Cvoice24.com

আগুনে জ্বলছে জনজীবন

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৬:০৬, ১০ আগস্ট ২০২২
আগুনে জ্বলছে জনজীবন

কবি হেলাল হাফিজের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ— ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। কবির এই কাব্যগ্রন্থের বাস্তবতা ফুটে উঠেছে জনজীবনে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগুন জ্বলে উঠেছে মজুরিতে চলা সাধারণ মানুষের জীবন। একদিকে বাড়তি ভাড়া, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে ‘আগুন’। সবমিলিয়ে ‘যন্ত্রণার’ অনলে পুড়ছে জনজীবন। এ যন্ত্রণার শেষ কোথায়— এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনিশ্চয়তার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন সাধারণ নাগরিকরা। 

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চালের বাজারে বস্তায় বেড়েছে ৪শ’ টাকা। ৩শ টাকার নিচে মিলছে না ফল। ৬০ থেকে ৮০ টাকার নিচে মিলছে না সবজি। মুরগির কেজি ১৬০ থেকে ঠেকেছে ১৮০ টাকায়। পাশাপাশি ডাল, আদা, হলুদ, পেঁয়াজ ও অন্যান্য মসলা জাতীয় পণ্যের দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে গেছে। ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে পণ্যবহনকারী গাড়ি ভাড়া পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা বেড়ে গেছে। এ কারণে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। বাজারে ক্রেতার সমাগমও কমে গেছে। 

চট্টগ্রামের বৃহত্তর পাইকারি চালের বাজার পাহাড়তলীতে মিনিকেট (চিকন চাল) ৫০ কেজির বস্তায় ৪শ’ টাকা বেড়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা, নাজিরশাইল ৩ হাজার ৯শ ও পাইজাম ২৭শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বস্তাপ্রতি ৩শ’ টাকা বেড়ে জিরাশাইল সাড়ে তিন হাজার টাকা, চিকন মিনিকেট ২ হাজার ৭শ’ টাকা, চিকন আতপ ৩ হাজার ৮শ’ টাকা ও বিআর-২৮ জাতের চাল ২ হাজার ৭শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চিনিগুঁড়া চালে। বস্তায় ৯শ’ টাকা বেড়ে এখন দাম ঠেকেছে ৫ হাজার ৯শ’ টাকায়। তাছাড়া মোটা আতপ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার টাকায়।

এদিকে চট্টগ্রামের বৃহত্তর ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে ৪ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি চিনি ৭৯, মসুর ডাল ৯৩, মটর ডাল ৬০ ও পাঁচ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি আলু ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বেড়েছে মসলার দামও। কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৩৩, আদা ৬২ ও রসুন ৯৬ থেকে ১শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে শুকনো মরিচ ৩৪২ টাকা, ৮ টাকা বেড়ে হলুদের কেজি ১১২, কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে এলাচ ৩শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া জিরার কেজিতে ৬ টাকা বেড়ে ৪৬৫, কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে দারুচিনি ৩১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।  

খাতুনগঞ্জ ও পাহাড়তলির পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে গাড়ি ভাড়া বহুগুণে বেড়ে গেছে। নর্থ বেঙ্গল থেকে পাহাড়তলী বাজারে পণ্য আনতে ট্রাকগুলো এখন ১৬ হাজার টাকার ভাড়া ২১ হাজার টাকা নিচ্ছে। অন্যদিকে সিলেট থেকে খাতুনগঞ্জে আসা ট্রাকগুলো ১৬ হাজার টাকার ভাড়া ২৫ হাজার টাকা, আগে ৩৪ হাজার টাকায় বেনাপোল থেকে খাতুনগঞ্জে আসা গাড়ি ৪০ হাজার টাকা নিচ্ছে।

পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দীন সিভয়েসকে বলেন, চালের বাজারের পরিস্থিতি খারাপের দিকেই আছে। দিন দিন দাম বাড়ছে এবং তা ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। চালের দাম বাড়ার কারণে আমাদের বেচাবিক্রিও কমে গেছে। সরকার ভারত থেকে যে চাল আমদানি করেছে সেখান থেকে আমরা যে পরিমাণে স্বর্ণা চাল পেয়েছি তা আমাদের স্থানীয় চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়। তার উপর বেচাবিক্রি কমে যাওয়ায় আমদানিকারকরাও এলসি কম খুলছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে আমাদেরকে এখন প্রতি ট্রাকে পাঁচ হাজার টাকা বাড়তি গুনতে হচ্ছে। কাজেই চালের বাজারে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে তা এত সহজে কাটবে না।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগীর আহমদ বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে আমরাও খুব বিপাকে পড়েছি। পণ্য আমদানি করতে গিয়ে আমাদের খরচ বেড়ে গেছে। আগে একটা ট্রাক ২১ হাজার টাকায় ভাড়া করলে এখন ২৭ হাজার টাকা গুণতে হচ্ছে। ফলে পণ্যের দর স্বাভাবিকভাবেই বাড়ছে। কিন্তু এর প্রভাবে আমাদের দোকানগুলোতে বেচাবিক্রি একেবারে কমে গেছে।

এদিকে জ্বালানির দাম বাড়ায় উত্তাপ ছড়াচ্ছে ফলের বাজারেও। আপেল ও কমলার কেজি ৩শ টাকায় ঠেকেছে। অন্যদিকে প্রতিকেজি আঙুর বিক্রি হচ্ছে ৫শ টাকায়।  

ফলমন্ডিতে খবর নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে আপেল, কমলা, মাল্টা ও আঙ্গুরের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। দশ দিন আগে ফলমন্ডিতে প্রতি ক্যারেট মাল্টা (১৫ কেজি) ৩৩শ টাকা ও কমলা (২৪ কেজি) ৫ হাজার ৬শ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আজকের বাজারে প্রতি ক্যারেট মাল্টা ৩ হাজার ৯শ ও কমলার ক্যারেট বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার টাকার উপরে। পাশাপাশি প্রতি ক্যারেট আপেল (১৮ কেজি) দশদিন আগে ৩ হাজার ৮শ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে সাড়ে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে পণ্যটি।

চট্টগ্রাম ফল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম সিভয়েসকে বলেন, এতদিন ডলারের কারণে ফলের দাম বাড়তি ছিল। তার উপর নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে ফলের দাম আরো বেড়ে গেছে। আমাদে বেচাবিক্রি আরো কমে প্রায় ২৫ শতাংশ নেমে এসেছে। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমদানিকারকরাও কম পরিমাণে এলসি খুলছেন। আমরা খুব দুশ্চিন্তায় সময় পার করছি।   

সবজির দোকানেও মিলছেনা স্বস্তির খবর। উল্টো জ্বালানির প্রভাবে প্রতিকেজি সবজিতে বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি বরবটি ৭০ থেকে ৮০ টাকা, বেগুন ৬০, কাকরোল ৬০ থেকে ৭০, কাঁচা পেঁপে ৩৫, পটল ৪০ থেকে ৫০, করলা ৬০, বিক্রি হচ্ছে। গতসপ্তাহে ৪০ টাকায় বিক্রি হওয়া কচুর লতি, ঝিঙে, চিচিঙ্গার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। তাছাড়া কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে শসা ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কাজীর দেউড়ি বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. জিহাদ সিভয়েসকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। তাই আড়তে সবজির দাম বেড়ে গেছে।

একই বাজারে মুরগির দোকান ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা প্রতিকেজি বয়লার মুরগি বিক্রি করছেন ১৮০ টাকায়। গত শুক্রবার বয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছিল ১৬০ টাকা কেজিতে। এ হিসেবে তিনদিনের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন সিভয়েসকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর থেকে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় এখন অনেক বেড়ে গেছে। অধিকাংশ মানুষ ঘরভাড়া নিয়ে বসবাস করেন। তার উপর গ্যাস, বিদ্যুৎ পানির বিল তো আছেই। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ ওই মোতাবেক পরিকল্পনা নিয়ে থাকেন। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় যদি হঠাৎ করে আরো বেড়ে যায় তখন মানুষ বিপাকে পড়ে যান। মাছ-মাংস, তেল, সবজি কোন কিছুতেই শান্তি নেই। সাধারণ মানুষ দুবেলা দুমুঠো খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতে চায়। সেখানেও হোঁচট খাচ্ছেন তারা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোকে পুঁজি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফার চেষ্টা করছেন। কাজেই জেলা প্রশাসন বা ভোক্তা অধিকারকে শুধু পেট্রোল পাম্পে অভিযান পরিচালনা করলেই হবে না। নিয়মিত বাজার তদারকিও করতে হবে।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়

: