Cvoice24.com

চবিতে ফাও খাওয়া নিয়ে অতিষ্ঠ হলের ডাইনিং ম্যানেজাররা

চবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২১:৩১, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২
চবিতে ফাও খাওয়া নিয়ে অতিষ্ঠ হলের ডাইনিং ম্যানেজাররা

ক্যাশ কাউন্টারে `দয়া করে সকলে নগদ খান, আমি বাজার করতে পারিনা` লিখা সম্বলিত একটি পোস্টার সাঁটান বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল ও এ এফ রহমান হলের ক্যান্টিনের ম্যানেজার।

মঙ্গলবার দুপুর দেড়টা। আলাওল ও এফ রহমান হলের ক্যান্টিনে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন ছাত্ররা। খাওয়ার পর ম্যানেজারের কাছে টাকা দিচ্ছিলেন সিভয়েসের প্রতিবেদকসহ কয়েক ছাত্র। এ সময় দুই ছাত্র বিল না দিয়েই ‘লিখে রাখতে বলে’ বেরিয়ে গেলেন। তাদের দেখিয়ে ক্যান্টিন ম্যানেজারের কাছে জানতে চাওয়া হলো, 'ওনারা বিল দেবেন না?'

ম্যানেজারের উত্তর— না। তবে পাশ থেকে এক ক্যান্টিন বয় বলল, ‘ওনারা নেতা।’

এমন দৃশ্য নাকি শুধু আলাওল ও এফ রহমান ক্যান্টিন নয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলের ডাইনিং, ক্যান্টিন ও হোটেলের চিত্র এটি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতেও এমন ‘ফাও’ খাওয়া আর টাকা বাকি পড়ায় অর্থকষ্টে পড়েছেন এসব ক্যান্টিন ও ডাইনিং ম্যানেজাররা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি আবাসিক হলের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। শিক্ষার্থীরা দুপুরের ও রাতের খাবারের জন্য নির্ভর করতে হয় ডাইনিং, ক্যান্টিন ও হোটেলের ওপর। ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির তথ্য মতে, ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে দোকান রয়েছে ২১৫টি। এর মধ্যে রয়েছে খাবার হোটেল, চায়ের স্টল, মুদি ও স্টেশনারিসহ বিভিন্ন ধরনের দোকান। এর মধ্যে খাবারের দোকান, ক্যান্টিন ও হলের ডাইনিংগুলো শিক্ষার্থীদের বাকির ভারে জর্জরিত। ব্যবসায়ীদের দাবি— ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের টাকা বাকি ও ফাও খাওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিতেই ইচ্ছা থাকলেও খাবারের মান উন্নত করা যাচ্ছে না।  

সম্প্রতি বাকির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে ক্যাশ কাউন্টারে 'দয়া করে সকলে নগদ খান, আমি বাজার করতে পারিনা' লিখা সম্বলিত একটি পোস্টার সাঁটান বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল ও এ এফ রহমান হলের ক্যান্টিনের ম্যানেজার মো. হেলাল হোসেন। মূহুর্তেই লেখাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে হেলাল হোসেন তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সিভয়েসকে তিনি বলেন, 'এসব করে কি হবে? আমি কিছু বলতে চাই না। আপনারা অনেকেই ফেসবুকে লেখালেখি করেছেন এতেই আমি খুশি। আমি পোস্টার লাগিয়েছি। আশা করছি যাদের কাছে টাকা পাব তারা অতি শিগগিরই টাকা দিয়ে দেবেন।'

মো. হেলাল হোসেন বলেন, 'আমি টাকা পাব। কিন্তু আমি সংবাদ বা অন্য কিছু করতে চাই না। এতে কিছুই হয় না। বরং উল্টো হয়।'

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছেলেদের সবগুলো হলের ডাইনিং ও ক্যান্টিনে বাকি পড়ে আছে হাজার হাজার টাকা। কোনো কোনো ডাইনিংয়ে বাকি আছে লাখ টাকার উপরে। বাকি দিতে না চাইলে বিভিন্ন হুমকি চাপের সম্মুখীন হতে হয় ম্যানেজারদের। একই চিত্র হল ও বিভিন্ন অনুষদের ঝুপড়ির দোকান গুলোতেও।

নিম্নমান ও মূল্যবৃদ্ধির পেছনে 'ফাও' খাওয়া

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হলের খাবারের নিম্নমান ও মূল্যবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে এই 'ফাও' খাওয়া। বাকিতে খাবার না দিলে ম্যানেজার, ক্যান্টিন বয়দের হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। একাধিক হলের ক্যান্টিন ম্যানেজার জানান, অনেকে সারা মাসই খায়। মাঝেমধ্যে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়; দামের তুলনায় তা খুবই সামান্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হলের সাবেক ম্যানেজার ইকবাল হোসেন বলেন, '২০১৬ সাল থেকে আমি হলের ম্যানেজার ছিলাম। করোনার বন্ধের সময় সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা বাকিতে খেয়ে টাকা পরিশোধ করেনি। এছাড়া অনেকে ফাও খেত। টাকা দিত না। তখন ভীষণ অর্থকষ্টে পড়ি। পরে ২০২০ সালের দিকে আমি দায়িত্ব ছেড়ে দেই। এখনও প্রায় দেড় লক্ষ টাকা বাকি আছে।’

আলাওল হলের বর্তমান ম্যানেজার মো. ইকরাম হোসেন বলেন, 'মানুষের সুবিধা অসুবিধা থাকে। কিন্তু বর্তমানে যে বাজার দর তার উপর যদি এই পরিমাণে বাকি টাকা পড়ে থাকলে ডাইনিং চালানো সত্যিই কষ্টকর।'

সোহরাওয়ার্দী হলের ডাইনিং ম্যানেজার মো. মালেক ভুঁইয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সব মিলিয়ে প্রায় ৮০-৯০ হাজার টাকার মতো বাকি আছে।'

তিনি আরও বলেন, 'অতিরিক্ত দ্রব্য মূল্য আর এতো টাকা বাকি পড়ে থাকার কারণে অনেক সময় চাইলেও খাবারের মান বাড়াতে পারেনি।'

শাহ আমানত হলের ডাইনিং ম্যানেজার শেখ আব্দুল মান্নান বলেন, '২০ বছর ধরে ডাইনিং চালাচ্ছি। বাকি থাকবেই। সব টাকা তো আর আদায় করতে পারিনি। তাছাড়া অনেকেই লেখা পড়া শেষ করে ২/৩ বছর পরে এসেও টাকা দিয়ে যায়। অনেকে হাজার হাজার টাকা বাকি খেয়েও আর পরিশোধ করেনি।'

যা বলছেন ছাত্র নেতারা

এদিকে শিক্ষার্থীদের টাকা পরিশোধ না করার বিষয়টিকে নিন্দনীয় বলছেন ছাত্রনেতারা।

শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি প্রত্যয় নাফাক বলেন, ‘দোকানদারের সঙ্গে যদি শিক্ষার্থীর তেমন সম্পর্ক থাকে, তাহলে বাকি রাখতেই পারে। কিন্তু জোর করে খেয়ে টাকা না দিয়ে চলে যাওয়া উচিত নয়। আর এটা যদি ক্ষমতার প্রদর্শন হয় তাহলে সেটা আরও বেশি খারাপ কাজ। দোকানদার অতিরিক্ত দাম রাখলে সেটা নিয়ে কথা বলা যায়। কিন্তু টাকা না দেওয়া কিংবা ফাও খাওয়া একজন শিক্ষার্থীর কাছে কোনোভাবেই কাম্য নয়।’

তিনি বলেন, 'হলের যারা ফাও খায় তারা সবাই ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী। কর্তৃপক্ষকে এদের লাগাম টেনে ধরতে হবে।'

শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু বলেন, ‘ব্যবসা লেনদেনের ওপর চলে। এখানকার বেশিরভাগই শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত পরিবারের। অনেকে টিউশন করে চলে। বাকি খেলেও বেতন পাওয়ার পর দোকানদারকে পরিশোধ করে দেয়। কিন্তু বাকির টাকা পরিশোধ না করা নিন্দনীয়।’

ছাত্রলীগের কোনো নেতা ফাও খায় না জানিয়ে তিনি বলেন, 'যদি ছাত্রলীগের এমন কোনো নেতাকর্মী ফাও খায় কিংবা বাকির টাকা পরিশোধ না করে, তাহলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।'

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়