চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
‘পাওয়ারফুল’ শিক্ষক, পাহাড়সম অনিয়ম!
রেফায়েত উল্যাহ রুপক, চবি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সমুদ্রবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম সরকার। তিনি আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক উপকমিটির সদস্য। জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোর বিরোধী থাকায় ওশানোগ্রাফি বিভাগ থেকে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন বিভাগটির শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের কুপ্রস্তাব, যৌন হয়রানিসহ নানা কারণে সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি। এছাড়া জোরপূর্বক বিভাগের আসবাবপত্র দখল, অফিসরুম দলীয়করণ এবং নিয়মবহির্ভূতভাবে ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে স্কলারশিপের আবেদনসহ নানা ‘অনৈতিক’ কাজ করার মতো অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
সবশেষ ২৬ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (অ্যাকাডেমিক) অধ্যাপক ড. শামীম উদ্দিন খান ওশানোগ্রাফি বিভাগে পরিদর্শনে আসেন। তবে উপ-উপাচার্যের আসার আগমুহূর্তে সাইদুল ইসলামের বিভাগে দেরিতে আসার কারণ জিজ্ঞেস করেন অধ্যাপক ড. মোসলেম উদ্দিন। সঙ্গে সঙ্গেই মোসলেম উদ্দিনের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম সরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের সভাপতির কক্ষে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) জানাজানি হয়। সেদিনের ঘটনার ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ‘‘ননসেন্স তো তুই। তুই প্রফেসরগিরি দেখাস আমার সাথে! ফাজিল কোথাকার! তুই আমাকে বেয়াদব বললি কেন? তুই বেয়াদব বলার কে? শামীম উদ্দিন খান (উপ–উপাচার্য) কে?’ এসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন সাইদুল ইসলাম সরকার। আর এসব বলতে বলতে সাইদুল ইসলাম বার বার অধ্যাপক মোসলেম উদ্দিনের দিকে তেড়ে যান।’’
এ ঘটনার প্রেক্ষিতে সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম সরকারকে চরিত্রহীন, দুষ্কৃতকারী ও ফ্যাসিস্ট শিক্ষক দাবি করে উপাচার্য বরাবর আবেদন করেছেন একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন। এছাড়া আবেদনে তাকে (সাইদুল) যথাযথ শাস্তির আওতায় এনে পরবর্তী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বহিষ্কারের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন অধ্যাপক ড. মোসলেম।
তবে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম সরকার। উল্টো এসব কারণে তাঁর ‘মানহানি’ হয়েছে বলে দাবি তার।
'অবৈধ সম্পর্ক’ ও যৌন হয়রানি
অধ্যাপক ড. মোসলেম তাঁর আবেদনে উল্লেখ করেছেন, প্রীতিলতা হলের হাউজ টিউটর থাকাবস্থায় সাইদুল ইসলাম সরকার হলের এক ছাত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক তৈরি করেন। ‘অনৈতিক’ কথোপকথনের রেকর্ডসহ সাইদুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন ওই শিক্ষার্থী। অভিযোগ পেয়ে তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তৎকালীন ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের অ্যাকাডেমিক কমিটি প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে ‘গুরুতর অপরাধী’ হিসেবে সাইদুলকে সকল কার্যক্রম থেকে বাদ দিয়েছিল। কিন্তু অপরাধ প্রমাণিত হলেও তৎকালীন গঠিত কমিটি রাজনৈতিক বিবেচনায় নৈতিক স্খলনে কার্যক্রম থেকে বাদ দিয়ে অপরাধীকে সতর্ক করার পরামর্শ দিয়ে রিপোর্ট করেছিল। যা অত্যন্ত গর্হিত ও ন্যক্কারজনক পদক্ষেপ ছিল। ২০১৭ সালে সাইদুলের কুপ্রস্তাব থেকে বাঁচতে আরেক শিক্ষার্থী বিভাগ ছেড়ে চলে যায় বলে উল্লেখ করা হয়।
অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার বিষয়ে সত্যতা জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের পরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ আফতাব উদ্দিন বলেন, ‘এটা তো অনেক দিন আগের কথা। যতটুকু মনে আছে কিছুদিনের জন্য তাকে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা হয়েছিল।’
তদন্ত কমিটির সদস্য তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও চবির মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর বলেন, ‘সাইদুল ইসলাম সরকারের বিরুদ্ধে প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম স্যারের সময় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এরপর আমাদের তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে ৬ মাসের বেশি সময় লাগে। পরবর্তীতে আমরা প্রফেসর ইফতেখার স্যারের আমলে রিপোর্ট পেশ করি। এতে আমরা বিভিন্ন ফ্যাক্ট চেক করে কয়েকটি সুপারিশ প্রদান করি। সাইদুল ইসলাম সরকারের এই যে স্খলন সেটার বিরুদ্ধে আমরা বলেছিলাম— যতই সে বিয়ে করুক মেয়েটাকে, একজন শিক্ষক এটা করতে পারেন না। একজন শিক্ষক তার ছাত্রীকে বিয়ে করার কারণ কি! যেহেতু তার স্ত্রী আছে, বাচ্চাও আছে।’ তবে আইনত আমরা কিছু করতে পারি না। কারণ কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে সে মেয়েটিকে বিয়ে করেছে। তাই আমরা তার বিরুদ্ধে অন্য কোন ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করতে পারিনি।’
জোরপূর্বক বিভাগের আসবাবপত্র দখল
সাইদুল ইসলাম সরকার বিভাগের আসবাবপত্র জোরপূর্বক দখল করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন অধ্যাপক মোসলেম উদ্দিন। আবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে সামান্য এস্টাব্লিশমেন্ট বাজেট এনে ওশানোগ্রাফি বিভাগের তৎকালীন সভাপতি বিভাগের অফিসের জন্য কিছু স্টিলের ফার্নিচার কেনেন সাইদুল ইসলাম সরকার। সেগুলো জোরপূর্বক করে তার রুমে ঢুকিয়ে ফেলেন এবং নিজের দখলে রেখেছেন।
পরে নতুন বিল্ডিংয়ে স্থানান্তরিত হলেও তিনি আগের সব ফার্নিচার তালাবন্ধ করে রাখেন। আর নতুন রুমের ফার্নিচারও তার দখলে রেখে দেন। এছাড়াও, একটা ল্যাবের সবগুলো চাবিও নিয়ে নিজের দখলে রেখেছেন। অথচ নতুনরা ফার্নিচার ও রুম না পেয়ে এক রুমে দুজন ফার্নিচার শেয়ার করে অফিস করছেন।
এ বিষয়ে সমুদ্রবিদ্যা বিভাগের সভাপতি ড. অহিদুল আলম বলেন, ‘আমরা তো নতুন বিল্ডিং এ চলে এসেছি; আমাদের নতুন কলিগ জয়েন করেছেন। আগে আমরা ৪ জন ছিলাম; এখন হয়েছি ৮ জন। যারা নতুন জয়েন করেছেন; তাদের জন্য আলাদা রুম নাই। আমাদের পুরাতন ফার্নিচারগুলো নতুন কলিগদের দিয়ে দিয়েছি। সাইদুল স্যার যিনি; তিনি এখনো দেয়নি। তবে উনি বলেছেন, দিয়ে দিবেন। এইটুকুই আরকি।’
মিথ্যা তথ্য দিয়ে স্কলারশিপের আবেদন
অধ্যাপক মোসলেম উদ্দিন অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন, সাইদুল ইসলাম সরকার সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূতভাবে ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে মেরিন সায়েন্সস এন্ড ফিশারিজের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রজেক্ট থেকে উচ্চ শিক্ষার স্কলারশিপের টাকা পাশ করিয়েছেন ‘অপকৌশলে’।
মেরিন সায়েন্সস এন্ড ফিশারিজ অনুষদের তৎকালীন ডিন অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘তিনি কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। এরপর কমিটি যাচাই-বাছাই করেই স্কলারশিপের জন্য তাকে বিবেচিত করেছেন। উনার সাথে আরো দু’একজন স্কলারশিপ পেয়েছেন। এটার জন্য একটা কমিটি আছে; ওই কমিটির সদস্যরাই তথ্য, কাগজপত্র দেখে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেন কারা স্কলারশিপ পাবেন।’
অফিস রুমকে দলীয়করণ
বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র শিক্ষকতা ও গবেষণা পেশাকে জলাঞ্জলি দিয়ে সাইদুল সরকার এত বেশি দলীয়করণে মত্ত ছিলেন যে, নিজের অ্যাকাডেমিক রুমকে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দলীয় অফিস রুম বানিয়ে রেখেছেন। এছাড়াও, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় সাইদুলের রুমেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের মিটিংয়ের অবাধ ব্যবস্থা ছিল বলেও অধ্যাপক ড. মোসলেম উদ্দিনে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, ‘সাইদুল স্যার রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ঠিকমতো ক্লাস নিতেন না। রমজান মাস এলেই তিনি ৫-৬ দিন টানা ক্লাস নিয়ে ক্লাস শেষ করে দিতেন। আর বেশির ভাগ রাতে ক্লাস নেন। ডিপার্টমেন্টে উনার রুমে নিয়মিতই ছাত্রলীগের ছেলেরা আসা যাওয়া করতো। ওদের কথা শুনে আমাদের বিভিন্ন সময় হুমকিও দিতেন।’
অ্যাকাডেমিক কমিটি অনুমোদিত রুটিন ছিঁড়ে ফেলা
সাইদুল ইসলাম সরকার অ্যাকাডেমিক কমিটির নিয়ম মানতেন না। অনুমোদিত রুটিন ছিঁড়ে ফেলে নিজের ইচ্ছে-সময়মত ক্লাস পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দেন। এছাড়াও, পরীক্ষার হলে ২০/৩০ মিনিটের বেশি ডিউটি দিতেন না। অথচ বিলের জন্য স্টাফদের রুমে ডেকে নিয়ে ডিউটি রোস্টারে সিগনেচার করতেন বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
অ্যাকাডেমিক কমিটি অনুমোদিত রুটিন ছিঁড়ে ফেলার বিষয়ে জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমি একটু দেখতে হবে বিষয়টা, এটা দেখা ছাড়া বলা যাবে না।’
সহকর্মীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ
সমুদ্রবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম সরকার সহকর্মীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন বলে আবেদনে উল্লেখ করেন অধ্যাপক ড. মোসলেম। সেখানে বলা হয়েছে, ‘মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী ও ফিশারিজের অধ্যাপক ড. রাশেদ উন নবীকে প্রায় অসম্মান ও অবজ্ঞা করে উপস্থাপন করতেন সমুদ্রবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম সরকার। এছাড়াও, ওশানোগ্রাফি বিভাগের বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক ড. অহিদুল আলম, সহযোগী অধ্যাপক এনামুল হকের সাথে ইতোমধ্যে একাধিকবার অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন তিনি। মারার জন্য বারবার গায়ের দিকেও তেড়ে যান। বিপ্লবের আগে মেরিন সায়েন্সের বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ আফতাব উদ্দিনের দিকেও তেড়ে গিয়েছিলেন।’’
এ বিষয়ের সত্যতা জানতে চাইলে মেরিন সায়েন্সের বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ আফতাব উদ্দিন বলেন, ‘এটা তো ফ্রিকুয়েন্টলি ঘটে। ও করে এটা। ও করে এগুলি।’
সমুদ্রবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. এনামুল হক বলেন, ‘উনি অ্যাকাডেমিকভাবে আমাদের সিনিয়র। তবে চাকুরিতে আমাদের পরে জয়েন করেছেন। তারপরও আমরা যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করি মেইনটেইন করার। চলার পথে কিছু ঘটনা ঘটে। এটা যা হওয়ার হয়ে গেছে। এটা সিরিয়াস কিছু না। আমি এগুলো কিছু মনে রাখিনি।’
শিক্ষার্থীদের সাথে ‘বেপরোয়া’ আচরণ
অভিযোগপত্রে আরো উল্লেখ রয়েছে, সাইদুল ইসলাম সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে অত্যন্ত ‘বেপরোয়া’ আচরণ করেন এবং ‘তুই-তোকারি’ সম্বোধন করেন। সাংস্কৃতিক ফিল্ড ওয়ার্কে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার নামে গবেষণার কাজ বাদ দিয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে সময় কাটাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমুদ্রবিদ্যা বিভাগের ৩য় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘উনি ঠিক মতো ক্লাস নেন না। উনার অ্যাকাডেমিক বলেন কিংবা অন্য কোন দিক কিছুই ঠিক নেই। তবে আমাদের সাথে রূঢ় বলতে শুধু তিনি তুই করে ডাকেন। উনার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ শুনি।’
শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম
সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম সরকার মেরিন সাইন্সেস ইনস্টিটিউট এবং ওশানোগ্রাফি বিভাগের নিয়োগে অনিয়ম ও লেনদেনের সাথে সংশ্লিষ্ট চবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের ক্যাশিয়ার ও সমন্বয়কারীদের অন্যতম সহযোগী ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। চবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের বিরুদ্ধে অবৈধ ও অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। অনেকের মতে, এসব নিয়োগ বাণিজ্য করতে তিনি একটি সিন্ডিকেট ও বলয় তৈরি করেছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাপক শিরীণের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
উপাচার্য, উপ-উপাচার্যকে নিয়ে কটূক্তি
অভিযোগপত্রে উল্লেখ বলা হয়েছে, সবশেষ গত ২৬ নভেম্বর ওশানোগ্রাফি বিভাগে চবির সম্মানিত উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. শামীম উদ্দিন খান স্যার নিয়মিত ভিজিটে আসার আগ মুহূর্তে বিভাগে দেরিতে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতেই অধ্যাপক ড. মোসলেম উদ্দিনের সাথে গালিগালাজ, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন। এছাড়া দেখে নেয়ার হুমকিধমকি দেয় এবং এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ডিসি/প্রোভিসিদের নিয়েও অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষায় কটূক্তি করেন।
ওই ঘটনায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সাইদুল ইসলাম সরকার এবং অধ্যাপক ড. মোসলেম উদ্দিনের মাঝে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করতে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিরোধিতা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলনে সহকারী অধ্যাপক সাইদুলের সরাসরি বিরোধিতা করেছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক ড. মোসলেম। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলনে তিনি (সাইদুল) সরাসরি বিরোধিতা করার অপরাধে শিক্ষার্থীরা তাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফ্যাকাল্টিতে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেন। প্রায় একমাস আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে বিষয়টি ‘শান্ত’ হলে তিনি স্বশরীরে অফিসে যাতায়াতসহ স্বাভাবিক হওয়ার পাঁয়তারা করা শুরু করেন।
মেরিন সাইন্সেস এন্ড ফিশারিজ অনুষদের ফিশারিজ বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে উনার নেতিবাচক ভূমিকার জন্য ফ্যাকাল্টি থেকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করি। অতীতেও উনার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ছিল।’
সুষ্ঠু তদন্তে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ অধ্যাপক ড. মোসলেমের
সমুদ্রবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম সরকার বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগপত্র সুষ্ঠু তদন্ত করা হোক। তদন্ত সাপেক্ষে তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন।
জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘অতীতেও তাঁর (সাইদুল) বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছিল। সর্বশেষ যে ঘটনা ঘটেছে; এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জমা দিয়েছি। সুষ্ঠু তদন্ত করে সাইদুলের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করছি।’
অভিযোগ অস্বীকার
তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন চবি সমুদ্রবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম সরকার। তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালের নারী কেলেঙ্কারিজনিত বিষয়টি নিতান্তই একটি ষড়যন্ত্রমূলক, মিথ্যা বানোয়াট এবং ভিত্তিহীন। যা তদন্ত সাপেক্ষে সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলাম।’
ফার্নিচার দখল এবং বৃত্তির টাকা পাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি কোন ফার্নিচার দখল করে রাখিনি। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ। এছাড়াও, আমি এখনো কোনো বৃত্তির টাকা পাইনি। দ্বিতীয়ত আমি ওশানোগ্রাফি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছি এবং সেই ডকুমেন্টস দিয়ে এপ্লিকেশন করেছি।’
রুটিন ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগটিও সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম সরকার। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র শিক্ষক আমি; যথাসময়ে সবার আগে সব চেয়ে বেশি সংখ্যক ক্লাস নিয়ে কোর্স শেষ করে দেই। পরীক্ষা কমিটির সভাপতিকে সবার আগে প্রশ্ন এবং পরীক্ষার খাতা কেটে কমিটির সভাপতিকে জমা দিয়ে দেই। যথাসময়ে ক্লাশ, টিউটোরিয়াল, ব্যবহারিক পরীক্ষার সবকিছু করে ফেলি। যার ফলে একাডেমিক কার্যক্রম নিয়ে কোন অভিযোগ তোলা যায় না।’
তিনি নন; অধ্যাপক মোছলেম উদ্দিনই তাঁর সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক সাইদুল সরকার। তিনি বলেন, ‘যে ভিডিও অধ্যাপক মোছলেম উদ্দিন মুন্না ভাইরাল করেছে; তাতে দয়া করে একটু খেয়াল করে দেখবেন— অধ্যাপক মোছলেম উদ্দিন মুন্না আমাকে ননসেন্স, বেয়াদব বলেছে। বয়সে আমার চেয়ে ছোট হাওয়ার পরও আমাকে তুই-তোকারি করেছে। ভিডিও’তে সে নিজেও স্বীকার করেছে— সে আমাকে বেয়াদব বলেছে। সে সাবেক সফল উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী স্যারকেও বেয়াদব বলেছে।’
ভিডিও’র কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘নানা বিষয় টেনে এনে সে (মোসলেম) আমাকে বারবার উত্তেজিত করেছে। আমি বলেছি, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন স্যারকে আমি বিষয়টি বলব। অথচ সে এটাকে ভিডিওতে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছে। আমাকে দোষী বানানোর জন্য বারবার স্যারের নাম নিয়ে কথা বলেছে। আমাকে বিভিন্ন উপায়ে রাগানোর চেষ্টা করেছে।’
সহকর্মীদের সঙ্গে খারাপ আচরণের অভিযোগ মিথ্যা, ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট
সহকর্মীদের (শিক্ষক) সঙ্গে খারাপ আচরণের অভিযোগ মিথ্যা, ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট বলে দাবি করেছেন সমুদ্রবিদ্যা বিভাগের বর্তমান সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম সরকার। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জননেত্রী পরিষদ নামে কোন পরিষদ নেই। এটা একটা মিথ্যা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ। এখানে যেসব শিক্ষকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের অনেকেই ২০১৪ সালের আমার বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্রের কুশিলবদের অংশ। কাজেই তারা কখনোই আমার পক্ষে কথা বলবে না। এদের কেউ কেউ আমার সাথে এমন আচরণও করেছিল; যার প্রেক্ষিতে আমি নিরাপত্তা চেয়ে উপাচার্য বরাবর চিঠিও দিয়েছিলাম।’
তিনি আরো বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আমার সাথে মিশতে পারে এবং আমার সাথে সবকিছু শেয়ার করতে পারে। আমি অন্যান্য শিক্ষকদের তুলনায় সবসময় শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে সফলতম এবং প্রিয় শিক্ষক হিসেবে পরিগণিত।’
বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনের তাঁর একাত্মতা ছিল জানিয়েছেন সহকারী অধ্যাপক সাইদুল। তিনি বলেন, ‘শুধু আমি কেন; খোদ আওয়ামী লীগই এই কোটার বিপক্ষে ছিল। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ছিল আমার। আমরা আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালেই কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিলাম। এখানে বিরোধীতা হলো কিভাবে? বিষয়টি আমার বোধগম্য নয় এবং অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।’
ভিডিও ধারণের পর প্রচার করে মানহানি!
অনুমতি ছাড়া ভিডিও ধারণের পর প্রচার এবং মিথ্যা অভিযোগের মাধ্যমে সহকারী অধ্যাপক সাইদুলের মানহানি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘এসব অভিযোগের মাধ্যমে আমার মানহানি করা হয়েছে, সমাজে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে। আমার অনুমতি ছাড়া ভিডিও ধারণ করে অধ্যাপক মোছলেম উদ্দিন মুন্না সাইবার ক্রাইম এবং আইসিটি এ্যাক্ট লংঘন করেছে। তা প্রচার করে আমার মানহানি করেছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় আমাকে দেয়া বিভিন্ন সম্মাননা স্মারক আমি আমার রুমে সাজিয়ে রেখেছি। এটাকে কেন দলীয় অফিস বলা হলো, তা আমার বোধগম্য নয়। অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।’
অভিযোগের বিষয়ে চবির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘অভিযোগটি আমি গ্রহণ করেছি। এর কিছুক্ষণ পরই আমি এটি উপাচার্যের টেবিলে পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয় খুললে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিবেন উপাচার্য মহোদয়।’
ক্যাম্পাস সব খবর