Cvoice24.com

স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও মিলেনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি, দিনমজুরিতে জীবন চলে সাতকানিয়ার ছালামের

মো. জাহেদ হোসাইন, সাতকানিয়া

প্রকাশিত: ১৪:০০, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২
স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও মিলেনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি, দিনমজুরিতে জীবন চলে সাতকানিয়ার ছালামের

এই বৃদ্ধ বয়সেও জীবনের ঘানি টানছেন মুক্তিযোদ্ধা ছালাম

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক বর্তমান সরকারের আমলে বারংবার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত, সংশোধন, সংযোজন কিংবা বিয়োজন করা হলেও অদ্যাবধি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি বহু মুক্তিযোদ্ধা। অশিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত অথবা অর্থাভাবে সঠিক স্থানে যোগাযোগ করতে না পারায় অনেকে জীবন সায়াহ্নে এসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেদের হতাশা প্রকাশ করেন। 

আবার অনেকে জীবন যুদ্ধে নেমে জীবিকা নির্বাহ করছেন অন্যের কামলা হিসেবে। হতাশাগ্রস্ত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যারা এখনো নিজেকে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতির খাতায় নাম লেখাতে পারেননি, তাদের অনেকেই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কোন চায়ের দোকানে বসে মুক্তিযুদ্ধের শ্বাসরুদ্ধকর ইতিহাস নিয়ে দ্য অ্যানসিয়েন্ট ম্যারিনারের আলবাট্রস পাখির গল্প করেই সময় পার করছেন। স্বাধীনতার ৫১ বছরেরও স্বীকৃতি না পাওয়া এমনই একজন মুক্তিযোদ্ধা সাতকানিয়ার আবদুল ছালাম। 

জীবন জীবিকার তাগিদে সংসারের ঘানি টানতে অবশেষে বেছে নিয়েছেন দিনমজুরের কাজ। কাজের ফাঁকে সুযোগ হলে মুক্তিযুদ্ধের করুন এবং শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী নিয়ে গল্প জুড়ে দেন। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ছালামের যুদ্ধের লব্ধ অভিজ্ঞতা গল্পতেই সীমাবদ্ধ। অদ্যাবধি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সরকারিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বালামে নিজের নাম লেখাতে পারেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের লাল বার্তা কিংবা নীল বার্তা কোনটি ছালামের কাজে আসেনি। বরং তার চোখে শুধু অন্ধকারের অমানিশার বার্তাই ভেসে উঠেছে। 

মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ছালাম সাতকানিয়া উপজেলার কালিয়াইশ ইউনিয়নের বশির আহমদের বাড়ির মৃত গোলাম আলীর ছেলে। পার্থিব জীবন বুঝে উঠার আগেই ছালামকে ছেড়ে মা পরপারে পাড়ি জমান। মাতৃহীন শিশু ছালামকে নিয়ে পিতা গোলাম আলী দিশেহারা হয়ে পড়েন। অবশেষে গোলাম আলী শিশু সন্তান আবদুল ছালামকে পটিয়া উপজেলার খরনা এলাকায় এক নিঃসন্তান পরিবারের কাছে দত্তক দিয়ে দ্বিতীয় সংসার পাতেন। 

আবদুল ছালাম যখন বয়োঃসন্ধিকাল অতিক্রম করে কিশোরে পা রাখলেন তখন পিতা গোলাম আলী পুনরায় ছেলেকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। তখন থেকে শুরু হয় ছালামের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। দিনমজুরের কাজ করে পিতার দ্বিতীয় সংসারের ঘানি টানা আর ছোট ভাই বোনদের মানুষ করা। সংসারের এই বিশাল বোঝা টানতে গিয়ে সুযোগ পাননি নিজে অক্ষর জ্ঞান অর্জনের। 

এরই মধ্যে বেজে উঠে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দামামা। পাকহানাদার বাহিনীদের অত্যাচার নির্যাতন স্বচক্ষে দেখে আবদুল ছালাম নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারলেন না । জীবন বাজি রেখে পাকহানাদার বাহিনী কবল থেকে দেশ রক্ষা করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েই প্রশিক্ষনের জন্য ভারত গমন করেন। 

মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ছালাম জানান, আমাদের চালানদার ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আবু জাহেদ ও ওস্তাদ রফিক। পাহাড়ের মধ্যদিয়ে গহীন জঙ্গলের ভেতর পায়ে হেঁটে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে গিয়ে যখন পৌঁছি তখন আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এম ফজল করিম। পরবর্তীতে তিনি কালিয়াইশ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। 

প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে যুদ্ধে অংশ নিই। আমাদের গ্রুপে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মৃত জলিল বক্সু, মৃত আবু তাহের, মৃত আবুল হোসেন, নায়েক আবু তাহের, আবদুল মোনাফ, মৃত আহমদ ছফা, মৃত নুরুল ইসলাম, নুরুন্নবী ও সুবল মুহুরী। যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলে সবাই একসাথে মিলে সাতকানিয়া সদরে গিয়ে জেনারেল এম এ জি ওসমানী স্বাক্ষরিত সনদ গ্রহণ করি। আমার এখনো মনে পড়ে সনদ গ্রহণের সময় আমার পাশে ছিলেন নায়েক আবু তাহের। 

যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন করে সনদ হাতে নিজ ঘরে ফিরে আসার পর শুরু ছালামের জীবনের কালো অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পরিবারের খবর নিতে না পারায় ক্ষুব্ধ হন সৎ মা। ছালামের উপর চলতে থাকে সৎ মায়ের নির্যাতন। সৎ মায়ের অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অবশেষে ছালাম পিতার বাড়ি ছেড়ে চলে যান পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রোয়াংছড়ি এলাকায়। এলাকার লোকজনের অন্তরালে দিন মজুরের কাজ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করা শুরু করেন। 

ইতোমধ্যে খবর পান তার পিতার ঘর চুরি হয়। ঘরে রক্ষিত ছালামের বক্সটিও চোর নিয়ে যায়। সাথে নিয়ে যায় বক্সের ভেতর রক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের সনদসহ বিভিন্ন জরুরী কাগজপত্র। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী জেনারেল এম এ জি ওসমানী কর্তৃক প্রদত্ত সনদ দিয়ে তার সমসাময়িক অনেকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হলেও তিনি আর অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন নি। সে থেকে আজ পর্যন্ত সমসাময়িক মুক্তিযোদ্ধাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে কোন সুরাহা করতে পারেন নি। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ছালাম মানুষের ঘরে কামলার কাজ করে জীবন যাপন করেন। যেখানে যার কাছ থেকে ডাক আসে সেখানে গিয়ে তিনি দিনমজুরের কাজ করেন। আর তাতে যা পান তা দিয়ে সংসার চালান। তবে সমসাময়িক মুক্তিযোদ্ধাদের পরামর্শে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রনালয়ে আবেদন করেছেন ছালাম । 

যোগাযোগ করা হলে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোনাফ বলেন, আবদুল ছালাম একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। আমি নিজেই তার স্বাক্ষী। তিনি আমার গ্রুপেই ছিলেন। একসাথে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। তিনি আরো বলেন, কত মুক্তিযোদ্ধা দেশে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। আমার জানা মতে এদের অনেকেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। আমি চাই আবদুল ছালামের মত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক মূল্যায়ন হোক। 

তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আবদুল ছালামের সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ ছিল না সে কারণে হয়ত আমাদের পক্ষ থেকে তাকে তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। আমি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ছালামকে তালিকাভুক্ত করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি। 
 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়