Cvoice24.com

৫৭ পেরিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়/ আছে সংকট, অর্জনও কম নয়

চবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০০:২৮, ১৮ নভেম্বর ২০২৩
৫৭ পেরিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়/ আছে সংকট, অর্জনও কম নয়

সবুজের সমারোহ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর নিঝুমপুরীর ক্যাম্পাস খ্যাত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার ৫৭ বছর পেরিয়ে আজ ৫৮তে পা রাখলো প্রাণোচ্ছল এই পাঠশালা। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর যাত্রা শুরু করার পর থেকে শুধু ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলেই নয়, বিশ্বজুড়ে জ্ঞানতাপস হয়ে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে চবির শিক্ষার্থীরা। সাফল্য, ঐতিহ্য আর গৌরবের বহু অর্জনে সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এ বিশ্ববিদ্যায়টি। তবে প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো নানা সংকটের আবর্তে শাটলের ক্যাম্পাসটি। আবাসন সংকট, শিক্ষক-শ্রেণিকক্ষের স্বল্পতা, পরিবহনের অপ্রতুলতা, গবেষণায় অনগ্রসরতা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সৃষ্টি করেছে সংকট। প্রতিষ্ঠার পর সমাবর্তন হয়েছে মাত্র পাঁচটি। ৩৪ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন।

বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে নানা আয়োজন:

শনিবার ৫৮ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সেজেছে বর্ণিল সাজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও স্থাপনাগুলোতে করা হয়েছে আলোকসজ্জা। দিনব্যাপী নানা আয়োজনে রয়েছে র‍্যালি, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, কেক কাটা, আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

১৯৬৪ সালের ২৯ আগস্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৬৫ সালের ৩ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান মল্লিককে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। এরপর ড. আজিজুর রহমান মল্লিক চট্টগ্রাম শহরের নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির ৩নং সড়কের ‘কাকাসান’ নামের একটি ভবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের অফিস স্থাপন করেন। ড. আজিজুর রহমান মল্লিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন। ১৯৬৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর এক সরকারি প্রজ্ঞাপন বলে তৎকালীন পাকিস্তান শিক্ষা পরিদপ্তরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প অফিসে বদলি করা হয়। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের ‘বাস্তকলা’ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়। প্রাথমিকভাবে একটি দ্বিতল প্রশাসনিক ভবন, বিভাগীয় অফিস, শ্রেণিকক্ষ ও গ্রন্থাগারের জন্য একতলা ভবন তৈরি করার পাশাপাশি শিক্ষক ও ছাত্রদের আবাসনের ব্যবস্থাও করা হয়। অবশেষে ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। মাত্র ৮ জন শিক্ষককে নিয়ে যাত্রা শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে চালু হয় বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি এ চার বিভাগ। যার অধীনে ছিল মাত্র ২০৪ জন শিক্ষার্থী।

বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। পাঠদানে রয়েছেন ৯০৬ জন গুণী শিক্ষক। এখানে ৯টি অনুষদের অধীনে ৪৮টি বিভাগ ছাড়াও রয়েছে ৬টি ইনস্টিটিউট। শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ১৪টি আবাসিক হল ও ১টি ছাত্রবাস রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি ছেলেদের ও ৫ মেয়েদের হল। আবাসিক হল ও হোস্টেলে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় ৭ হাজার আসন বরাদ্দ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে রয়েছে শাটল ও ডেমু ট্রেন।

বহু কীর্তিমান গুণীজনে উদ্ভাসিত বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ থেকে একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এবং ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম গ্রামীণব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের স্বনামধন্য শিক্ষক ছিলেন। বিশ্বখ্যাত বিশ্বতত্ত্ববিদ, পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতবিদ একুশে পদক প্রাপ্ত অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। যিনি শুধুমাত্র দেশের টানে বিদেশের চাকরির লোভনীয় প্রস্তাব ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। ঐতিহাসিক ও শিক্ষাবিদ আবদুল করিম, একুশে পদকজয়ী সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, শিক্ষাবিদ আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ, চিত্রশিল্পী রশিদ চৌধুরী, কলামিস্ট আবুল মোমেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। সাবেক জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অপরাজেয় বাংলার স্থপতি ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ, ঔপন্যাসিক আলাউদ্দিন আল আজাদ, সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, মুর্তজা বশীর, ঢালী আল মামুনসহ দেশ বরেণ্য বহু কীর্তিমান মনীষীর জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত এ বিশ্ববিদ্যালয়।

অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে চবি

অপরূপ নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ঘন পাহাড় আর সবুজের আচ্ছাদন যেন নীল আকাশ ছুঁয়ে যায়। পাহাড়, ঝরণা, লেক, আর স্বতন্ত্র জীববৈচিত্র্য এ ক্যাম্পাসকে করেছে অতুলনীয়। ক্যাম্পাসের প্রতিটি জায়গা যেন এক একটি পর্যটন স্পট। ফরেস্ট্রি ইনস্টিটিউটের সাজানো রাস্তা, রাস্তার দু’পাশে গাছের সারি, পাশে লেক, অসাধারণ প্রশাসনিক ভবন হ্যালিপ্যাড সবকিছুতেই ছড়িয়ে আছে একরাশ মুগ্ধতা। ৬০ একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বোটানিক্যাল গার্ডেন দর্শনার্থীদের জন্যে চমৎকার এক বাড়তি পাওনা। কলা অনুষদের পেছনে পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা প্রাকৃতিক ঝরণার শীতল পানি পর্যটন পিয়াসী মানুষকে বিমোহিত করে তুলে।

ষড়ঋতুর ক্যাম্পাস

ছয়টি ঋতুর এক আশ্চর্য লীলা নিকেতন এই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত— এ ছয়টি ঋতুর আবির্ভাবে নানা সাজে বিভিন্ন রঙে বিচিত্ররূপ ধারণ করে এখানকার চারপাশের প্রকৃতি। বাংলার ষড়ঋতুকে সত্যিকারভাবে উপভোগ করতে হলে দ্বিধাহীনভাবে ছুটে যেতে হবে এই ক্যাম্পাসে। প্রত্যেকটি ঋতুর যে অপূর্ব মেলবন্ধন তা লিখে বোঝানো যাবে না শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায় এখানে।

গ্রীষ্মের প্রখর তাপদাহের মাঝেও সুশীতল বাতাস, নানান ফলের সম্ভার, বর্ষায় আষাঢ়ের জলধারার চিরচেনা সবুজাভ প্রকৃতি, শরতের শেষ বেলায় সাদা মেঘের ভেলা আর শুভ্র জ্যোৎস্না ও পুষ্প সুষমা, শিশিরে ভেজা মাতাল হেমন্ত, শীতে সাদা কুয়াশার চাদর, নবপল্লবে সুশোভিত বসন্ত-ষড়ঋতুর এমন ছয় রঙে চবি ক্যাম্পাসে রঙিন হয়ে উঠার জন্যে বছরজুড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে।

স্থাপত্যকর্মে বাঙালির বিজয়গাঁথা ইতিহাসে চবি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে বিভিন্ন খ্যাতিমান শিল্পীর নজরকাড়া সব স্থাপত্যকর্ম। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত এসব শিল্পকর্ম সবাইকে বিমোহিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশের গৌরবমাখা ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ভাস্কর্যে বাঙালির বিজয়গাথা ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদের স্মৃতি সংরক্ষণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দু’টি স্মৃতিস্তম্ভ ও একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। ১৯৮৫ সালে শিল্পী মুর্তজা বশীরের প্রচেষ্টায় স্থাপন করা হয় স্বাধীনতা ভাস্কর্য। একই বছর শিল্পী রশিদ চৌধুরীর নকশায় নির্মিত হয়েছে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ। ২০০৯ সালে স্থাপিত হয় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ‘স্মরণ’র স্থপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ সাইফুল কবীর।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কলাভবনের সামনে নির্মাণ করা হয় স্বাধীনতা স্মারক ভাস্কর্য। দেশের একমাত্র স্টিলের তৈরি এ ভাস্কর্যটির স্থপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালযয়ের সাবেক অধ্যাপক প্রখ্যাত শিল্পী মর্তুজা বশীর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার ও বুদ্ধিজীবী চত্ত্বরের মধ্যবর্তী চৌরাস্তার মধ্যখানে ‘জয় বাংলা’ ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে। লাইভ কাস্টিং মেথডে তৈরি করা হয়েছে এ ভাস্কর্যটি, যা বাংলাদেশে প্রথম। ধূসর রঙের আস্তরণে মার্বেল ডাস্ট ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে রোদ বৃষ্টিতেও ভাস্কর্য মলিন হবে না। মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে ২০১৮ সালে এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভাস্কর্য বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সৈয়দ মোহাম্মদ সোহরাব জাহান। তাঁর সহযোগী ছিলেন মুজাহিদুর রহমান মুসা, জয়াশীষ আচার্য ও তপন ঘোষ। এই ভাস্কর্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের প্রত্যক্ষ ও সমান অংশগ্রহণের বিষয়টি যেমন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়িদের ভূমিকা ও উপজাতি এক নারীর অবয়ব উপস্থাপন করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথেই সাত মুক্তিযোদ্ধা বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ ‘স্মরণ স্মৃতিস্তম্ভ’ ভাস্কর্যটি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ জন শিক্ষক, ১১ জন ছাত্র এবং ৩ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সর্বমোট ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ আর বীরত্বের স্মৃতিস্বরূপ ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন মুক্তিযোদ্ধার নাম ও ছবি রয়েছে।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবিদের স্মরণে নির্মাণ করা হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ। ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ভবন সম্মুখস্ত এ স্মৃতিস্তম্ভের ডিজাইনার চবি চারুকলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও একুশে পদক বিজয়ী প্রখ্যাত তাপিশ্রী শিল্পী রশীদ চৌধুরী।

ক্যাম্পাসের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত চবি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। কাটা পাহাড় রাস্তার মাথায় নির্মিত চবির প্রথম শহীদ মিনারটি ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হলে একইস্থানে বর্তমান শহীদ মিনারটি ১৯৯৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য রফিকুল ইসলাম চৌধুরী এ শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের নকশা করেন ‘অপরাজেয় বাংলা’র স্থপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। প্রায় দশ শতক জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছে গৌরবের অন্যতম নিদর্শনটি।

মুক্তিযুদ্ধে চবির সূর্যসন্তানেরা

মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রায় দুই শতাধিক ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে যখন উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তখনও চবি ক্যাম্পাসের শক্ত ঘাঁটিতে বহাল তবিয়তে ছিল পাকিস্তানিরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হানাদার মুক্ত করতে বিজয়ের নয়দিন পর ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত লড়াই করতে হয়েছিল বাংলার দামাল ছেলেদের।

মুক্তিযদ্ধে শহীদ হন ১ জন শিক্ষক, ১১ জন ছাত্র এবং ৩ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সর্বমোট ১৫ জন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের কর্মচারী শহীদ মোহাম্মদ হোসেনকে দেওয়া হয় বীরপ্রতীক খেতাব। চাকসুর প্রথম জিএস এবং ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আব্দুর রব, দর্শন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক অবনী মোহন দত্ত, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের চেইনম্যান বীরপ্রতীক মোহাম্মদ হোসেন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী প্রভাস কুমার বড়ুয়া, ইংরেজী বিভাগের ছাত্র আশুতোষ চক্রবর্তী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল মনসুর, বাণিজ্য অনুষদের ছাত্র খন্দকার এহসানুল হক আনসারী, ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ফরহাদ-উদ-দৌলা, সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, আলাওল হলের প্রহরী সৈয়দ আহমদ, অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র নাজিম উদ্দিন খান ও আবদুল মান্নান, বাংলা বিভাগের ছাত্র মুহাম্মদ হোসেন, মোস্তফা কামাল ও মনিরুল ইসলাম খোকা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় এ স্বাধীনতার জন্য।

পৃথিবীর একমাত্র শাটল ট্রেনের বিশ্ববিদ্যালয়

কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করবে; পৃথিবীতে এমন ট্রেন আছে শুধু চবিতে। শহর থেকে ক্যাম্পাসের দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটারের। তাই শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য ১৯৮০ সালে চালু হয় শাটল ট্রেন। পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্রটা এখানেই। যুক্তরাষ্ট্রের গান ফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিবহনের জন্য ছিল নিজস্ব ট্রেন। কিন্তু বর্তমানে তা বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ই পৃথিবীর একমাত্র শাটল ট্রেনের বিশ্ববিদ্যালয়।

চবির ট্রেনের ঠিকানা কিংবা গন্তব্য বটতলি থেকে ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্ট। দুটো শাটলের প্রতিদিন প্রায় দশ থেকে বার হাজার শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় যাতায়াত করে। এই শাটল দেখতে শুধু যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন তা কিন্তু নয়। বিদেশ থেকেও শাটল দেখতে চবিতে আসার অনেক নজির আছে। শাটলই হলো চবির প্রাণ। অনেকে এই শাটলকে ‘ভ্রাম্যমাণ বিশ্ববিদ্যালয়’ও বলেন। আড্ডা, গল্প, গান, পড়ালেখা কী নেই এই শাটলে! বিভিন্ন বগিতে সবাই একসঙ্গে গান গেয়ে মাতিয়ে রাখেন পুরো ট্রেন।

সমৃদ্ধ কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি

দেশের সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে অন্যতম চবির গ্রন্থাগার। দেশি-বিদেশি সাড়ে তিন লাখ বই, ম্যাগাজিন, পাণ্ডুলিপি দিয়ে এ অঞ্চলে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে এটি। ১৯৬৬ সালের নভেম্বরে যাত্রা শুরু সংক্ষিপ্ত পরিসরে। ১২০০ বর্গফুট বিশিষ্ট ভবনের নিচতলায় একটি কক্ষে তখন বই ছিল মাত্র ৩০০টি।

১৯৬৮ সালে ১৪ হাজার বই নিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে গ্রন্থাগারটির পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কিছুদিনের জন্য গ্রন্থাগারটি বর্তমান প্রশাসনিক ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। বর্তমানে ৫৬ হাজার ৭০০ বর্গফুট পরিমিত গ্রন্থাগারের অবস্থান হলো কলা অনুষদের দক্ষিণ পাশে চাকসু ভবনের পূর্ব পাশে ও দৃষ্টিনন্দন আইটি ভবনের পশ্চিম পাশে।

আধুনিক ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারটি ১৯৯০ সালে উদ্বোধন করেন তৎকালীন উপাচার্য আলমগীর মো. সিরাজ উদ্দিন। গ্রন্থাগার ভবনে কলা, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, সমাজবিজ্ঞান, আইন অনুষদের পৃথক পাঠকক্ষ রয়েছে। গ্রন্থাগারের সংগৃহীত পাঠ-সামগ্রীকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে আছে, প্রধান সংগ্রহ, জার্নাল সংগ্রহ রেফারেন্স সংগ্রহ, চবি প্রশাসন থিসিস দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ। জার্নাল শাখায় দেশি-বিদেশি প্রকাশিত সাময়িকী। পুরনো সংখ্যাগুলো বাঁধাই করে ডিডিপি পদ্ধতি অনুসরণ করে সাজিয়ে রাখা হয়।

রেফারেন্স শাখায় রয়েছে গবেষণা রিপোর্ট, বিশ্বকোষ অভিধান, হ্যান্ডবুক, ম্যানুয়েল, পঞ্জিকা, এনজিও প্রকাশনা, আইএলও ইউনেস্কো, বিশ্বব্যাংক আইএমএফ, ইউনিসেফ বিবিএস, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা। গ্রন্থাগারের দুষ্প্রাপ্য ও পাণ্ডুলিপি শাখায় এমন কতগুলো সংগ্রহ আছে যেগুলো প্রাচীন ভুজপত্র, তানপত্র, তুনট কাগজে লেখা। এই শাখায় রয়েছে গবেষকদের গবেষণাকর্মের উপাত্ত হিসেবে চিহ্নিত প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, দুর্লভ বই, দলিল।

দুষ্প্রাপ্য শাখায় এমন কিছু সংগ্রহ আছে, যা বাংলাদেশের অন্য কোনো গ্রন্থাগারে নেই। এখানে ১৮৭২ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রকাশিত পুরনো সাময়িকী আছে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অঞ্জলি, অনুসন্ধান পূর্ব পাকিস্তান, অগ্রগতি, সীমান্ত, পূরবী, পাঞ্জজন সাধনা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, প্রবাসী ভাণ্ডার প্রতিভা, প্রকৃতি, ঢাকা রিভিউ, পূর্ণিমা ছায়াবীথি, বার্তাবহ, সাপ্তাহিক এডুকেশন গেজেট, আলো ইসলাম প্রচারক, আল-ইসলাম, ভারতী মার্যাব্রু ইত্যাদি।

চবির গর্ব সমৃদ্ধ তিনটি জাদুঘর

চবিতে আছে গর্ব করার মতো সমৃদ্ধ তিনটি জাদুঘর।  গ্রন্থাগারের কোলঘেঁষে নব্বইয়ের দশকে গড়ে উঠেছে এখানকার সমৃদ্ধ ও বৃহত্তম জাদুঘরটি। ছোট টিলার ওপর স্থাপিত এ জাদুঘরে ঢুকতেই চোখে পড়বে হাজার বছর পুরনো গাছের ফসিল। নিচতলায় রয়েছে গবেষণা কেন্দ্র ও আলোকচিত্র স্টুডিও, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাগার, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ কোষ গ্রন্থাগার। তৃতীয় তলায় আছে পাঁচটি গ্যালারি।

প্রথমটি ‘প্রাক-ঐতিহাসিক গ্যালারি’। আছে মাছের ফসিল, বৌদ্ধবিহারের নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন, সপ্তম শতাব্দীর কুমিল্লা কোটবাড়ি থেকে সংগৃহীত ল্যাম্পস্ট্যান্ড, কোটবাড়ির পোড়ামাটির ফলক, সোমপুর বিহারের পোড়ামাটির ফলক।

দ্বিতীয়টির নাম ‘ভাস্কর্য গ্যালারি’। এ গ্যালারিতে আছে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম শতাব্দীর কষ্টিপাথরের ভাস্কর্য। তৃতীয়টির নাম ‘ইসলামিক শিল্পকলা গ্যালারি’। এ গ্যালারিতে রয়েছে হাতে লেখা কোরআন শরিফ, নকশে সেলেমানি, পাণ্ডুলিপি লেখার সরঞ্জাম, মধ্যযুগের অস্ত্রশস্ত্র, কামান, কাব্য সংকলন, ১২০৯ সালের আলমগীরনামা, ফারসি ভাষার গুলিস্তা, ১২২৯-৩৬ সালের কাবিননামা, ১০৬১ হিজরিতে লেখা মেপতাহুস সালাত, ফিরোজ শাহ-মোবারক শাহ-ইলিয়াস শাহ-মাহমুদ শাহ-সম্রাট আওরঙ্গজেব এবং আকবরের আমলের পুরনো পয়সা।

চতুর্থ গ্যালারি ‘লোকশিল্প গ্যালারি’। এখানে আছে রথযাত্রার দৃশ্যাবলি, নিদ্রারত কুম্ভকর্ণ, শ্রীকৃষ্ণের জীবনচিত্র, রাম-রাবণের দুধের দৃশ্যাবলি, হাতির দাঁতের পাখি, রাজকীয় লাঠির মাথা, তাঁতশিল্প, মধ্যযুগের অলঙ্কার, হাঁসুলি, কোমরের চেইন, প্রথম যুগের সিরামিক, হাতপাখা, কলের গান ও বাঘের মাথা। পঞ্চমটি ‘আর্ট গ্যালারি’। এখানে আছে বর্তমান যুগের চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, মর্তুজা বশির, এস এম সুলতান, হাশেম খান ও আবদুর রশিদের নানা চিত্রকর্ম।

চবিতে আছে আরও দুটি জাদুঘর। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের পাঠক্রমের সমর্থনে রয়েছে একটি জাদুঘর (প্রাণিবিদ্যা জাদুঘর)। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের পাঠক্রমের সমর্থনে একটি সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ জাদুঘরটি স্থাপিত হয়। এই জাদুঘরে প্রায় ৫৪০টি নমুনা সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে প্রাণীর সংখ্যা ৫৭টি এবং ফরমালিন (ভেজাসংরক্ষিত) নমুনার সংখ্যা ৪৮৫টি।

অপরটি হলো সমুদ্র সম্পদ জাদুঘর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরই সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের একটি রুমে গড়ে তোলা হয়েছে এ জাদুঘর। এখানে ৫৫০টির মতো সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণ করা হয়েছে। হাঙ্গর থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক মাছ, আজব বাণাকেল, অক্টোপাস, শামুক, সাপসহ রয়েছে অসংখ্য বিস্ময়কর জীববৈচিত্র।

সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য

জীববৈচিত্র্যের অপার সম্ভাবনাময় এক প্রাকৃতিক আধার হচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সর্বশেষ তথ্য মতে, এখানে বসবাস করছে ৩০৮ প্রজাতির বণ্যপ্রাণী। এর মধ্যে পাখি রয়েছে ২১৫ প্রজাতির। ব্যাঙ রয়েছে ১৭ প্রজাতির, সরীসৃপ রয়েছে ৫৬ প্রজাতির ও স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে ২০ প্রজাতির।

ক্যাম্পাসের অসংখ্য গাছপালা ও তৎসংলগ্ন ঝোপঝাড় যেন বন্যপ্রাণীর জন্য অভয়াশ্রম। এই অপরূপ জীববৈচিত্র্যের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্যপ্রাণীরা যেভাবে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায় সেটা বিশ্বের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় না। বন্যশূকর, সজারু, বনরুই, মায়া হরিণ, বিভিন্ন প্রজাতির সাপসহ অন্যান্য প্রাণীর দেখা মেলে। ক্যাম্পাসে হাঁটলে বিরল প্রজাতির গিরগিটি ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী চোখে পড়ে। 

ক্যাম্পাস যেন পাখির রাজ্য। বন মোরগ, মথুরা, সবুজ তাউরা, কাঠ শালিক, রেড হেডেড, ভীমরাজ, হাঁড়িচাচা, কানাকোয়া, কাবাসি, চন্দনা টিয়া, মদন টিয়া, কানাকুয়া, শিষধামা, হলদে বক, মালকোহা, পাকড়া মাছরাঙা, বসন্ত বাউরি, রুপাস নেকড, বেনেবউ এবং মৌটুসীসহ ২১৫ প্রজাতির পাখি রাজত্ব করে এই ক্যাম্পাসে। ২১৫ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১০৮টি গায়ক ও ১০৭টি অগায়ক পাখি। এগুলোর মধ্যে আবার ১৬০টি প্রজাতির পাখির স্থায়ী নিবাস ক্যাম্পাসেই। ৫১টি অতিথি পাখি হিসেবে বিভিন্ন মৌসুমে ক্যাম্পাসে আসে, আবার চলে যায়। চার প্রজাতির পাখি মাঝেমধ্যে এসে ঘুরে যায়। মজার বিষয় হচ্ছে প্রাণীর আরেক অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ২০ প্রজাতির বেশি প্রাণী এই ক্যাম্পাসের বাসিন্দা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য বিরল প্রজাতির গাছ-গাছালি আর জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজের হাতছানি। পাহাড়ের ওপর ফুল, ফল আর কাঠ জাতীয় গাছের শোভা ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট এবং উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাম্পাসে পাহাড় ও পাহাড়ি বন আছে ২৫০ একর জায়গায়। ৬০০ একরজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সৃজিত বন। ১৫০ একর ভূমির মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদ উদ্যান।

সমস্যা-সংকটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আবাসনের স্বল্পতা, আছে সেশনজট

আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় ক্যাম্পাস হয়েও পর্যাপ্ত আবাসিক সুবিধা না থাকায় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ইউজিসির ৪৬ তম প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) মোট শিক্ষার্থীর ৭৯ শতাংশেরই নেই আবাসন ব্যবস্থা। অর্থাৎ, মাত্র ২১ শতাংশ শিক্ষার্থীর রয়েছে হলে থাকার সুবিধা। অন্যদিকে চবির হলের রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম হয়। তাছাড়া হলের ডাইনিংগুলোতে দাম অনুযায়ী মানসম্মত ও পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের রয়েছে অপ্রতুলতা। দেশের উচ্চশিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাপীঠ হওয়া সত্ত্বেও চবিতে এখনও অনেক বিভাগ, অনুষদ ও ইনস্টিটিউটে রয়েছে সেশনজট। 

নেই টিএসসি

দেশের উচ্চশিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং চারটি পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হয়েও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র—টিএসসি। অথচ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে, মুক্তচিন্তার ধারাকে বিকশিত করতে, গবেষণায় এগিয়ে যেতে টিএসসি কার্যকর ভূমিকা রাখে। এ কারণে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর থেকে চবি তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। 

লাইব্রেরি নিয়ে নানা অভিযোগ, গবেষণা কম

চবিতে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির কালাকানুন নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের শেষ নেই। অথচ চবির এই লাইব্রেরি দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি। কিন্তু এখানে শিক্ষার্থীদের প্রবেশে এবং লাইব্রেরি সুবিধা নিতে হয়রানির শিকার হতে হয়। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন ও কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিত অভিযোগও দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হলো গবেষণা। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গবেষণায় চবি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে গবেষণার সঙ্গে ‌শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট করতে হবে, গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।

ভোগান্তির আরেক নাম শাটল ট্রেন

শাটল ট্রেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণসঞ্চারের জায়গা। এ শাটল পিটিয়েই এখান থেকে জন্মেছেন পার্থ বড়ুয়া, এস আই টুটুলরা। কিন্তু শিক্ষার্থী অনুপাতে শাটলে রয়েছে বগি সংকট, রয়েছে স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অভাব। দেখা যায়, শাটলের ভেতরে ফ্যান থাকলেও সে ফ্যান ঘুরে না, লাইট জ্বলে না, নেই কোনো টয়লেটের ব্যবস্থা। তাছাড়া দীর্ঘ এতো বছর পরও শাটলে বগির সংখ্যা বাড়েনি। অথচ শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়েছে। আর এতে শিক্ষার্থীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সম্প্রতি শাটল ট্রেনের ভেতরে সিট না পেয়ে ছাদে ওঠে সেখান থেকে পড়ে গিয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী।

নেই ফুটওভার ব্রিজ, আছে স্থানীয়দের দাপট

চবিতে প্রবেশের মূলফটক এক‌ নম্বর গেটে রাস্তা পারাপারের জন্য নেই কোনো ফুটওভারব্রিজ। প্রায় রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে এখানে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। কয়েকমাস আগেও এমন একটা সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। অনাঙ্ক্ষিত মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে এখানে একটি ফুটওভারব্রিজ নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া স্থানীয় ‌জোবরা এলাকাবাসীদের হাতে‌ এখানকার সাধারণ ‌শিক্ষার্থীরা অনেকটাই জিম্মি। স্থানীয় বাড়িওয়ালা, সিএনজি চালক, রিক্সা চালক, দোকানিরা যেভাবে ইচ্ছা যাচ্ছেতাই স্বেচ্ছাচারিভাবে বাড়িভাড়া, গাড়িভাড়া, খাওয়ার দাম নির্ধারণ করে চলেছে। অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে সবকিছু সুলভমূল্যে শিক্ষার্থীদের নাগালের মধ্যে থাকার কথা। যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্ধারণ করে দেয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এমন দুর্ভোগ যেন দেখার কেউ নেই! ফলে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে অবিরত। 

সমাবর্তন কি আর হবে না?

সমাবর্তন অনুষ্ঠান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের কাছে এ অনুষ্ঠান অত্যন্ত আবেগের ও মর্যাদার। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, দেশের এই শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়টির ৫৭ বছরে সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়েছে মাত্র ৪টি! এক্ষেত্রে চবি এতো পিছিয়ে আছে কেন! গত চার বছর উপাচার্য বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেনি।

৩৩ বছরেও হয়নি চাকসু নির্বাচন

১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) প্রথম নির্বাচন। প্রতিষ্ঠার ৫৭ বছরে মাত্র ৬ বার অনুষ্ঠিত হয়েছে এ নির্বাচন। সর্বশেষ ১৯৯০ সালে চাকসু নির্বাচনের পর দীর্ঘ ৩৩ বছর কেটে গেলেও এ নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি কর্তৃপক্ষের। ফলে অচলাবস্থায় আছে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের এই সংসদটি। অথচ শিক্ষার্থীদের নানাবিধ সমস্যা, শিক্ষার মান, অধিকার আদায়ে নেতৃত্ব প্রদান, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চা এবং নতুন নেতৃত্ব তৈরির মাধ্যমে জাতীয় জীবনে ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অবদান রাখতে সক্ষম ব্যক্তিত্ব তৈরীর মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল চাকসু। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে অন্যান্য সংগঠনগুলোর নির্বাচন আয়োজন করলেও চাকসু নির্বাচনে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। বরং নানা অজুহাতে বিষয়টি এড়িয়ে যান সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। 

চাকসু নির্বাচন নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এবং ছাত্র সংগঠনের নেতাদের  মাঝেও হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ছাত্র সংসদ না থাকায় শিক্ষার্থীদের অধিকারগুলো যথাযথভাবে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর ও আদায় করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন তারা।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়