাচ্ছে প্রতিনিধি নিজেই বড় করে স্ট্যাটাস দিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে রসিয়ে লিখে ওই দুর্বৃত্তদের আরও উস্কে দিচ্ছেন, অন্যায়-অপরাধকে সমর্থন দিচ্ছেন। ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ করেছেন...।’

গাছ কেটে দিয়ে সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যানের আনন্দ-উল্লাস ও মিষ্টি বিতরণের কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেন, ‘দেখা গেছে, যে ভূমিদস্যুরা গাছ কেটে দিয়েছে তাদেররকে সাথে নিয়ে ওসব জনপ্রতিনিধিরা খেলার মাঠ দখলের নামে আনন্দ-উল্লাস এমনি মিষ্টি বিতরণও করছেন। আর যারা এই দস্যুতামিকে সমর্থন করছেন তারা সবাই ফেসবুকে ন্যায় কাজ করেছে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ‘আমরা শতবছরের খেলার মাঠ ১৮ বছর পর পুনরুদ্ধার হওয়ার পক্ষে’ এমনই গ্রুপিং সৃষ্টি করে যাচ্ছে। এসব কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়? তারা মাঠ চায়, নাকি মাঠ দখলের নামে ভূমি দখল করতে চায়? প্রশাসন নিরব কেন? রাঙ্গুনিয়ার অভিভাবক ড. হাছান মাহমুদ মন্ত্রী মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এই বিষয়ে।’

‘ক্রীড়া প্রেমিক নাকি ভূমিদস্যু’ শিরোনামে মোবিন বিন সোলাইমান নামে একজন লিখেছেন, ‘ক্রীড়া প্রেমিকরা কখনো ভূমিদস্যুর আচরণ করে না, রাতে অন্ধকারে তারা উন্মত্ত-মাতাল হয়ে প্রকৃতি ধ্বংস করতে পারে না। যারা ক্রীড়া প্রেমিক তারা জমির মালিকদের সাথে কথা বলে, সমঝোতার মাধ্যমে মাঠ নিতে পারতো। যেখানে প্রশাসন কোন হস্তক্ষেপ করলো না সেখানে ক্রীড়া প্রেমিকে নাম ভাঙিয়ে এই চক্রটি নিজেদেরকে কি মনে করে এই কাণ্ড ঘটালো? ক্রীড়া প্রেমিক হলে কি রাতে অন্ধকারে এভাবে গাছ কেটে ফেলতে হবে? দেশে কি কোন আইন আদালত নেই?’

ওই স্ট্যাটাসে আরও লিখেছেন, ‘আমার স্মরণকালে এমন ক্রীড়া প্রেমিক দেখিনি, যে ক্রীড়া প্রেমিকরা খেলার জন্য রাতে অন্ধকারে গিয়ে পরিবেশ নষ্ট করে গাছ কেটে ফেলতে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসছে সেই ২০০৮ সালে। এই দীর্ঘ সময়ে তারা দখল করেনি, এই দীর্ঘ সময়ে এমন উশৃঙ্খল ক্রীড়া প্রেমিকও দেখা যায়নি। বোঝাপড়ার মাধ্যমে যা করা সম্ভব ছিল, তা করছে উন্মত্ত মাতালের মতো। আর যারা এমন উন্মত্ত মাতালের মতো কাজ করে তারা ক্রীড়া প্রেমিক কেমনে হয়?’

রাঙ্গুনিয়ার সংসদস্য ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি লিখেন, ‘আশা করি, আমাদের অভিভাবক ড. হাছান মাহমুদ মন্ত্রী মহোদয় এই বিষয়টি নজরে আনবেন। আমরা চাই এই প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ হোক, বন্ধ হোক এইসব গ্রুপিং। আমাদের মাঠ যেমন প্রয়োজন, তেমনই অন্যায়ভাবে এভাবে অন্যের বাগান কেটে ফেলাও উচিৎ নয়। আমার বিশ্বাস হয় না—মন্ত্রী মহোদয় এই আচরণকে ভালো চোখে দেখবেন!’

নিন্দা জানিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক নিজাম উদ্দিন বাদশা তার ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘গভীর রাতে গাছ চুরি করতে গিয়ে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যাওয়া বীর পুরুষরা নাকি খেলার মাঠ উদ্ধারের আষাঢ়ের গল্প শোনাচ্ছে। প্রশ্ন হলো খেলার মাঠ যদি উদ্ধার করতে হয় গভীর রাতে কেন গাছ কাটতে যাবে বীরপুরুষগুলো, দিনের বেলায় কি মাঠ উদ্ধার করা যায় না। সৎ সাহস সৎ ইচ্ছে থাকলে দিনের বেলায় তা কি করা যেতো না?’ 

গাছ কেটে দেয়ার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে ওই স্ট্যাটাসে মোহাম্মদ বেলাল হোসেন নামে একজন কমেন্ট করেছেন, ‘আওয়ামীলীগ পরিবার যদি কার্যলয় করতে পারে, আস্তে আস্তে মাঠও একদিন করে দিতে পারতো। এমন আচরণের দ্বারা আওয়ামীলীগ পরিবারের বদনাম হবে। এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’ 

সাইফুল ইসলাম নামে একজন লিখেন, ‘সাধারণ মানুষের খতিয়ানভুক্ত জায়গা দখল করে খেলার মাঠ করা মানে আওয়ামী লীগকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। এটার একটা সুষ্ঠু বিচার হওয়া উচিত। তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’

মনজু ভাই নামের আরেকজন লিখেন, ‘জোর জবরদস্তি কোন কিছু আমরা চাই না, খেলার-মাঠ আমাদের দরকার আছে কিন্তু এভাবে নয়। আইনি প্রক্রিয়ায় আমরা একটি সুন্দর আনুষ্ঠানিকভাবে খেলার মাঠটি উপহার পেতে চাই। রাতের আঁধারে নয়, দিনের আলোতে আলোকিত হতে চাই।’

এছাড়া ‘জনগণের জসমত’ শিরোনমে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ৯ মিনিট ৩১ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে মো. মুবিন বিন সোলাইমান নামে একজন এলাকাবাসীর মতামত তুলে ধরেছেন। ওই ভিডিওতে এলাকাবাসী গাছ কাটাকে অন্যায় ও অপরাধ হিসেবে দেখছেন এবং এর প্রতিবাদও করছেন। তারা বলছেন, এভাবে গাছ কেটে কেন, সমঝোতার মাধ্যমে যথাযথ মূল্যায়ন করে জায়গার মালিকের সাথে কথা বলে এই মাঠ নেওয়া যায়। এভাবে অন্যের গাছ কেটে মাঠ দখল করা উচিৎ নয়।— এভাবেই দীর্ঘ ভিডিওতে প্রবার সবার বক্তব্য প্রায় একই।

এদিকে সরফভাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আহসান হাবীব গণমাধ্যকে দেয়া এক বক্তব্যে বলেন, ‘রাত ১০টার দিকে সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুল ইসলাম সরফীর ঘরে স্থানীয় ও বহিরাগতরা সংঘবদ্ধ হয়। এরপর রাত ১২টার দিকে তিনি ও বর্তমান চেয়ারম্যান শেখ ফরিদ উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রায় শতাধিক দুর্বৃত্ত দা, কিরিচ ও গাছ কাটার সরঞ্জাম নিয়ে মাঠের সবগাছ কাটা শুরু করে। বাগান মালিকরা খবর পেয়ে পুলিশে ফোন করলে রাত ২টার দিকে পুলিশ গিয়ে তাদের ধাওয়া করে। এসময় দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।’ খেলার মাঠ প্রয়োজন, তবে জায়গার মালিকদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে কারও ক্ষতি না করে মাঠ দখলমুক্ত করা যেতো বলে তিনি জানান।

নুরুল আবছার নামে এক বাগান মালিক বলেছেন, ‘সম্পূর্ণ মাঠটি ১০ কানি আয়তনের। যেখানে ৬টি খতিয়ানে ৭ হাজার ৬০০ দাগের আন্দরে একাধিক মালিক রয়েছেন। যেখানে তিনিও ৫২ শতক জায়গার মালিক। এই জায়গায় তিনি অন্যদের মতো বেলজিয়াম, একাশি, মেহগনি, ইউক্লিপটাস ও সেগুন গাছ লাগিয়েছিলেন। রাতের আঁধারে এসব গাছ কেটে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। কারা কেটেছে তিনি দেখেননি বলে জানান। তবে বর্তমান ও সাবেক দুই ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে শুনেছেন।

অন্যদিকে গণমাধ্যমকে দেয়া ইউপি চেয়ারম্যান শেখ ফরিদ উদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্য ও তার স্ট্যাটাসে দেয়া বক্তব্যে দেখা গেছে ভিন্ন সুর। দুর্বিত্তদের সমর্থন জানিয়ে তাদেরকে ক্রীড়াপ্রেমী অ্যাখ্যা দিয়ে গত ২০ মার্চ রাতে তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘শত বাধা বিপত্তির অবসান করে দিন শেষে সরফভাটার জনগণের আশা খেলার মাঠ হবেই -ইনশাআল্লাহ। ক্রীড়াপ্রেমী জনগণ এই মাঠের পরিপূর্ণতা লাভে আপনারা কাজ করে এগিয়ে যান, আপনাদের অগ্রযাত্রায় অবশ্যই পাশে থাকবো।’ যদিও তিনি রাতের আঁধারে কারা গাছ কেটেছে জানেন না দাবি করেছেন গণমাধ্যমে। 

ইউপি চেয়ারম্যান রাতের আঁধারে কারা খেলার মাঠের গাছ কেটেছে জানেন না দাবি করে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘যারা আমাকে ও সাবেক চেয়ারম্যানকে অভিযুক্ত করছেন তারা বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন। রাজনীতি খেলার মাঠের গাছ কেটে অপবাদ দিয়ে নয়, রাজপথে করা উচিৎ।’

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়