Cvoice24.com

সাতকানিয়ায় চার কোটি টাকার বালু অর্ধ কোটি টাকায় বিক্রির অভিযোগ

জাহেদ হোসাইন, সাতকানিয়া

প্রকাশিত: ২১:১৯, ৪ মে ২০২৩
সাতকানিয়ায় চার কোটি টাকার বালু অর্ধ কোটি টাকায় বিক্রির অভিযোগ

সাতকানিয়ায় ৪ কোটি টাকার বালু মাত্র অর্ধ কোটি টাকায় নিলামে বিক্রি করে রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। বড় অংকের রাজস্ব আদায়ে দরপত্র কার্যক্রম সম্পন্নের বিষয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল অনুযায়ী ব্যাপক প্রচারণার কথা থাকলেও কৌশলে তা এড়িয়ে গেছে প্রশাসন।

দৈনিক পত্রিকায় কোন ধরনের নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রচার না করে শুধুমাত্র উপজেলা প্রশাসনের নোটিশ বোর্ডে নিলাম বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে দায় সারারও অভিযোগ উঠেছে। অনেকটা প্রশাসন আর বালুখেকো সিন্ডিকেটের যোগসাজসে লুকোচুরিতেই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে করছেন নিলামে অংশ নিতে ইচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি। এই নিলাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারের সাড়ে ৩ কোটি টাকা রাজস্ব তছরুপ করা হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।

তবে, নিলামের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাতকানিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরাফাত সিদ্দিকী চুপিসারে নিলাম হয়নি উল্লেখ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় ও তার কার্যালয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে নিলাম করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন। তিনি ক্রেতা না পাওয়ায় বালুর পরিমাণ ও মূল্য কমিয়ে নিলাম করা হয়েছে বলেও জানান। গত মঙ্গলবার বিকালে সহকারী কমিশনার (ভূমি)’র কার্যালয়ে এই নিলাম কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। ৫১ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে মেসার্স হাবিবা বিল্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ দরদাতা উল্লেখ করে তাকে ওই বালু নিলাম দেয়া হয় বলে নিশ্চিত করেছেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরাফাত সিদ্দিকী। 

এদিকে বিজ্ঞপ্তি না পেয়ে নিলামে অংশগ্রহণ করতে পারেনি বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকটি দরদাতা সংস্থার সত্বাধিকারীরা। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান বলেন, চরতীর বালু উত্তোলনের বিষয়টি শুরু থেকে একটি প্রভাবশালী মহল নিয়ন্ত্রণ করছে। বালু নিলাম কার্যক্রমকে দীর্ঘায়িত করে জব্দকৃত বালু থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি বালি সরিয়ে নেয়ার পাশাপাশি প্রতিদিন ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন কার্যক্রমও অব্যাহত রাখে। আবার সেই প্রভাবশালী মহলের কারসাজিতে দুই দফা নিলামের দায়সারা নোটিশ দিয়ে ৩য় দফায় মাত্র অর্ধকোটি টাকায় বিক্রি করা হয়। সতর্কতার সাথে অতি গোপনীয়তায় নিলাম প্রক্রিয়া সম্পন্ন পূর্বক বালুখেকোদের কাছে জব্দকৃত বালু বিক্রি করে সুকৌশলে সরকারকে বিশাল অংকের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

গত ১৪ মার্চ (মঙ্গলবার) বিকালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট প্রতীক দত্ত সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে সাতকানিয়া উপজেলার চরতী ইউনিয়নের ব্রাক্ষণডেঙ্গা এলাকায় সাঙ্গু নদীর পাড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় উত্তোলিত বালু অবৈধ ভাবে বিক্রির সময় সৈকত দাশ নামের এক ব্যক্তিকে হাতে-নাতে আটক করে। একই সাথে ওই স্পট থেকে ৫০ লাখ ঘনফুট বালু এবং বালু বিক্রির কাজে ব্যবহৃত একটি এস্কেভেটরও জব্দ করেন। তখন ওই জব্দকৃত বালুর বাজারমূল্য ধরা হয় ৪ কোটি টাকা। সৈকত দাশ দীর্ঘদিন যাবত এলাকার একটি প্রভাবশালী মহলের ইন্ধনে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও বিক্রির কথা স্বীকার করলে তাকে ১ লাখ টাকা জরিমানা ও ৭ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। পরে জব্দকৃত বালু ও স্কেভেটর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রুহুল্লাহ চৌধুরীর জিম্মায় দেয়া হয়।

পরবর্তীতে ওই বালু নিলামে বিক্রির জন্য উপজেলা নিলাম কমিটির আহবায়ক ও সহকারী কমিশনার (ভুমি) আরাফাত সিদ্দিকী নিলামের জন্য যে কোন ট্রেড লাইসেন্সধারী ব্যক্তি/ প্রকৃত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করেন। ওই দরপত্র বিজ্ঞপ্তিতে বালুর পরিমাণ ৪০ লক্ষ ঘনফুট ও প্রতি ঘনফুটের প্রাক্কলিত মূল্য ৫ টাকা উল্লেখ করা হয়। সেমতে নিলাম ডাক ১৩ এপ্রিল দুপুর ১২টায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও রহস্যজনক কারণে ওই দিনই একই বালুর পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ বিজ্ঞপ্তিতে বালির পরিমাণ দেখানো হয় ৩০ লক্ষ ঘনফুট ও প্রাক্কলিত মূল্য ৩ টাকা কমিয়ে ২ টাকায় নির্ধারণ করা হয়। নিলাম ডাকের তারিখ ১৮ এপ্রিল (দুপুর ১২টায়) অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা হয়। সর্বশেষ গত ২৪ এপ্রিল একই বালি ৩য় বারের মত নিলাম আহ্বান করা হয়। সেই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী গত (২ এপ্রিল) মঙ্গলবার বিকেলে এই নিলাম কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। এই বিজ্ঞপ্তিতে বালুর পরিমাণ আরও কমিয়ে ২৫ লক্ষ ঘনফুট করা হয়। আর বালির মূল্য আরও এক টাকা কমিয়ে ঘনফুট বালির প্রাক্কলিত মূল্য মাত্র ১ টাকায় ঠেকিয়ে দেয়া হয়। 
মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে তিনটার সময় উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায়, উক্ত বালু নিলাম নেয়ার জন্য বিভিন্ন এলাকার ১৫/২০ জন লোক একত্রিত হয়েছেন। কার্যালয়ের উপস্থিত কামাল উদ্দিন, জহির উদ্দিন ও মোস্তাক আহমদ অভিযোগ করে বলেন, সাতকানিয়া উপজেলা ল্যান্ড অফিস নামীয় ফেসবুক পেইজে গত দু’বারের নিলাম বিজ্ঞপ্তি ( ৪ ও ১৩ এপ্রিল) নোটিশ বোর্ডে দেয়া হলেও ৩য় বার অর্থাৎ ২৪ এপ্রিলে বিজ্ঞপ্তিটি প্রচার করা হয়নি। তাই আমরা এই বিজ্ঞপ্তিটি না পাওয়ায় এই নিলামে অংশগ্রহণ করতে পারছি না। এ ধরনের যোগসাজস প্রক্রিয়াকে প্রভাবশালী মহলের মনোরঞ্জন করা জন্যই করা হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন।  

নিলাম প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরাফাত সিদ্দিকী বলেন, আমরা ইউএনও অফিস ও আমার কার্যলয়ে নোটিশ বোর্ডে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিলাম কার্যক্রমে অগ্রসর হচ্ছি। এসময় ফেসবুক পেইজে বিজ্ঞপ্তি দুটি দেয়া আর শেষ বারের বিজ্ঞপ্তি না দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা নোটিশ বোর্ডে দিয়েছি ফেসবুক পেইজে দেয়া না দেয়া কোন বিষয় না। 

বালুর পরিমাণ কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের পরে জব্দকৃত বালু ও স্কেভেটর জব্দ করে চেয়ারম্যানের জিম্মায় দেয়া হয়েছিল। 

এলাকাবাসীর অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জব্দকৃত বালু প্রশাসন যার জিম্মায় রেখেছেন ওই জিম্মাদারই দিনে রাতে ডাম্পারযোগে বিক্রি করছেন। আমানতে খেয়ানত জিম্মাদারই করেছেন। তারা আরো বলেন, যার কাছে জব্দকৃত বালু জিম্মা রেখেছেন তিনি এ এলাকার সবচেয়ে বড় বালুখেকো। তাকে জব্দকৃত বালু জিম্মায় দেয়াটা তার জন্য সোনায় সোহাগা হয়েছে। জব্দ বালু চেয়ারম্যানের জিম্মায় দেয়া আর বিড়ালের কাছে মাছ পাহারার দায়িত্ব দেয়া একই কথা।

আবার অনেকে বলেছে ভিন্ন কথা আইনগতভাবে স্বচ্ছতা দেখানোর জন্য প্রশাসন গোপনে তিনবার দরপত্র আহ্বান করেছে যাতে সহজে তাদের পছন্দের বালুখোকে নিলাম দেয়া যায়। কেউবা আবার বলছেন, তিনবার দায়সারা দরপত্র প্রক্রিয়ার নামে কালক্ষেপন করেছে যাতে জিম্মাদার জব্দকৃত বালু বিক্রি করতে পারে। যার কারণে প্রতিবার দরপত্র আহ্বানের আগে বালুর পরিমান করে গেছে। তাছাড়া বালু জব্দ পরবর্তী প্রশাসন কর্তৃক কোন ধরনের নজরদারী কিংবা তদারকি ছিলনা বলেও অভিযোগ করেছেন তারা।

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাসুদ কামাল বলেন, প্রথম বার পরিমাপ ভূল হতে পারে, ধরলাম দ্বিতীয় বারও ভুল হলো। তৃতীয় বারতো ভুল হওয়ার কথা না। আপনি পুরো বিষয়টি নিয়ে কথা বললে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

সাতকানিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, আমরা যেটি পেয়েছি সেই অনুযায়ী নিলাম করেছি। কি দিয়েছে, কি পেয়েছি, কি পাইনি? সেটি নিয়ে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। তা’ রির্পোটে আসবে। 

স্বাচিপ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান বলেন, পুরো প্রক্রিয়াটিতেই প্রভাবশালী বালুখেকো লাভবান হয়েছে। পক্ষান্তরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার। এ ধরনের অপকর্মে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে সরকারি রাজস্ব পুনরুদ্ধার করা জরুরি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের পটিয়া জোনের উিপ বিভাগীয় প্রকৌশলী ও বালু নিলাম কমিটির সচিব অপু দেব জানান, জিম্মাদারের জিম্মায় থাকা অবস্তায় দফায় দফায় বারু কমে গেছে। এমনকি জব্দকৃত একটি স্কেভেটরও তার জিম্মা হতে চুরি হয়ে যায়। আমরা জিম্মাদারের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়