Cvoice24.com

চট্টগ্রামে বিদেশযাত্রায় দুই বছরের রেকর্ড ভাঙলো চার মাসে

তারেক মাহমুদ

প্রকাশিত: ১৮:১৭, ২৬ আগস্ট ২০২২
চট্টগ্রামে বিদেশযাত্রায় দুই বছরের রেকর্ড ভাঙলো চার মাসে

কাছের মানুষ দুরে থুইয়া, মরি আমি ধড়-ফড়াইয়া রে, 
দারুণ জ্বালা দিবানিশি, অন্তরে অন্তরে...

বিখ্যাত এই গানের প্রতিটি চরণের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে প্রবাসীদের জীবনে। সব ছেড়েছুড়ে পরদেশে পাড়ি দিয়ে দেশের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছেন এসব রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। জীবিকার তাগিদে গত দুইবছর (২০২০ ও ২০২১ সাল) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নোঙর ফেলেছেন চট্টগ্রামের সাড়ে ৩৫ হাজারেরও বেশি বাসিন্দা। নিজের ও পরিবারের ভাগ্য বদলাতে চলতি বছরের প্রথম চারমাসেই চমক দেখা গেছে চট্টগ্রামবাসীর বিদেশযাত্রায়। এসময়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন সাড়ে ২৫ হাজারের বেশি বাসিন্দা। যা পেছনে ফেলেছে গত দুই বছরের রেকর্ড। এরমধ্যে শুধু গতবছরই গেছে সাড়ে ২৪ হাজার মানুষ।

গত দুবছর করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও থেমে ছিলনা বিদেশযাত্রা। পরিবারের ভাগ্য বদলাতে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের মতো কঠিন পরিস্থিতিতেও দেশ ছেড়েছে বহু মানুষ। পরিবারের দুঃখ ঘোচাতে পিছিয়ে ছিলনা নারীরাও। তবে সে সংখ্যা ছিল তুলনামূলক কম। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয় ২০২০ সালের মার্চে। সে সময় লকডাউন শুরু হলে ওই মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে দুই মাসের বেশি সময় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকে। ফলে এপ্রিলে চট্টগ্রাম থেকে কর্মসূত্রে বিদেশগামীর সংখ্যা কমে দাঁড়ায় মাত্র ছয়জনে। পরের দুই মাস অর্থাৎ মে ও জুনেও নতুন করে কেউ বিদেশ যায়নি। পরবর্তীতে জুলাই মাসে একজন, আগস্টে তিন এবং সেপ্টেম্বরে একজন বিদেশ গেছেন। তবে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে বাড়তে থাকে বিদেশযাত্রার হার। আর চলতি বছর অল্প সময়ের মধ্যেই বিগত দুবছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। 

সারা দেশে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে বর্তমানে তৃতীয় অবস্থানে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম থেকে সৌদি আরব ও ওমানে বেশি লোক পাড়ি জমায়। এরপরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের আধিক্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। তারপর সিঙ্গাপুর, জর্দান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, মরিশাস, ব্রুণাই, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উৎপাদনসহ যাবতীয় কার্যক্রমের গতি বেড়েছে। এ কারণে বেড়েছে শ্রমিকের চাহিদা। পাশাপাশি সরকারের জি টু জি চুক্তিসহ প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রবাসীবান্ধব পদক্ষেপের কারণেই অর্থ উপার্জনে চট্টগ্রাম থেকে জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি।

জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে চট্টগ্রাম থেকে ১১ হাজার ৪৬০, কক্সবাজার থেকে ৫ হাজার ৪৯৫, বান্দরবান থেকে ১৬৬ ও রাঙামাটি থেকে মাত্র ৯৩ জন বাসিন্দা জীবন ও জীবিকার তাগিদে দেশ ছেড়ে গেছেন। গতবছর অর্থাৎ ২০২১ সালে চট্টগ্রাম মহানগরসহ বিভিন্ন উপজেলার ২৪ হাজার ৭৬৯ জন জনশক্তি রপ্তানি হয়েছিল। অপরদিকে চলতি বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের প্রথম চার মাসেই (জানুয়ারি-এপ্রিল) চট্টগ্রাম ছেড়েছে ২৫ হাজার ৬৩৭ জন।

জনশক্তি রপ্তানিতে পিছিয়ে নেই চট্টগ্রামের দুই পার্বত্য অঞ্চলও। ২০২১ সাল জুড়ে রাঙ্গামাটির ৪১৮ ও বান্দরবানের ২৮৯ জন বিদেশে পাড়ি জমান। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে রাঙ্গামাটির ৪০৬ জন ও বান্দরবানের ৩২৪ জন জীবিকার তাগিদে দেশ ছাড়েন। অপরদিকে গত বছরজুড়ে কক্সবাজার জেলা থেকে ৫ হাজার ৬২৭ জন প্রবাসে পাড়ি জমান। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে বিদেশযাত্রায় নাম লেখান কক্সবাজারের ৬ হাজার ৪৮ জন বাসিন্দা। 

সূত্র জানায়, ২০২১ সালের চট্টগ্রাম থেকে জানুয়ারিতে ১ হাজার ৩৮২, ফেব্রুয়ারিতে ২ হাজার ৭৩, মার্চে ২ হাজার ৭৬৪, এপ্রিলে ১ হাজার ৩০৯, মে মাসে ২৯৮, জুনে ১ হাজার ১২১, জুলাইয়ে ১৫১, আগস্টে ৫১৬, সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ৯৭৫, অক্টোবরে ২ হাজার ৪৩৩, নভেম্বরে ৪ হাজার ৩১০ ও ডিসেম্বরে ৬ হাজার ৪৩৭ জন লোক বিদেশে পাড়ি জমান। অপরদিকে চলতি বছর চট্টগ্রাম থেকে প্রথম চার মাসে অর্থাৎ জানুয়ারিতে ৭ হাজার ৬৪, ফেব্রুয়ারিতে ৬ হাজার ১৩, মার্চে ৬ হাজার ৫৬৩ ও এপ্রিলে ৫ হাজার ৯৯৭ জন দেশ ছেড়ে যান।

গতবছর চট্টগ্রামের দুই পার্বত্য অঞ্চলের মধ্যে বান্দরবান থেকে বিদেশযাত্রা করেন জানুয়ারিতে ১৭, ফেব্রুয়ারিতে ২৮, মার্চে ২৫, এপ্রিলে ১৫, মে মাসে ১১, জুনে ২০, জুলাইয়ে ৩, আগস্টে ৫, সেপ্টেম্বরে ২৪, অক্টোবরে ২৭, নভেম্বরে ৩৬ ও ডিসেম্বরে ৭৮ জন বাসিন্দা। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৮০, ফেব্রুয়ারিতে ৭৫, মার্চে ৭৯ ও এপ্রিলে ৯০ জন বিদেশ যান। অন্যদিকে রাঙ্গামাটি অঞ্চল থেকে গত বছরের জানুয়ারিতে ৮, ফেব্রুয়ারিতে ২১, মার্চে ৪৩, এপ্রিলে ৩৬, মে মাসে ২২, জুনে ৩১, জুলাইয়ে ১, আগস্টে ১৪, সেপ্টেম্বরে ৩৯, অক্টোবরে ৩৭, নভেম্বরে ৬৯ ও ডিসেম্বরে ৯৭ জন লোক জীবিকার তাগিদে দেশত্যাগ করেন। পাশাপাশি চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১১৪, ফেব্রুয়ারিতে ১০৬, মার্চে ৯০ ও এপ্রিলে ৯৬ জন লোক রাঙামাটি ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান। 

এদিকে কক্সবাজার জেলা থেকে গত বছরের জানুয়ারিতে ৫৮৬, ফেব্রুয়ারিতে ৮৭২, মার্চে ৬৮৪, এপ্রিলে ১৮১, মে মাসে ৭৬, জুনে ২৪৯, জুলাইয়ে ৩২, আগস্টে ১১৫, সেপ্টেম্বরে ৪২৫, অক্টোবরে ৫২২, নভেম্বরে ৭৭০ ও ডিসেম্বরে ১ হাজার ১১৫ জন। পাশাপাশি চলতিবছরের প্রথম চারমাসে অর্থাৎ জানুয়ারিতে ১ হাজার ২৯১, ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ৩৭৭, মার্চে ১ হাজার ৬৬৮ ও এপ্রিলে ১ হাজার ৭১২ জন রেমিট্যান্স যোদ্ধা কক্সবাজার ছেড়ে গেছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. জ্যোতি প্রকাশ দত্ত সিভয়েসকে বলেন, দিন দিন চট্টগ্রামের মানুষের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক একটা দিক। পর্যাপ্ত পরিচর্যা, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়ানো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলেই বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা আরও বাড়বে। এতে তাদের আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশেরও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সচিব (অর্থ) ড. আবদুল জলিল সিভয়েসকে বলেন, করোনার কারণে বিদেশযাত্রায় ভাটা পড়েছিল। কারণ ওই সময় আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলোও বন্ধ ছিল। তবে করোনার প্রভাব এখনো কাটেনি। এরপরও আমরা সাধ্যমত বিদেশে লোক পাঠানোর চেষ্টা করছি। বায়রার পক্ষ থেকে আমরা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। ফলে আমাদের দেশ থেকে দক্ষ লোক বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। 

তিনি আরও বলেন, গত ডিসেম্বরে সরকারের সাথে মালয়েশিয়ার জি টু জি চুক্তি হয়েছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে সেখানেও কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সৌদিআরব, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতি মানুষের আগ্রহ আগে থেকেই বেশি ছিল। এখন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও কাতারেও কিছু সংখ্যক লোক যাচ্ছে। তবে অসচেতনতার কারণে ভুয়া এজেন্সির খপ্পড়ে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন কেউ কেউ। বায়রার নিবন্ধিত এজেন্সির মাধ্যমে প্রবাসে গেলে প্রতারণার শিকার হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। পাশাপাশি চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের বিদেশযাত্রায় বর্তমানে যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে সামনে তা আরও বাড়বে বলে আমরা মনে করি।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়