আইনগত জটিলতায় এসপিএম প্রকল্প চালুতে দেরি
শুভ্রজিৎ বড়ুয়া, সিভয়েস২৪
চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃনোঙর থেকে লাইটার জাহাজে করে তেল আনয়নে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) চালু হতে যাচ্ছে আর চার মাস পর। সাগর থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু হলে প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয় কমবে সরকারের। লাভজনক হলেও প্রকল্পটি চালু করতে আইনগত জটিলতায় পড়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। কার্যক্রম (অপারেশন) পরিচালনাকারী সংস্থা নিয়োগে বিশেষ বিধান বাদ দিয়ে নতুন করে করা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলসের আওতায় জিটুজি পদ্ধতিতেও কাজটি পাচ্ছে চীনা প্রতিষ্ঠান সিপিপিইসি লিমিটেডই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের দিকে এসপিএম প্রকল্পটি হাতে নেয় বিপিসি। জার্মানির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আইএলএফ কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্সের পরামর্শে মহেশখালীর কালারমার ছড়ায় স্থাপন পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সাশ্রয়ী ও লাভজনক হওয়ায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ৮ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের জন্য ২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর চীনা এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করে সরকার। এ ঋণের বিপরীতে পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ড পাওয়া গেলেও ১৫ বছরের মধ্যে ২ টাকা ২০ পয়সা সুদসহ মূল অর্থ ফেরত দিতে হবে। ২০১৮ সালে কাজ শুরু করে প্রকল্পটি চীনা পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (সিপিপিইসি) লিমিটেডের সহযোগিতায় প্রায় ৯৯ দশমিক ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি রয়েছে কেবল কালারমা এলাকার একটি সার্ভিস রোড। নির্মিত হয়েছে মহেশখালীতে জাহাজ থেকে গভীর সমুদ্রের নিচ দিয়ে ১৩৫ কিলোমিটারের দুইটি পাইপলাইন। এছাড়া রয়েছে এইচডিডি ক্রসিং, মহেশখালী এলাকায় তিনটি স্টোরেজ ট্যাংক, পাম্পিং স্টেশন, ডিজেল ট্যাংক এবং ৩টি ব্লক ভাল্ভ স্টেশন।
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের সহ মহাব্যবস্থাপক (মেইন্টেন্যান্স) কে. এম. মাহমুদুল হক বলেন, ‘পাইপলাইন ও ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ শেষ হওয়ার পর ২০২৩ সালের ২৫ জুন প্রথমবারের মতো একটি লাইন দিয়ে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। ওটা সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি অন্যটি পরীক্ষামূলকভাবে অপরেশনে যায়। সেটিও সফলভাবে করা হয়েছে। তবে এটির অপারেশন নিয়ে সম্ভবত কিছু জটিলতা আছে। জটিলতা বলতে আমরা তো এ ধরনের কাজ আগে করিনি। তাই কোনো একটি এক্সপার্ট সংস্থাকে কাজ দেওয়ার জন্য একটা চেষ্টা চলছিল বলে জানি। পুরো বিষয়টি আমার জানা নেই।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে কথা হয় প্রকল্প কর্মকর্তা প্রকৌশলী মাহমুদ ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ ৯৯ দশমিক ৫০ শতাংশ শেষ। কাজ যেটুকু বাকি তা হলো এই প্রজেক্টে দুইটি এক্সটেনশন রোড হওয়ার কথা ছিল। আমরা একটির কাজ পুরো শেষ করেছি। আরেকটি রোড মহেশখালীর কালারমা ছড়া এলাকায় হওয়ার কথা। সেখানে কিছু ঘর-বাড়ি থাকায় কাজটি শেষ হতে সময় লেগেছে। এখন তাদের পুনর্বাসন করা হয়েছে। এরপরও ওখানে কিছু টেম্পরারি ঘর গড়ে উঠেছে। উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। তাদের সরিয়ে রোডের কাজ অল্প কিছুদিনের মধ্যে শেষ হবে।’
প্রকল্প ব্যয় নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি যখন নেওয়া হয়েছিল, তখন ডলার দর ১০৯ টাকা হিসেব করে ৮ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে। এখন তো ডলার দর বেড়ে গেছে। সে কারণে কিছু কাজে ব্যয় যা ধরা হয়েছিল, তার চেয়ে কিছুটা বেশি লেগেছে। তবে অন্যান্য দিকে খরচ কম হয়েছে। ফলে প্রাক্কলিত ব্যয় বাজেটেই কাজটি শেষ হবে। কিছু টাকা কমও লাগতে পারে।’
এ প্রকল্প কতটুকু সাশ্রয়ী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি শুরু হওয়ার আগে আইএলএফ কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্স নামে একটি জার্মানির প্রতিষ্ঠান পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছিল। ওই সময় তারা ৭০ টাকা ডলার দর হিসেব করে বলেছিলো মোর দ্যান (এর বেশি) ১০০ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হবে। সে হিসেবে অনেকে হয়তো ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হওয়া কথা বলছে। কিন্তু ডলার দর তো এখন আর ৭০ টাকায় নাই। সে হিসেবে আরও বেশি সাশ্রয় হওয়ার কথা। তবে এখনতো সবকিছুর ব্যয় বেড়েছে। ব্যয় বেশি হলেও পরিবহন, জাহাজ ভাড়া ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে টাইম ম্যানেজম্যান্টের কারণে সাশ্রয় অনেক বেশি হবে। কতটুকু সাশ্রয় হবে তা স্পেসিফিকভাবে বলতে না পারলেও আনুমানিক এক হাজার টাকা সাশ্রয় হওয়ার সম্ভাবনা দেখছি।
পরীক্ষামূলক অপারেশনে প্রকল্পটি কার্যকারিতা কেমন দেখেছেন তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ শেষ হওয়ার পর আমরা কিছুদিন অপারেশন করে দেখেছিলাম, যে জাহাজগুলো থেকে তেল খালাস করতে ১০ থেকে ১১ দিন লাগে, তা ৪৮ ঘণ্টায় করা সম্ভব হয়েছে। তাই সব দিক থেকে আমরা প্রকল্পটি সফল ও লাভজনক হিসেবেই বিবেচনা করছি। তবে অপারেশনের কাজটি শুরুতে আমরা হয়তো করবো না। এরজন্য জি টু জি (সরকার থেকে সরকার) ভিত্তিতে চীনা পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (সিপিপিইসি) লিমিটেডের হয়তো কাজ করবে। তবে বিষয়টি বিপিসি ভালো বলতে পারবে।’
বিপিসির অপারেশন ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক অনুপম বড়ুয়া সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ। এখন অপারেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। সামনে কয়েকদিনের মধ্যে জিটুজি টেন্ডারের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ বুঝিয়ে দিবো। এটির কাজ বিশেষ বিধানের আওতায় প্রায় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দেশের সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তনের কারণে বিশেষ বিধানটি বাতিল হয়ে যায়। তাই কাজ থেমেছিল। না হয়, চীনা প্রতিষ্ঠান সিপিপিইসির সঙ্গে তো আমাদের চুক্তি প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর একবার সিটিংয়ে চুক্তিটি হয়ে যেত। কিন্তু সেটা তো আর হয়নি।’
এখন কারা কখন নিয়োগ পাবে আর কাজ কখন শুরু হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিশেষ জ্বালানি নিরাপত্তা বিধান বাতিল হওয়ায় নতুন করে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলসের আওতায় নিয়োগের কাজটি হবে। জিটুজি পদ্ধতিতে কাজটি হওয়ার কারণে সিপিপিইসি লিমিটেডই কাজটি পাবে। তবু ফরম্যালি আমরা অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স ঠিকাদার নিয়োগের বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞের মতামতসহ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠিয়েছি। বিপিসি মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যে টেন্ডারও ছাড়া হবে। এরপর দুই বা তিন বছরের অপারেশনের জন্য চীনা প্রতিষ্ঠান সিপিপিইসি লিমিটেডকে জিটুজি-এর আওতায় কাজটি বুঝিয়ে দেওয়া হবে। আশা করছি, আগামী মার্চ-এপ্রিল থেকে এসপিএমের অপারেশন পুরোপুরিভাবে চালু হবে।’