কক্সবাজারে ৫ বছরে প্যারাবনের লক্ষাধিক গাছ কেটে বসতি স্থাপন
কক্সবাজার প্রতিনিধি
কস্তুরাঘাট এলাকার প্যারাবনের প্রায় এক লাখ গাছ কেটে সাবাড় করেছে ভূমিদুস্যুরা।
বনবিভাগ, জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যালয় এবং থানার নাগালেই বাঁকখালী নদীতীরের অংশ কক্সবাজার শহরের কস্তুরাঘাট। অথচ গত পাঁচ বছরে প্রকাশ্যেই এই কস্তুরাঘাট এলাকার প্যারাবনের প্রায় এক লাখ গাছ কেটে সাবাড় করেছে ভূমিদুস্যুরা। সম্প্রতি একযোগে ৮ একর বনের প্রায় ৩০ হাজার গাছ কেটে দখল করা হয়েছে। যদিও দখলকারীরা বলছেন এসব জায়গা তাদের খতিয়ানভুক্ত। কিন্তু প্যারাবনের এক লাখ গাছ কর্তনের জবাব মিলছে না কারো কাছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘বেলা’র কর্মকতারা জানিয়েছেন, বাঁকখালী নদী তীরের প্যারাবন (ম্যানগ্রোভ) কেটে বসতবাড়ি ও অবকাঠামো নির্মাণের হোতারা হলেন- বদরমোকাম এলাকার মাওলানা আতিক উদ্দীনের তিনপুত্র। এদের নেতৃত্বে সম্প্রতি এক রাতেই প্রায় ৮ একর প্যারাবনের ৩০ হাজার গাছ কেটে রাতারাতি বসতবাড়ি তৈরি করা হয়েছে। এর আগেও এভাবে দফায় দফায় প্যারাবনের গাছ কেটে তৈরি করা হয়েছে অন্তত অর্ধশত পাকা-আধাপাকা বসতি। তবে প্রকাশ্যে নির্বিচারে গাছ কেটে এসব বসতি গড়া হলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
সর্বশেষ এক সাথে ৩০ হাজার গাছ কাটার ঘটনায় পরিবেশবাদীসহ সর্বমহলে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এতে চাপে পড়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। তারই প্রেক্ষিতে সপ্তাহ দেড়েক আগে একটি অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানে গাছ কাটা ও বসতি স্থাপনের মৌখিক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও কাউকে আইনের আওতায় আনা যায়নি। তাই অভিযান শেষ হওয়ার সাথে সাথে ভূমিদস্যুরা আবার ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে।
অন্যদিকে এক সাথে প্যারাবনের ৩০ হাজার গাছ কাটার ঘটনায় সরব হয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলা ও স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ইয়েস’। নির্বিচারে গাছ কাটার ঘটনায় গত ১৬ জানুয়ারি পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতির জবাব চেয়ে দুই সচিব ১২ সরকারি দপ্তরের প্রধানকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বদরমোকাম মসজিদ সংলগ্ন শ্মশান সড়কের দক্ষিণ পাশের প্যারাবনের গাছ কেটে প্রায় অর্ধশত বসতবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। এরপরে কস্তুরাঘাট সড়কের শুরু থেকে দীর্ঘস্থানে সম্প্রতি গাছ কাটা জায়গায় বসতবাড়ি ও ঘেরা-বেড়া তৈরি করা হয়েছে। গাছ উজাড় করা পুরো জায়গা টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে।
দখলকারীদের সাথে কথা বললে তারা জানায়, গণ্ডা হিসাবে তারা জায়গাগুলো কিনেছেন।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ইয়েস’র প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, প্রশাসনের নাকের ডগায় এই পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড চলছে। পরিবেশবাদী ও সচেতন শহরবাসীর দাবির মুখেও কার্যত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি প্রশাসন। উল্টো প্রশাসনকে এক প্রকার চ্যালেঞ্জ করেই ভয়াবহ আকারে কাটা হয়েছে প্যারাবন।
তিনি আরো বলেন, বনভূমি ধ্বংস, গাছ কেটে জলাধার দখল ও ভরাট কার্যক্রম দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাঁকখালী নদী তীরের এক রাতে ৮ একরের প্যারাবন দখল করে ৩০ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এই স্থানটি ২০৫ প্রজাতির পাখির আবাসস্থল। বিপুল সংখ্যক গাছ কাটার ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এই এলাকাটি মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান বলেন, কস্তুরাঘাট এলাকার প্যারাবনের বিপুল সংখ্যক গাছ কাটা হয়েছে। এই নিয়ে আগে আমরা মামলা করেছিলাম। তবে সম্প্রতি একযোগে গাছ কাটার ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি। প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।
এদিকে গাছ কেটে জায়গা দখলের হোতারা তাদের খতিয়ানভুক্ত জায়গা বলে যে দাবি করছে তা ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছেন পরিবেশবাধী সংগঠন বেলা। তারা বলছে, খতিয়ানের যে জায়গার দাবি করা হচ্ছে তার অবস্থান বর্তমানে যেখানে বাঁকখালী রয়েছে সেখানে। যেখানে প্যারাবন রয়েছে সেসব সৃজন করে খাস খতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত করেছে সরকার।
কক্সবাজার সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নু এমং মার্মা বলেন, খতিয়ান যাই হোক; প্যারাবনের গাছ কাটা অপরাধ। সে বিষয় সামনে নিয়ে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। ইতিমধ্যে মামলা হয়েছে। সম্প্রতি একযোগে বিপুল সংখ্যক গাছ কাটার ঘটনায়ও পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করছে বলে জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বেলার করা একটি মামলায় বাঁকখালী নদী ঘিরে সব স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।