Cvoice24.com

প্রজনন মৌসুমেও হালদা নদীতে সক্রিয় মা মাছ শিকারীরা 

হাবিবুর রহমান, রাউজান

প্রকাশিত: ১৯:৩৬, ২৩ এপ্রিল ২০২১
প্রজনন মৌসুমেও হালদা নদীতে সক্রিয় মা মাছ শিকারীরা 

হালদা নদরীর পাড়ে এভাবেই ঘের জাল দিয়ে মাছ ধরা হচ্ছে।

দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর জীব-বৈচিত্র্য ও মা মাছ রক্ষায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষিত এ নদীতে স্থাপন করা হয়েছে সিসি ক্যামেরাও। তৎপর রয়েছে রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসনসহ দুই উপজেলার মৎস্য বিভাগ। এরপরও থামানো যাচ্ছে না অবৈধ জাল পেতে মাছ চুরি। প্রজননের মৌসুমে সক্রিয় হয়ে উঠেছে মা মাছ শিকারি চক্রের সদস্যরা। অভিযান চালিয়ে নদীতে পাতা অবৈধ ঘের জাল জব্দ করলেও মা মাছ শিকারি চক্রের এক সদস্য ছাড়া আর কাউকে আটক করতে পারেনি নৌ-পুলিশ কিংবা উপজেলা প্রশাসন।

এপ্রিল মাস থেকে জুন এই তিনমাস প্রজনন মৌসুম। প্রজনন মৌসুমের আটদিনে পৃথক পাঁচটি অভিযানে সাড়ে ১৪ হাজার মিটার অবৈধ ঘের জাল জব্দ ও আটক এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা।  

সূত্র মতে, গত বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত হালদায় অভিযান চালিয়ে পাঁচ হাজার মিটার নিষিদ্ধ ঘের জাল জব্দ করেন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমীন। গত মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) সকাল ১০টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন অভিযান চালিয়ে নদীর পাড় কেটে মাটি উত্তোলনে ব্যবহৃত সরঞ্জামসহ একটি ট্রাক্টর ও ২ হাজার মিটার ঘেরা জাল জব্দ করেন। গত সোমবার (১৯ এপ্রিল) হালদা নদীর মা মাছ রক্ষায় রাউজান উপজেলা প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করে। উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্টে অতীশ দর্শী চাকমার নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা ধ্বংস করা হয়। 

গত শনিবার (১৭ এপ্রিল) চট্টগ্রাম সদরঘাট নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবিএম মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে হালদা-কর্ণফুলীর মোহনা থেকে কচুখাইন পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে প্রায় ৬হাজার  মিটার অবৈধ জাল উদ্ধার করেন। এসময় তিন থানার মোহনা থেকে বোয়ালখালীর এক বাসিন্দাকে গ্রেপ্তার করে মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষন আইন-১৯৫০ (সংশোধনী ২০১৩ইং) এর ৫(১) ধারায় মামলা হয়েছে। অভিযুক ব্যক্তি বোয়ালখালী উপজেলার বাসিন্দা হওয়ায় সে থানায় মামলা হয়েছে বলে জানান ওসি এবিএম মিজানুর রহমান। গত বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) দুপুরে অভিযান চালিয়ে ১ হাজার ৫শ মিটার জাল জব্দ করে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন। 

একাধিক ডিম সংগ্রহকারী বলেন, ‘কোন ডিম সংগ্রহকারী অবৈধ জাল পেতে মা মাছ নিধন করবে না। আমরা ডিম সংগ্রহ করেই জীবিকা নির্বাহ করি। মা মাছ নিধন হলেই ডিমের পরিমাণ কমে যাবে। মাছ চুরির সঙ্গে জড়িতদের এলাকা ভিত্তিক আলাদা আলাদা চক্র রয়েছে।’ 

দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর নাজিরহাট থেকে হালদা নদীর মোহনা কালুরঘাট পর্যন্ত প্রায় ৫৩ কিলেমিটার দৈর্ঘ্য নদীতে সারাবছর মাছ শিকার, বালু উত্তোলন, ইঞ্জিন চালিত নৌকা চালাচল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরপরও প্রজনন মৌসুমে হালদা নদীতে চলছে ইঞ্জিন চালিত নৌকা। রাউজান অংশে বালু উত্তোলন তুলনামূলকভাবে কমলেও হাটহাজারী অংশে চলমান রয়েছে।

নদীপাড়ে অবৈধ ইটভাটা
 
হালদা নদীর রাউজান অংশে পাড় কেটে তিনটি ইটভাটায় মাটি যোগান দেওয়া হচ্ছে, কাঠ পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে গত ১১মার্চ চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মোকামীপাড়া গ্রামে হালদার পাড় ঘেঁষে গড়ে তোলা এ.আলী নামে একটি অবৈধ ইটভাটার চিমনি গুড়িয়ে দিয়েছিল জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর। সেসময় ইটভাটির কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিলেও ২০ থেকে ২৫ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন নদী ও পরিবেশদূষণকারী ড্রাম চিমনি তৈরি করে পুনরায় ইটভাটা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। 

এছাড়া হালদাপাড়ে রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের আবুরখিল গ্রামে নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা শান্তি ব্রিকস নামের আরেকটি ইটভাটায় গত বছরের ২৮ নভেম্বর অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দেয় উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু সেটিও সপ্তাহ যেতে না যেতে আবার চালু হয়েছে। একই ইউনিয়নের মইশকরম গ্রামে হালদার তীর ঘেঁষে আজমীর অটো ব্রিকস নামের আরেকটি ইটভাটা রয়েছে। যেটিতে অভিযান চালানো হয়নি। এই ইটভাটাতে মাটি যোগান দেওয়া হচ্ছে হালদা নদীর পাড় কেটে। তবে হালদা নদীর হাটহাজারী অংশে কোন ইটভাটা নেই। অন্যদিকে নদীর পাড় কেটে মাটি বিক্রয়ের মহোৎসব চলছে ফটিকছড়ি উপজেলায়।
   
হালদা নদীতে মাছের মৃত্যু 

গত সোমবার (১৯ এপ্রিল) হালদা নদীর ফটিকছড়ি অংশের সমিতির হাট ইউনিয়নের দক্ষিণ চিন্তাপুর এলাকায় নদীর তীরে ০৮ কেজি ওজনের একটি মৃত কাতাল পড়ে থাকে। তবে প্রত্যক্ষদর্শী ছবিতুলে সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষকে জানালেও মাছটি জোয়ারের পানিতে ভেসে চলে যাওয়ায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।  গত শনিবার (০৩ এপ্রিল) হালদা নদীর হাটহাজারী অংশের মধ্যম মাদার্শা বড়ুয়া পাড়ার কাছে  ৫ কেজি ওজনের একটি মৃত আইড় মাছ উদ্ধার করা হয়। মাছের মৃত্যু নিয়ে হালদা বিশেষজ্ঞ ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদায় মাত্র একটি মাছ মারা গেছে। আইড় মাছটি আমাদের টার্গেট না।

রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জোনায়েদ কবির সোহাগ বলেন, ‘হালদা নদীর রাউজান অংশে মাছ চুরি, বালু উত্তোলনসহ দৃষ্কৃতিকারীদের অপতৎপরতা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে। এরপরও আমরা মৎস্য বিভাগ, র‌্যাব, পুলিশ, আনসার ও এনজিও সংস্থার সহযোগিতায় অভিযান অব্যাহত রেখেছি।’ 

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘প্রজনন মৌসুম শুরু হওয়ায় হালদা নদীতে মা মাছের আনাগোনা বেড়েছে। নদীর পানির ভৌত ও  রাসায়নিক গুনাগুন এবং নদী তীরবর্তী পরিবেশ বিগত বছরগুলোর তুলনায় দূষনমুক্ত হওয়ায় মা মাছ ও গাঙ্গেয় ডলফিনের অবাদ বিচরন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত বছরের মতো এবার বেশি পরিমাণ নিষিক্ত ডিম আহরণের আশা করছি। হাটহাজারী অংশে অবৈধ জাল বেশি পাতা হয় উদ্ধারও বেশি। রাউজান অংশে অবৈধ জাল পেতে মাছ চুরি শূন্যের কোটায়। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা গবেষক মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘হালদা নদীতে অন্যান্য বছরের তুলনায় অবৈধ জালপাতা, হালদা দূষণ অনেক কমে আসছে। হালদা নদীর রাউজান কিংবা হাটহাজারী কোন অংশে দূষণ বা অবৈধ জালপাতা হচ্ছে, সেটা বিষয় না। জালতো নদী থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে। হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন যেভাবে ভূমিকা রাখছে সেভাবে রাউজান উপজেলা প্রশাসন ভূমিকা রাখলে সুফল বেশি পাওয়া যাবে। 

চলতি প্রজননের কোন সময়ে ডিম ছাড়তে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চলতি এপ্রিল  মাসে একটা জো চলে গেছে,  এ মাসের শেষ সপ্তাহে আরও একটি জো আছে। এছাড়া আগামী মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ও শেষ সপ্তাহসহ মোট তিনটি জো আছে। এই তিনটি জোর মধ্যে মা মাছ ডিম ছাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’

উল্লেখ্য, দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী থেকে কার্প জাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ) মা মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। সরকারের বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপে পোনা রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ডিম সংগ্রহকারীরা। যা গত এক যুগের সর্বোচ্চ আহরণ বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়