Cvoice24.com

পোশাক খাতে কমেছে উৎপাদন, রপ্তানিতেও ভাটা

তারেক মাহমুদ

প্রকাশিত: ১৫:৫৩, ১৯ আগস্ট ২০২২
পোশাক খাতে কমেছে উৎপাদন, রপ্তানিতেও ভাটা

একদিকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, অন্যদিকে একদিন করে বন্ধ রাখতে হচ্ছে কারখানার চাকা। এই প্রভাবে কমেছে পোশাক পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানি। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে পোশাক খাতে সংকট কাটছেনা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রামের পোশাক খাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ এর সমস্যাটি বেশ পুরনো। সাম্প্রতিক সময়ে একদিন করে কারখানা বন্ধ রাখা ও জ্বালানি তেলের দর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। এ কারণে বর্তমানে দু ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। প্রথমত পরিবহন খরচ ও বেসরকারি ডিপোর ৩৫ শতাংশ চার্জ বেড়ে গেলেও বিদেশি বায়াররা (ক্রেতা) আগের দরেই পণ্য কিনছেন। দ্বিতীয়ত সপ্তাহে একদিন করে কারখানা বন্ধ রাখা ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে উৎপাদন এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। ফলে যথাসময়ে বায়ারদের পণ্য পাঠাতে সমস্যা হচ্ছে। এতে করে দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।

গতবছরের নভেম্বর মাসে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে ২৩ শতাংশ সার্ভিস চার্জ বাড়িয়েছিল চট্টগ্রামের ১৯টি বেসরকারি ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো (আইসিডি) কর্তৃপক্ষ। ওই সময় ২০ ফুট সাইজের কনটেইনারে ইমপোর্ট হ্যান্ডেলিং প্যাকেজে ১ হাজার ৮২৪ টাকা বাড়িয়ে ৯ হাজার ৭৫৪ টাকা এবং ৪০ ফুট সাইজ কনটেইনারের ক্ষেত্রে ২ হাজার ১০৫ টাকা বাড়িয়ে ১১ হাজার ২৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। 

৮ মাসের ব্যবধানে আবারো জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিল সরকার। এই দফায় এবার ৩৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ বাড়িয়েছে ডিপো মালিকরা। বর্তমানে ২০ ফুট সাইজের কনটেইনারে ইমপোর্ট হ্যান্ডেলিং প্যাকেজে ৩ হাজার ৩২৬ টাকা বাড়িয়ে ১২ হাজার ৮৩০ টাকা এবং ৪০ ফুট সাইজের কনটেইনারে ৩ হাজার ৮৫২ টাকা বাডিয়ে ১৪ হাজার ৮৫৭ টাকা আদায় করা হচ্ছে।

বর্ধিত জ্বালানি তেলের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে উল্লেখ করে বিকডা সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান সিভয়েসকে বলেন, কনটেইনার পরিবহন করে আমরা ডিপোতে নিয়ে আসি। সেখানে আমাদের খরচ বেড়েছে। আমাদের ডিপোগুলোতে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় তার অধিকাংশই ডিজেল নির্ভর। ডিজেল ব্যবহার করতে হবে তাই আমরা বর্ধিত দামটাই সমন্বয় করেছি। এ ছাড়া আইসিডি কোনো ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়নি। 

জ্বালানি তেল ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে একদিকে বেড়েছে কাঁচামাল আমদানি খরচ, অন্যদিকে ডিপোর সার্ভিস চার্জ ও কারখানা থেকে পণ্য ডিপোতে নিতে পরিবহন খরচ বাড়ার কারণে পোশাক উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু বায়ারদের কাছে বাড়তি দরে না পাওয়ায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে পড়েছে—এমনটা দাবি উদ্যোক্তাদের। 

চট্টগ্রাম বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রামে নিবন্ধিত ১৩৩টি পোশাক কারখানার মধ্যে ৭টি কারখানার মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। দশ বছরের ব্যবধানে ১৯৯৫ সালে ৩৫৯টি কারখানার মধ্যে ১৪টি, ২০০৫ সালে ৬৯৯টি কারখানার মধ্যে ৮৯টি ও ২০১৫ সালে ৭৫৬টি কারখানার মধ্যে ৩০১টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে বিজিএমইএ’র নিবন্ধিত ৬৯৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৮৯টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বাকি ৩০৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নানা সমস্যার মধ্যেও ১৯০টি প্রতিষ্ঠান আমদানি-রপ্তানির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এর আগে গতবছর বিজিএমইএর নিবন্ধিত ৬৯৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪শ কারখানা বন্ধ হয়েছিল, উৎপাদনে ছিল মাত্র ২৯৩টি কারখানা। 

বিগত ৩৫ বছরের তুলনায় গত দুই বছরের মধ্যে চট্টগ্রামে ব্যবসায়ীরা নানামুখী সমস্যায় পড়ে পোশাক খাতে অবনতি নেমে আসে। এ কারণে এ সেক্টরে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।

চট্টগ্রামের মদিনা গার্মেন্টেসের মালিক মোহাম্মদ মুসা সিভয়েসকে বলেন, আমরা চরম সংকটের মধ্য দিয়ে সময় পার করছি। বর্তমানে আমাদের কারখানাগুলোর উৎপাদন এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। চট্টগ্রামের অধিকাংশ কারখানাই ছোট ও মাঝারি আকারের। বড় ধরনের লোকসান মাথায় নেওয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই। একদিকে ডিপো কর্তৃপক্ষ সার্ভিস চার্জ বাড়িয়েছে। বায়াররা যথাসময়ে পণ্য ডেলিভারি চায়। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে যথাসময়ে পণ্য পাঠাতেও সমস্যা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।  

এদিকে বিদ্যুতের ঘাটতি ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে চট্টগ্রামের পোশাক কারখানাগুলোতে উৎপাদন কমে গেছে। এ কারণে রপ্তানিতেও ধাক্কা লেগেছে।

চট্টগ্রাম রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো ৪ হাজার ৩০৪ কোটি ডলার পণ্যের মধ্যে ৩ হাজার ৫৩৬ কোটি ডলার পোশাক পণ্য রয়েছে। অর্থাৎ রপ্তানি করা বিভিন্ন পণ্যের ৮৮ ভাগই ছিল পোশাক পণ্য। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গতবছরের ডিসেম্করে ৪৯০ কোটি ৭৮ লাখ ডলার, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪৮৫ কোটি ৩ লাখ ৭১ হাজার ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ৪২৯ কোটি ৪৬ লাখ ডলার, মার্চ মাসে ৪৭৬ কোটি ২৩ লাখ ডলার, এপ্রিল মাসে ৪৭৪ কোটি ডলার ও জুন মাসে ৪৯১ কোটি ডলার পোশাক পণ্য ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে। তবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ও বিদ্যুৎ সমস্যা প্রকট হবার পর থেকেই রপ্তানিতে নেমে আসে ভাটা। জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে ৯৬ কোটি টাকা রপ্তানি কমেছে। জুলাই মাসে রপ্তানি হয়েছে ৩৯৫ কোটি টাকার পোশাক পণ্য। 

বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সিভয়েসকে বলেন, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ডিজেলে জেনারেটর চালিয়ে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে আছেন উদ্যোক্তারা। দীর্ঘদিনের জাহাজ ও কনটেইনার ভাড়ার পাশাপাশি ডলারের দাম বেড়েছে তাই কাঁচামাল আমদানি খরচও বেড়ে গেছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে ডিপো মালিকরাও সার্ভিস চার্জ বাড়িয়ে দিয়েছেন। চলতি অর্থবছর ৬৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর বড় অংশই আসবে পোশাক খাত থেকে। যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা মুশকিল হয়ে পড়বে। পাশাপাশি কারখানাগুলোতে উৎপাদন ও আয় কমে গেলে কারখানা ব্যয় পরিচালনা করা মুশকিল হয়ে পড়বে। এতে করে শ্রমিক অসন্তোষসহ নানামুখী চাপ তৈরি হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নঈম উদ্দিন হাছান আওরঙ্গজেব চৌধুরী সিভয়েসকে বলেন, নিঃসন্দেহে পোশাক খাত দেশীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। ইউরোপ আমেরিকাতে আমাদের তৈরি পোশাকের কদর দিনকে দিন বাড়ছে। এটা একটা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইতিবাচক দিক। করোনার ধাক্কা সামলে বেশ গতিশীলও হয়েছিল সেক্টরটি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ খাতকে আরো কিভাবে প্রসারিত করা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। কাজেই পোশাক পণ্য রপ্তানি বাড়াতে হলে বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমস্যার পথ খুঁজে বের করতে হবে।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়