Cvoice24.com

করোনায়ও বন্ধ ছিলনা বিদেশযাত্রা, দেশ ছেড়েছে চট্টগ্রামের নারীরাও

সিভয়েস ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪:০৪, ১৮ ডিসেম্বর ২০২১
করোনায়ও বন্ধ ছিলনা বিদেশযাত্রা, দেশ ছেড়েছে চট্টগ্রামের নারীরাও

করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও থেমে ছিলনা বিদেশযাত্রা। পরিবারের ভাগ্য বদলাতে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের মতো কঠিন পরিস্থিতিতেও দেশ ছেড়েছে বহু মানুষ। পরিবারের দুঃখ ঘোচাতে পিছিয়ে ছিলনা নারীরাও। পৃথিবীর সবচেয়ে সংকটময় পরিস্থিতিতে পরিবারের হাল ধরতে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিল চট্টগ্রামের নারীরা। আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উপলক্ষে জনশক্তি রপ্তানি শীর্ষে সিভয়েসে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

করোনার ধাক্কা : চট্টগ্রামে এক বছরে অর্ধেকে নেমেছে জনশক্তি রপ্তানি

মহামারি করোনা নিস্তব্ধ করে দিয়েছে বিশ্বকে। তবুও নিজের ও পরিবারের ভাগ্য বদলের প্রত্যাশায় থেমে নেই বিদেশ যাত্রা। যদিও স্বাভাবিক পরিস্থিতি থেকে করোনার এই দুই বছরে বিদেশ যাত্রার হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম ছিল। ২০১৯ সালে সাত লাখেরও বেশি মানুষ দেশ ছাড়লেও গত বছর সে সংখ্যা নেমে এসেছে অর্ধেকেরও বেশি নিচে। ২০১৯ সালে যেখানে চট্টগ্রাম থেকে সাত লাখেরও বেশি মানুষ প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছে, সেখানে ২০২০ আর ২১ সালের ১৪ মাসে ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে দেশ ছেড়েছেন মাত্র ২ লাখ ৮৩ হাজার ৭৮২ জন।

২০২০ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই বাদে পুরো বছরজুড়ে চট্টগ্রামের ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জন বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। আর ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন ১ লাখ ৯৫ হাজার ২৪০ জন। 

এদের মধ্যে ২০২০ সালে সৌদি আরবে গেছেন ১ লাখ ৬১ হাজার ৭২৬, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১ হাজার ৮২, কুয়েতে ১ হাজার ৭৪৪, ওমানে ২১ হাজার ৭১, কাতারে ৩ হাজার ৬০৮, বাহরাইনে ৩, লেবাননে ৪৮৮, জর্দানে ৩ হাজার ৭৬৯, লিবিয়াতে ৯৩, সুদানে ২, মালয়েশিয়ায় ১২৫, সিঙ্গাপুরে ১০ হাজার ৮৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ২০৮, যুক্তরাজ্যে ২১, জাপানে ১৪২, ব্রুণাইয়ে ৫৩০, মরিশাসে ২ হাজার ১৪ ও অন্যান্য দেশে ৪ হাজার ৪৭৭ জন।

অন্যদিকে ২০২১ সালের প্রথম পাঁচ মাসে সৌদি আরবে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৩৯৪ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৪ হাজার ৬৩৩, কুয়েতে ৩০ জন, ওমানে ১৯ হাজার ৪২, কাতারে ২ হাজার ১৮ জন, বাহরাইনে ৯, লেবাননে ৬৩, জর্দানে ৫ হাজার ৩৩২, লিবিয়াতে ৩, মালয়েশিয়ায় ১৪, সিঙ্গাপুরে ১২ হাজার ১৩৯, যুক্তরাজ্যে ১৯, ইতালিতে ৭১, জাপানে ৩, ব্রুণাইয়ে ১০, মরিশাসে ১৪, ইরাকে ৩ ও ও অন্যান্য দেশে ১ হাজার ৭২৭ জন যান।

এই দুই বছরে সবচেয়ে বেশি মানুষ পাড়ি জমিয়েছে সৌদি আরবে। এরপরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের আধিক্যের দেশ ওমানে। তারপর সিঙ্গাপুর, জর্দান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, মরিশাস, ব্রুণাই, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানে। 

চট্টগ্রাম জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২০ আর ২১ সাল মিলিয়ে ১৪ মাসে দেশ ছেড়ে যাওয়াদের মধ্যে ৫০ হাজার ৭৫৮ জন নারী ও ৩ লাখ ৬২ হাজার ১৫১ জন পুরুষ। 

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) বলছে, করোনার প্রভাবে শ্রমিকদের বিদেশযাত্রা কিছুটা থমকে গিয়েছিল। করোনা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শ্রমিক নিচ্ছে। বাংলাদেশ থেকেও শ্রমিকরা আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তাদের পক্ষ থেকে সব শ্রমিককে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে, যাতে করে দেশিয় সুনাম অক্ষুণ্ন থাকে। ফলে দিন দিন দেশের রেমিট্যান্স বাড়ছে। 

চলতি বছরের প্রথম চারমাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৮ লাখ ৪৪ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা দরে)। গতবছর ১৮ লাখ ২৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা দরে)। এর আগে ২০১৯ সালে ১৫ লাখ ৫৫ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা আর ২০১৮ সালে ১৩ লাখ ১৭ হাজার ৭২২ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পেয়েছিল বাংলাদেশ। 

বায়রার সচিব ড. মুহাম্মদ আবদুল জলিল সিভয়েসকে বলেন, ‘মহামারি করোনা শুধু আমাদের দেশ নয়, গোটা বিশ্বকে এলোমেলো করে দিয়েছিল। গতবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফ্লাইট বন্ধ ছিল। অনেক দক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমাতে পারেননি। এখন তারা বিদেশে যাচ্ছেন। আমরা অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে শ্রমিক পাঠানোর চেষ্টা করছি।`

২৮ হাজার নারী শ্রমিকের বিদেশযাত্রা, পাঁচ মাসেই ভাঙলো গেল বছরের রেকর্ড

করোনা মহামারির মধ্যেও চলতি বছরের প্রথম পাঁচমাসে (জানুয়ারি-মে) চট্টগ্রাম থেকে ১ লাখ ৯৫ হাজার ২৪০ নারী-পুরুষ ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তার মধ্যে নারী রয়েছেন ২৮ হাজার ৮২৪ জন। গত বছরজুড়ে কর্মসংস্থানের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যান মোট ২১ হাজার ৯৩৪ নারী। সে হিসাবে চলতি বছরের পাঁচ মাসেই নারী শ্রমিকদের বিদেশযাত্রা গত বছরকে ছাড়িয়ে গেছে। 

গত বছরের প্রথম তিনমাসে ১৮ হাজার ৮০৬ জন নারী কর্মসংস্থানের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যান। তবে এপ্রিল ও মে মাসে কোন নারী বিদেশে পাড়ি জমাননি। সবমিলিয়ে চলতি বছরের পাঁচমাসে নারী শ্রমিকের বিদেশযাত্রা গত বছরের একই সময়ের ব্যবধানে বেড়েছে দেড়গুণ।       

চট্টগ্রাম জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, চট্টগ্রাম থেকে জানুয়ারি মাসে ৪ হাজার ৬৬৯ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৬ হাজার ৩৮২ জন, মার্চ মাসে ৮ হাজার ২৯৭ জন, এপ্রিল মাসে ৫ হাজার ২৩৮ জন ও মে মাসে ৪ হাজার ২৩৮ জন নারী ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন।  

গত বছর করোনা মহামারীর মধ্যে মার্চ থেকে দুমাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। ফলে মার্চ থেকে মে মাসে নতুন করে বিদেশে পাড়ি জমাননি কেউই। তবে চলতি বছরের একই সময়ে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নারী প্রবাসে গেছেন।  

এ সময়ে সৌদি আরবে যাওয়ার প্রবণতাই ছিল সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে শুধু মার্চ মাসেই সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৫ হাজার ৩২৯ নারী শ্রমিক দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছেন। আর পাঁচমাসে সৌদি আরবে যান ১৮ হাজার ৪৩৭ জন, জর্দানে ৫ হাজার ২১৯ জন, ওমানে ৩ হাজার ৬৬৭ জন, কাতারে ৮৮২ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৪৮১ জন, হংকংয়ে ২৪ জন, সাইপ্রাসে ১৪ জন, সিঙ্গাপুরে নয়জন, লেবাননে পাঁচজন, মালয়েশিয়ায় দুজন এবং কুয়েত, যুক্তরাজ্য ও ইতালিতে একজন করে। এছাড়া অন্যান্য দেশে আরও ৮১ নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। 

আর গত বছর ১২ হাজার ৭৩৫ জন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে, ৩ হাজার ৬৬১ জন জর্ডানে, ৩ হাজার ৩৫৮ জন ওমানে এবং কাতারে ৮০৯ জন, আরব আমিরাতে ৬৬৪ জন, লেবাননে ১৯১ জন ও কুয়েতে ৭০ জন চট্টগ্রামের নারী শ্রমিক বিদেশে গেছেন। তাছাড়া মরিসাসে ২৮০ জন, হংকংয়ে ৬৬ জন, সিঙ্গাপুরে ২১ জন, সাইপ্রাসে ১০ জন, মালয়েশিয়ায় নয়জন, যুক্তরাজ্যে সাতজন, ব্রুনাইয়ে দুজন নারী পাড়ি জমান।

জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে সারাদেশে চট্টগ্রামের অবস্থান তৃতীয়। তবে নারী শক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে দেশের সব জেলাকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছে চট্টগ্রাম। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রবাসীবান্ধব পদক্ষেপ নেওয়ার ফলেই নারী জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ অ্যাসোশিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা)। 

দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন নারীরা। গত বছর ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা দরে), ২০১৯ সালে ১৫ লাখ ৫৫ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে ১৩ লাখ ১৭ হাজার ৭২২ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠান নারী শ্রমিকরা। 

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সারাদেশ থেকে ১ লাখ ৮ হাজার ৭৮৬ জন, ২০১৮ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৫ জন, ২০১৭ সালে ১ লাখ ২১ হাজার ৯৯৫ জন, ২০১৬ সালে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৮ নারী বিদেশে পাড়ি জমান। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. জ্যোতি প্রকাশ দত্ত সিভয়েসকে বলেন, ‘দিন দিন নারীদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে এটা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। পর্যাপ্ত পরিচর্যা, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়ানো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করলেই নারীদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা আরও বাড়বে। এতে তাদের আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশেরও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাবে।’  

বায়রার সচিব ড. মুহাম্মদ আবদুল জলিল সিভয়েসকে বলেন, ‘গত বছর করোনা মহামারীর কারণে সবকিছু থমকে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলোও বন্ধ ছিল। সে কারণে বিদেশযাত্রায়েও ভাটা পড়েছিল। তবে করোনার প্রভাব এখনো কাটেনি। এরপরও আমরা সাধ্যমত বিদেশে লোক পাঠানোর চেষ্টা করছি। বায়রার পক্ষ থেকে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। ফলে আমাদের দেশ থেকে দক্ষ লোক বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।’ 

তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবের দিকেই নারী শ্রমিকদের আগ্রহ বেশি। পাশাপাশি নারী শ্রমিকরা বিদেশে নির্যাতিত হচ্ছেন- এমন অভিযোগ আমরা এখন আর পাচ্ছি না তেমন।’


 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়