Cvoice24.com

পায়ে হেঁটে, বাড়তি ভাড়ায় কারখানায় পোশাক শ্রমিকরা

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২০:০২, ১ আগস্ট ২০২১
পায়ে হেঁটে, বাড়তি ভাড়ায় কারখানায় পোশাক শ্রমিকরা

শাহেদুল ইসলাম শাহেদ (৩১)। কাজ করেন নগরের দেওয়ানহাটের ইউনিটি ফ্যাশন নামের একটি পোশাক কারখানায়। স্ত্রী আমেনা ও এক সন্তান আরিফুলকে (৮) নিয়ে থাকেন নগরের পানির কল এলাকায়। তার স্ত্রীও অন্য একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তবে ঈদের পর কারখানা বন্ধ থাকবে জেনে পরিবার নিয়ে চলে গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়ি ফেনীতে।

আগের কিছু জমানো টাকায় কোনমতে চলছিল দিন। হঠাৎ কারখানা খোলার খবর পেয়ে এক প্রতিবেশি থেকে দুই হাজার টাকা ধার নিয়ে ছুঁটেন চট্টগ্রামের পথে। সড়কে এসেই বিপত্তি। কিছুদূর পায়ে হেঁটে, কখনো সিএনজি বা ট্রাকে চড়ে চার ঘন্টায় কোনোমতে এসে পৌঁছেন চট্টগ্রামে। রাত কাটিয়ে উঠে ফের সেই একই দশায় পড়তে হয়েছে তাকে। সকাল ৭টায় কারখানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে সড়কে গাড়ি না পেয়ে হেঁটেই গেছেন কারখানায়।

নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, গতকাল শহরে আসতে এত কষ্ট হয়েছে বলে বোঝানোর মত না। অনেকটা পথ হেঁটে আসায় রাতে পায়ে ব্যথা করেছে। সকালে কারখানায় যেতে কোন গাড়ি পাই নি। এখন বাসায় ফেরার পথেও একই অবস্থা। মাঝে মাঝে কষ্ট আর সহ্য হয় না। তবুও মনকে বোঝাই এই ভেবে— আমাদের জন্মই মনে হয় কষ্ট পাওয়ার জন্য। আমাদের দেখার কেউ নাই। 

শাহেদের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে আরেক পোশাক কর্মী রেহেনা সুলতানা ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলেন, রাস্তায় কয়েকটা পাবলিক গাড়ি চলতে দেখলেও ধাক্কাধাক্কির কারণে উঠতে পারি নাই। রিকশা আছে, ভাড়া দেয়ার মত সামর্থ্য আমাদের নাই। কারখানায় হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করে। আমরা সব সময় মানসিক চিন্তা আর ঝুঁকির মধ্যে কাজ করি। আর পোশাক কারখানায় বেশিরভাগই নারী শ্রমিক। আমাদের যাওয়া-আসায় খুব কষ্ট হয়। অথচ আমাদের জন্য কোন পরিবহণের ব্যবস্থা করেনি কর্তৃপক্ষ। আমরা কি মানুষ না? আমাদেরকে কি যন্ত্র মনে হয়!

পদে পদে এ ভোগান্তি শুধু শাহেদ বা সুলতানার একার নয়, এ কষ্ট নগরজুড়ে কাজ করা হাজারো শ্রমিকের। সরকারের নির্দেশনা পেয়ে আজ থেকে সচল হয় চট্টগ্রামের সবকটি পোশাক কারখানার মেশিন। কারখানায় শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে কর্মস্থলে পৌঁছাতে শ্রমিকদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়নি পরিবহনের। ফলে অনেক শ্রমিককে পায়ে হেঁটে কারখানায় যেতে হয়েছে। আবার বিকল্প পরিবহনে কারখানায় যেতে-আসতে অনেককে গুনতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া।

এদিকে কারখানা চালু করার ক্ষেত্রে গতকাল শনিবার রাতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের আলাদা লাইন করে কারখানায় প্রবেশ এবং বাহির নিশ্চিত করা, বিভিন্ন শিফটে কর্মঘণ্টা  নির্ধারণ করা, শ্রমিকদের দেহের তাপমাত্রা পরিমাপ করা,হাত পরিষ্কার সামগ্রী রাখা, সার্বক্ষণিক মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করাসহ ১৫টি শর্ত দিয়ে কারখানা মালিকদের কাছে চিঠি পাঠায় বিজিএমইএ।

মদিনা গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ মুসা সিভয়েসকে বলেন, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে কারখানায় নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কারখানায় প্রবেশের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের তাপমাত্রা মাপা, তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে প্রবেশ করানো, জীবাণুমুক্ত করণ ও হাতধোয়াসহ বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এভাবে আমরা শ্রমিকদের সার্বক্ষণিক নজরে রেখেছি, যাতে সুষ্ঠুভাবে কারখানা পরিচালনা করতে পারি। করোনা ও লকডাউনের কারণে আমাদের ব্যবসা বাণিজ্যেও মন্দাভাব চলছে। আমরাও চাই শ্রমিকরা ভালো থাকুক, ভালোভাবে কাজ করুক। সবে মাত্র আজ কারখানা চালু হয়েছে। আপাতত শ্রমিকরা নিজেদের মত করে কাজ চালিয়ে যাক।  সংগঠন থেকে পরিবহণ সংক্রান্ত নির্দেশনা এলে সেটা তখন বিবেচনা করা হবে। 

বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সিভয়েসকে বলেন, আজ কারখানাগুলো উৎপাদন শুরু করেছে। লকডাউন পরিস্থিতিতে পড়ে কারখানা মালিকরাও বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। তবুও আমরা মালিকদের বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছি যাতে শ্রমিকদের ভোগান্তিটা কমে। গতকাল সব মালিক পক্ষকে ১৫ শর্তের চিঠি পাঠানো হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে আমরা সব সিদ্ধান্ত নেব। শ্রমিকদের পরিবহণ ব্যবস্থা করার ব্যাপারে শীঘ্রই একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। 

বিধিনিষেধ পুরোপুরি প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত গ্রামে অবস্থান করা কোন শ্রমিক-কর্মচারী কারখানায় কাজে যোগদান করতে না পারলে তাদের চাকরি থাকবে এমনটা নিশ্চয়তা দিয়েছে বিজিএমইএ।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) চট্টগ্রামের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে বিজিএমইএ'র সদস্যভুক্ত প্রায় ৭০০টি কারখানা রয়েছে। গত বছরের শুরুর দিকে করোনার প্রভাবে লোকসানে পড়ে ২৫টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। চলতি বছরও শুরুর দিকে ৮টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি বর্তমানে আরো প্রায় চারশ’র মত কারখানা অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। বর্তমানে পুরোদমে সচল রয়েছে মাত্র ৩৫০টি কারখানা।  

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সব মিলিয়ে রপ্তানি কমেছে ৪৮ হাজার ৭শ’ কোটি টাকা। এর মধ্যে পোশাক রপ্তানি কমেছে প্রায় ৪৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এক হাজার ৫৫৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধে তৈরি পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ৬২১ কোটি ডলার।

উল্লেখ্য, গত ২৩ জুলাই কঠোর বিধিনিষেধ জারি হওয়ার পর থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিল্প-কারখানা। তবে ঈদের পর থেকেই কারখানা খোলার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিলেন শিল্প-কারখানার মালিকরা। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আজ ১ আগস্ট সকাল ৬টা থেকে রপ্তানিমুখী সব শিল্প ও কলকারখানা বিধিনিষেধের আওমুক্ত রাখার ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়