Cvoice24.com

বিষফোঁড়া হয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা, ক্যাম্পে কমছে না অপরাধ কর্মকাণ্ড

আয়াছুল আলম সিফাত, কক্সবাজার

প্রকাশিত: ১৪:২৪, ২৩ অক্টোবর ২০২১
বিষফোঁড়া হয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা, ক্যাম্পে কমছে না অপরাধ কর্মকাণ্ড

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার জেরে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া এসব রোহিঙ্গা এখন বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। তুচ্ছ ঘটনা থেকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। প্রতিদিন ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে কোনো না কোনো ঘটনা ঘটে চলেছে। ক্যাম্পের ভেতরে জন্ম নিয়েছে ১৪টির বেশি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। প্রত্যাবাসনবিরোধী কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো মাদক, সোনা চোরাচালান, মুক্তিপণের জন্য অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি এমনকি খুনের মতো অপরাধের ঘটনায় জড়াচ্ছে। যার ফলে দিন দিন অস্থির হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো। এমনকি  ক্যাম্পে রাতে মুখোশধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বেড়েছে বলে জানান রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের এমন অপরাধ কর্মকাণ্ড ও সহিংস আচরণ রীতিমতো প্রশাসনকেও ভাবিয়ে তুলেছে।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে নিজ অফিসে আলোচিত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই ২৩ দিনের মাথায় একটি মাদরাসায় ঘুমন্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ ছয়জন নিহত হন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১২ জনের বেশি। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

নিহত রোহিঙ্গারা হলেন— মাদ্রাসার শিক্ষক ও হাফেজ মো. ইদ্রীস (৩২), ইব্রাহীম হোসেন (২২), ছাত্র আজিজুল হক (২৬), ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবক মো. আমীন (৩২), মাদ্রাসার শিক্ষক নুর আলম ওরফে হালিম (৪৫) ও মাদ্রাসার শিক্ষক হামিদুল্লাহ (৫৫)। এ ছাড়া নুর কায়সার (১৫) নামের আহত এক ছাত্রের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক পুলিশ সুপার (এসপি) শিহাব কায়সার জানান, বৃহস্পতিবার রাতে উখিয়া বালুখালী ১৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় গোলাগুলি এবং ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ঘটনাস্থলে চার রোহিঙ্গা নিহত হন। এ সময় আহত হন আরও ১০ থেকে ১২ জন। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে আরও দুজনের মৃত্যু হয়।

নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা  জানান, ভোর ৪টার দিকে ১২-১৫ জনের একটি সশস্ত্র গ্রুপ ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ মাদরাসার দিকে যান। তারা ওখানে পৌঁছানোর তিন মিনিট পর লাগাতার গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। ঘুমন্ত শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে গুলি ও জবাই করে সবমিলিয়ে ১০-১১ মিনিটের মধ্যেই হামলাকারীরা এলোপাতাড়ি গুলি করে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যান। 

হাবিব উল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গা জানান, গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে মুহিবুল্লাহ হত্যার পর মিয়ানমার সরকারের মদদপুষ্ট বিতর্কিত ও কথিত সশস্ত্র সংগঠন আরসারের চিহ্নিত সদস্যদের প্রতিরোধের ডাক দিয়ে সম্প্রতি ওই মাদারাসায় একটি সমাবেশ করে প্রত্যাবাসন প্রত্যাশী সাধারণ রোহিঙ্গারা। সেখানেই বক্তব্য দেন শুক্রবারের ঘটনায় নিহত মাদরাসা শিক্ষক হাফেজ ইদ্রিস। এজন্য তিনি ন্যক্কারজনক এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে ধারণা তার।

প্রত্যক্ষদর্শী রিয়াদ নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘কারা হামলা করেছে সেটা সবাই জানে। ক্যাম্পে আরসা ছাড়া কোনো সন্ত্রাসী নেই। তারাই হামলা করেছে। তারা গুলি করে মেরেছে।’

নাম প্রকাশ করতে ইচ্ছুক না এ রকম অনেক রোহিঙ্গা জানান, ক্যাম্পগুলোতে লোকজনের মধ্যে চাপা আতঙ্ক। সবার মনে একটা ভয় তৈরি হয়েছে যে, এর পর কী হয়। ক্যাম্পে আগেও যে কেউ খুন হয়নি তা নয়। কিন্তু এভাবে হত্যা করার ঘটনা তো আগে কখনও হয়নি। এখন সবাই একটা ভয়ের মধ্যে পড়ে গেছে।

তারা জানান, এবারের এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কারা জড়িত সে ব্যাপারে এখনো পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। তবে একটি সূত্র জানায়, মুহিবুল্লাহ হত্যার পর থেকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের তোপের মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়ে কথিত ‘আরসা’র পরিচিত সদস্যরা।

রোহিঙ্গাদের আরেকটি সূত্রের দাবি, মুহিবুল্লাহ হত্যার পর থেকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের তোপের মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়ে কথিত ‘আরসা’র পরিচিত সদস্যরা। তারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে টেকনাফের হ্নীলার নয়াপাড়া মুছনি ক্যাম্পের পাহাড়ি এলাকায় স্থানীয় কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের আশ্রয়ে রয়েছে। ফয়েজউল্লা নামে এক ‘আরসা’র সদস্যকে সম্প্রতি বালুখালী ক্যাম্প থেকে ধরে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে দেয় রোহিঙ্গারা। প্রত্যাবাসনপ্রত্যাশী রোহিঙ্গারা একাট্টা হওয়ায় নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে দেখে ক্যাম্পে বড় ধরনের নাশকতার ছক তৈরি করে দুর্বৃত্ত রোহিঙ্গারা। এরই অংশ হিসেবে মাদরাসায় নারকীয় এই ঘটনা ঘটে বলে তারা দাবি করছেন।

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি আব্দুল হামিদ বলেন, ‘প্রত্যাবাসনের বদলে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের অপরাধী প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে মিয়ানমার সরকার। এজন্য তারা বিপথগামী রোহিঙ্গাদের দিয়ে ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলাটি প্রশ্নবিদ্ধ করায় তাদের লক্ষ্য। এজন্য বিশ্বে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে উপস্থাপনের সব রকম চেষ্টা চালানো হচ্ছে।’

কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিদিন ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে কোনো না কোনো ঘটনা ঘটছে। হঠাৎ সক্রিয় হয়েছে উঠেছে রোহিঙ্গা জঙ্গী সংগঠন আরসা আল ইয়াকিনের মতো সশস্ত্র গ্রুপ যাদের হাতে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ নিহত হয়েছেন। রোহিঙ্গা বিষয়টি এখন আর হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। ক্যাম্পগুলোতে আরো বেশি নজরদারি বাড়ানো জরুরি। একই সাথে দেশি বিদেশি এনজিও সংস্থাগুলোর উপর নজর দেওয়া জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতি আহবান থাকবে। যেভাবে দিন দিন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো সক্রিয় হয়ে উঠছে এতে একদিকে যেমন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হতে পারে তেমনি স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের জীবনযাত্রায় ভীতি সৃষ্টি হতে পারে।’

টেকনাফ উপজেলার চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, ‘কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির জন্য মূলত রোহিঙ্গারা দায়ী। এখানে যে পরিমাণ অপরাধ এখন হচ্ছে, তা অতীতে কখনও হয়নি। রোহিঙ্গারা ভাড়ায় খুন থেকে শুরু করে অপরাধমূলক নানা কাজে জড়িয়ে পড়ছে।’

ক্যাম্পে কর্মরত ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এবিপিএন) অধিনায়ক শিহাব কায়সার খান বলেন, ‘কী কারণে এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড তা এখনও স্পষ্ট নয়। আমাদের সদস্যরা অস্ত্রসহ মুজিব নামে একজনকে আটক করেছে। তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।’ ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। খুনিদের শনাক্ত ও ধরতে চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের অপরাধ দিনে দিনে বাড়ছে। গত চার বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে এক হাজার ৩০০ মামলা হয়েছে। এতে আসামি হয়েছে দুই হাজার ৮৭০ রোহিঙ্গা। অপরাধের মধ্যে রয়েছে— হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, অস্ত্র ও মাদক পাচার, মানবপাচার, পুলিশের ওপর হামলা ইত্যাদি।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চার বছরে ৭৬টি খুনের মামলা হয়েছে। এসময়ে ৭৬২টি মাদক, ২৮টি মানবপাচার, ৮৭টি অস্ত্র, ৬৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতির মামলা হয়েছে। ৩৪টি মামলা হয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের অপরাধে। অন্যান্য অপরাধে হয়েছে ৮৯টি মামলা। গেলো ৪৯ মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘর্ষের ঘটনায় ২৩৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৩৬০ জন। ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামি ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৬৩টি, আসামি ৬৪৯ জন। আর ২০২০ সালে ১৮৪টি মামলায় হয়েছে, আসামি ৪৪৯ জন।

রোহিঙ্গাদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ চলছে জানিয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গারা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে জেলা পুলিশের পাশপাশি ক্যাম্পে এপিবিএনের তিনটি ব্যাটালিয়ন কাজ করছে। পাশাপাশি র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ সেখানে কাজ করছে।’

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়