Cvoice24.com

পাটকল শ্রমিকরা পাওনা মজুরি কবে পাবেন?

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১১:৫৭, ৬ মার্চ ২০২১
পাটকল শ্রমিকরা পাওনা মজুরি কবে পাবেন?

বাংলাদেশকে আবারও সোনালী আঁশের দেশ হিসেবে রূপান্তর করে পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ৬ মার্চ উদযাপন করা হয় ‘জাতীয় পাট দিবস’। পাটের সঙ্গে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি বিবেচনায় ২০১৬ সালে দিবসটি আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরের বছর থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এটি উদযাপিত হচ্ছে বিভিন্ন আয়োজনে। কিন্তু হারানো গৌরব ফেরানো তো দূরে থাক, উল্টো পাটশিল্পের এখন দুঃসময়। রাষ্ট্রায়ত্ত সব পাটকলই বন্ধ হয়েছে। ব্যক্তি খাতের কলগুলোও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। শ্রমিকরা পাচ্ছেন না তাদের পাওনা মজুরি। তার জন্য পেটে পাথর বেঁধে আন্দোলনেও নামতে হচ্ছে। 

ফজলুল হক। স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ে নিয়েই তার সংসার। কাজ করতেন নগরের আমিন জুট মিলস লিমিটেডের ফিনিশিং ডিপার্টমেন্টে। শ্রমিকদের সর্দার ছিলেনে তিনি। করোনার তাণ্ডবে গত বছরের ২ এপ্রিল বন্ধ হয়ে যায় মিলটি। কপাল পুড়ে তার মতো সব শ্রমিকেরই। এখনো খোলার নাম নেই মিলটির। তাই বাধ্য হয়েই দিনমজুরের কাজ করে বার্ধক্যকালেও সংসারের ঘানি টানতে হচ্ছে ফজলুল হককে। 

দেখা হয় ওই জুট মিলে কাজ করা অন্য এক শ্রমিক নুরুল হাকিমের সঙ্গে। প্রায় ১২ বছর তিনি এ শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। কিন্তু স্থায়ী শ্রমিক হতে পারেননি একযুগেও। তাই নানা সমস্যায় পড়ে অবশেষে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। শুধু ফজলুল হক কিংবা নুরুল হাকিমই নন, আমিন জুট মিলের প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিকের এমন করুণ অবস্থা।

রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের অধীনস্থ ২৬টি পাটকলের মধ্যে একটি আমিন জুট মিলস লিমিটেড। ৭৯ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত ভারি শিল্প-কমপ্লেক্সটি করোনা মহামারিকালে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকা প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ নগরে টিকতে না পেরে পাড়ি জমিয়েছেন গ্রামের বাড়ি। আর যারা নগরে আছেন, দিনমজুরের কাজ করেই চালাতে হচ্ছে সংসার।

শ্রমিকদের দেওয়া তথ্যানুসারে, আমিন জুট মিল লিমিটেডে পাঁচ হাজার শ্রমিকের মধ্যে স্থায়ী, বদলি ও দিনমজুরও রয়েছেন। যেখানে স্থায়ী শ্রমিকের পদ খালি থাকে সেখানে বদলি শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হয়। তাদের মধ্যে স্থায়ী শ্রমিক ছিল ১ হাজার ৭০০ জন। আর বদলি শ্রমিক ও দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন ৩ হাজারেরও অধিক, যারা সপ্তাহ হিসেবে মজুরি পেয়ে থাকেন। এই সপ্তাহ হিসাব করা হয় প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা করে ছয় দিনে মোট ৪৮ ঘণ্টা ধরে।

তবে বদলি শ্রমিকদের মাঝে রয়েছে চাপা ক্ষোভ। তারা বলছেন, একজন বদলি শ্রমিক টানা ৯০ দিন কাজ করলে তাদের স্থায়ী করার নির্দেশনা রয়েছে শ্রম আইনে। কিন্তু বছরের পর বছর কাজ করলেও তাদের স্থায়ী করা হয়নি বলে অভিযোগ করেন তারা। ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়ার আগে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পাটকলের স্থায়ী শ্রমিকদের দুই মাসের অগ্রিম বেতন দেওয়া হলেও বদলি শ্রমিকরা তা পাননি। 

শ্রমিকরা আরও জানান, সব সরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দিলেও, পাটকলের বদলি শ্রমিকেরা তা পাননি। তাছাড়া লকডাউনের মজুরিও দেওয়া হয়নি তাদের। অন্যদিকে যারা ৮০ দিন বা ১৬০ দিন টানা কাজ করবে সেই হিসাবে বোনাস দেওয়া হয়েছে গেল ঈদে। ওই সময়েও বদলি শ্রমিকেরা অবহেলিত ছিলেন। আবার স্থায়ী শ্রমিকদের তখন অর্ধেক বেতন নগদ দেওয়া হলেও বাকিটা সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে। কিন্তু বদলি শ্রমিকদের নগদ দেওয়ার কথা থাকলেও, তা এখনো পাননি। সেই মজুরি দেওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো সময়ও দেওয়া হচ্ছে না। ২০১৯ সালের মজুরি কমিশন বাস্তবায়নের পরে ৩ থেকে ৫ সপ্তাহের মজুরিও রয়েছে বকেয়া।

এছাড়া পাটকল শ্রমিকেরা তাদের কিছু দাবি নিয়ে ৩ মার্চ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করলেও এতে কোনো সাড়া মেলেনি বলে জানান শ্রমিকরা। তাদের দাবি— রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকা পাটকলগুলো অতি দ্রুত চালু করা, শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রুহুল আমিনের নিঃশর্ত মুক্তি, বদলি শ্রমিকদের বকেয়া অতিদ্রুত পরিশোধের ব্যবস্থা করা, ২০১৯ সালের বকেয়া পরিশোধ করা। জাতীয় পাট দিবস উপলক্ষে দেওয়া কর্মসূচিতেও তাদের সেই দাবিগুলো বহাল থাকবে বলে জানান শ্রমিকরা। 

আমিন জুট মিলের সিবিএ সভাপতি আরিফুর রহমান আরিফের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘বর্তমানে পাটকল বন্ধ আছে। মিলের বিভিন্ন ফ্লোর টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ইজারা দেওয়া হবে। সেটি চলমান। এই প্রক্রিয়ায় যারা ইজারা পাবে তারা পাটকল পরিচালনা করবেন। বেসরকারি বিনিয়োগের পাটকল আবার সচল হবে। তাছাড়া পূর্ববর্তী যেসব শ্রমিক ইজারাপ্রাপ্ত কোম্পানির আওতায় বিদায় হয়েছেন, তাদের পাওনা প্রদানের প্রক্রিয়া চলমান। ৬ মার্চ জাতীয় পাট দিবস জেলা প্রশাসনের আওতায় পালন করা হবে।’ এতে পাটকল শ্রমিকরা অংশগ্রহণ করবেন বলেও জানান তিনি।

বদলি শ্রমিকদের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘পাটকল বন্ধ থাকায় অনেক শ্রমিক বাড়ি চলে গেছেন। অনেকে কাজের সন্ধানে আছেন। অনেকে আবার রিকশা-ভ্যানগাড়ি চালাচ্ছেন, কেউ দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। তবে আশা করি, আন্দোলনরত শ্রমিকদের বকেয়া-পাওনা শ্রম আইন অনুযায়ী সরকার চুকিয়ে দেবে। বদলি শ্রমিক ও দৈনিক শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের কাজও চলমান।’

পুরনো শ্রমিকদের চাকরিতে পুনর্বহালের বিষয়ে এই সিবিএ নেতা বলেন, ‘মূলত বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে পাটকল খোলা হবে। টেন্ডার প্রক্রিয়া কাজ যেহেতু চলমান, সেহেতু টেন্ডার হয়ে গেলে মিল খুলবে। আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে মিল খোলার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে টেন্ডার যেই পাবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে— পুরনো শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। যাদের শারীরিক সক্ষমতা আছে তারা অবশ্যই কাজ করতে পারবেন।’

আমিন জুট মিলস লিমিটেড ছাড়াও চট্টগ্রামে আরও নয়টি পাটকল ছিল। এগুলো হলো— ওল্ড ফিল্ডস লিমিটেড, গুল আহমেদ জুট মিলস লিমিটেড, হাফিজ জুট মিলস লিমিটেড, এমএম জুট মিলস লিমিটেড (পরীক্ষামূলকভাবে চালু), আর আর জুট মিলস লিমিটেড (পরীক্ষামূলকভাবে চালু), বাগদাদ-ঢাকা কার্পেট ফ্যাক্টরি লিমিটেড, ফোরাত কর্ণফুলী কার্পেট ফ্যাক্টরি, গালফ্রা হাবিব লিমিটেড (নন-জুট), মিলস ফার্নিসিং লিমিটেড (নন-জুট)। কালের বিবর্তনে বন্ধ হয়েছে সব। 

এদিকে গত কয়েক বছরের মতো এবারও দিবসটি উদযাপনে কিছু কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। তবে করোনার কারণে আগের বছরগুলোর মতো জমকালো কোনো অনুষ্ঠান নেই। ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোক্তাদের পণ্য নিয়ে সীমিত পরিসরে হবে কেবল পাটমেলা।

-সিভয়েস/আরএস

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়