মোবাইলে ভিডিও ধারণ নিয়ে বিতণ্ডার রেশে সিইপিজেডে শ্রমিক সংঘর্ষ
সিভয়েস২৪ প্রতিবেদক
চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) প্রধান ফটক বন্ধ করে আন্দোলনের সময় শ্রমিকদের প্রবেশে বাধা দেয়া নিয়ে বিবাদ, পরে বিবাদের ভিডিও ধারণ নিয়ে মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়া— তিনদিন আগে (বুধবার) ঘটে যাওয়া এ ঘটনার রেশ ধরেই শনিবার (১১ জানুয়ারি) পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা একাধিক শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে সংঘর্ষের পরপরই মেরিমো কারখানা তিনদিন এবং জেএমএস কারখানা দুইদিনের জন্যে বন্ধ ঘোষণা করছে কর্তৃপক্ষ। এই বন্ধের মধ্যেই উভয় কারখানার মালিকপক্ষের সাথে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ আলোচনায় বসবে—শ্রমিকদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনে। এছাড়াও ঘটনাস্থলে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উভয় কারখানার শ্রমিকদের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সেই সতর্কবার্তা দিয়েছেন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (সন্ধ্যা ৭টা) সংঘর্ষ এবং হামলার ঘটনায় থানায় কেউ অভিযোগ দেয়নি।
পুরোনো দ্বন্দ্বের জেরে সংঘর্ষ
শ্রমিকরা জানায়, বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে বুধবার আন্দোলন করে মেরিমো কারখানার শ্রমিকরা। একপর্যায়ে তারা সিইপিজেডের প্রধান ফটক বন্ধ করে দেন। সেসময় ওই গেইট দিয়ে জেএমএস কারখানার শ্রমিকরা প্রবেশ করতে চাইলে দুই পক্ষ তর্কাতর্কিতে জড়ায়। ওই ঘটনার ভিডিও ধারণ করতে গেলে জেএমএস কারখানার এক শ্রমিককে মারধর করে মুঠোফোন ছিনিয়ে নেয়। এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দুটি কারখানাই ছুটি দিয়ে পরদিন ঘোষণা করে। শুক্রবারও বন্ধ থাকার পর শনিবার সকালে কারখানা দুটিতে কাজে যোগ দেন শ্রমিকরা।
উভয় কারখানার শ্রমিক এবং শিল্প পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, কাজে যোগ দেওয়ার আধ ঘণ্টা পরই উভয় কারখানার শ্রমিকরা সড়কে নেমে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। একপর্যায়ে মেরিমো কারখানার মালিকানাধীন আরেক কারখানা মেরিম কো এবং জেএমএস গ্রুপের মালিকানাধীন মডিস্ট কারখানার শ্রমিকরাও সংঘর্ষে সমর্থন দিতে লাঠিসোঁটা হাতে সড়কে নেমে আসেন। এই চার কারখানার শ্রমিকরা এরপর দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়ান।
জেএমএস কারখানার শ্রমিক সৌমেন বলেন, ‘সাড়ে ৮টার দিকে আমরা বুঝে ওঠার আগেই এখানে অতর্কিত হামলা শুরু হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী কারখানা থেকে ছোড়া পাথরে আমাদের কারখানার গ্লাস ভেঙে অনেকেই আহত হয়। এর ফলে আমাদের শ্রমিকরাও রাস্তায় নেমে পড়ে।’
মোবাইলে ভিডিও করাকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত—এমন অভিযোগ তুলে একই কারখানার আহত আরেক শ্রমিক বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার মেরিমো যখন দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রথম আন্দোলনে নামে তখন আমাদের কিছু লোকজন ভিডিও করছিল। ভিডিও করাকে কেন্দ্র করে আমাদের কিছু ছেলের মোবাইল নিয়ে গিয়ে মারধর করে। একপর্যায়ে গেইট ভেঙে হামলা চালায়।’
মেরিমো কারখানার এক শ্রমিক বলেন, ‘গত ৭ তারিখ আমরা বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিলাম। আন্দোলন শেষে আমরা চলে যাচ্ছিলাম। তখন বেপজার মেইন গেইট আটকে দেয় ওরা (জেএমএস কারখানার শ্রমিক)। বেপজার গেইট আটকানোর কারো এখতিয়ার নাই। এরপর আমরা খুলে চলে গেছি। পরদিন জেএমএস একজন নারী শ্রমিক মাইকে মেরিমো অ্যাটাকের ঘোষণা দেয়। আমাদের গোপাল নামে একজন শ্রমিকসহ ওইদিন ৯ জন আহত হয়। আমাদের জিএম স্যার ঘোষণা দিয়েছেন, সংঘাতে না জড়াতে।’
আজকের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ডিউটি টাইম সাড়ে ৭টায়। ওদের ডিউটি ৮টা থেকে। আমরা আধঘণ্টা কাজ করার পর হঠাৎ আমাদের অ্যাটাক করে। আমরা বাঁচার জন্য পাল্টা আক্রমণ চালাই। আমাদের কারখানার সব ভেঙে ফেলেছে। আমাদের শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছে। আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার সময় অ্যাম্বুলেন্সেও হামলা চালিয়েছে।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মেরিমো কারখানার ফিনিশিং ডিপার্টমেন্টে কর্মরত আলী আকরাম হোসেন সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘দুপুরে লাঞ্চ, ৯ শতাংশ বেতন বাড়ানোসহ আট দফা দাবিতে আমরা আন্দোলন করছিলাম। কোম্পানি আমাদের দাবি-দাওয়া মানছে। একদিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করছে। এরপরে অফিসে আসলে আমাদেরকে একটায় ছুটি দিয়ে দিছে। আমরা যখন বের হইতে যাবো তখন গেইট আটকায় আমাদের উপর হামলা চালায়।
একই প্রতিষ্ঠানের আরেক আহত পোশাক শ্রমিক মো. বেলাল বলেন, ‘অফিসের লোকের চাইতে বাইরের লোক বেশি ছিল। সবার মাথায় হেলমেট ছিল। আমরা কাজ করতেছি, ওরা হেলমেট পরে এসে আমাদের উপর হামলা চালায়। ওরা ৮ তারিখও আমাদের অফিসে হামলা চালায়। তখন কোম্পানি বলছে আমরা ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো। তোমরা অফিসে চলে যাও, কাজ করো। আমরা কাজ করতেছি। এরপরে আজকে এসে আবারও হামলা চালায়।’
সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ-বিজিবি-সেনা-নৌবাহিনী
সকাল থেকে ঘণ্টাব্যাপী চার কারখানা শ্রমিকদের সংঘর্ষে পুরো এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সিইপিজেডের প্রবেশমুখে এক নম্বর সড়কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ইটপাটকেল। ঘণ্টাব্যাপী চলা সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে শিল্প পুলিশের পাশাপাশি ঘটনাস্থলে ছুটে যায় থানা পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি এবং নৌবাহিনীর সদস্যরা। এরপরেই তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত হালিশহর সেনানিবাসের টাস্কফোর্স-৩ এর মেজর আরেফিন কবির সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকালে তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুটো গার্মেন্টস শ্রমিকরা নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়ায়। দুপক্ষেরই নিজেদের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি রয়েছে। এই সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে আস্তে আস্তে বিবাদটি বড় আকারে ধারণ করলে একপর্যায়ে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়। এতে দুপক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হয়। আমরা এসে দুই কারখানার ঊর্ধ্বতনদের সাথে এবং শ্রমিক নেতাদের সাথে কথা বলেছি। তাদেরকে ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সেটি বলে দিয়েছি। এছাড়া, দুই কারখানার কর্তৃপক্ষকে বেপজা অফিসে ডাকা হয়েছে। পুরো ঘটনায় ভেতরে বা পেছনে কারো কোনো ইন্ধন আছে কিনা—বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করবো।’
নৌবাহিনীর কমান্ডার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘শ্রমিকদের ভুল বোঝাবুঝির কারণে ৪টা গার্মেন্টস এর ভেতর মারামারি ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিকরা আহত হয়েছেন অনেকে। অনেককেই আমরা উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছি। আমাদের উপস্থিতিতেই কারখানা তিনদিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।’
চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের নির্বাহী পরিচালক মো. আবদুস সোবহান সিভয়েস২৪’কে জানিয়েছেন, ‘জেএমএস এবং মেরিমো কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি থেকে একটু মারামারি হয়েছে। মালিকরা তাদেরকে বুঝিয়েছেন। এখন পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। উভয় কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।’
সবশেষ পরিস্থিতি জানতে চাইলে শিল্প পুলিশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. সুলাইমান সন্ধ্যায় সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘ঘটনার সূত্রপাত তিনদিন আগের। ওইদিন উভয় কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। সেই থেকেই আজকের এই সংঘর্ষ। আজকে উভয় কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। শ্রমিকদের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব নিরসনে মালিকপক্ষ আলোচনায় বসবে।’
হামলায় বহিরাগত কেউ আসার সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত এলাকা। এখানে বহিরাগত আসার সুযোগ নেই। আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলে সেটি থানা পুলিশ বলতে পারবে। যারা আহত হয়েছেন তাদের মধ্যে গুরুতর আহত কেউ নেই।’
জানতে চাইলে নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (বন্দর) মাহমুদুল হাসান সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘সিইপিজেডে সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেনি। আমরা এখনো সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। সংঘর্ষের পর মেরিমো তিনদিন এবং জেএমএস কারখানা দুইদিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।’
সিভয়েস২৪/