Cvoice24.com

‘ভর্তুকির’ ভারে ৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে চায় চসিক

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২২:১৬, ৫ ডিসেম্বর ২০২২
‘ভর্তুকির’ ভারে ৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে চায় চসিক

প্রায় ৬৫ বছর আগে চট্টগ্রামের জামালখানের আসকারদিঘীর পাড় এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ছালেহ জহুর সিটি করপোরেশন কিন্ডারগার্টেন স্কুল। ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি ৪১ বছর পর অধিগ্রহণ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আয়ত্বে আনেন প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। গত ২৩ বছর ধরে সিটি করপোরেশনের পরিচালনায় পরিচালিত হচ্ছে এই কিন্ডারগার্টেন স্কুলটি। 

তবে করোনা পরবর্তী এ কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কমে যায়। শিক্ষকের সংখ্যা বেশি এবং শ্রেণিকক্ষ আর শিক্ষার্থী সংকটের অজুহাতে কিন্ডারগার্টেন এ স্কুলটি বন্ধ করতে চায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। বন্ধের তালিকায় শুধু যে এই কিন্ডারগার্টেন স্কুল তা কিন্তু নয়। সিটি করপোরেশন পরিচালিত ৯টি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের মধ্যে তিনটিই বন্ধের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যদিও স্কুল বন্ধ করার বিষয়টি কোনোভাবে স্বীকার করতে চাইছেন না সংশ্লিষ্টরা। যদিও বছরের পর বছর ভর্তুকি দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন সংস্থাটির হর্তাকর্তারা। 

চসিকের শিক্ষাবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুর দিকে চসিক পরিচালিত কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো বন্ধের আভাস দেয় কর্তৃপক্ষ। চসিকের কর্তাব্যক্তিদের দাবি— চসিক পরিচালিত এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। সে তুলনায় শিক্ষার্থী কম। আর তাই এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারণে বছর বছর ভর্তকি গুণতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের উদ্যোগ নেয় চসিক। যদিও শিক্ষার্থী সংকটের অজুহাতকেই তুলে ধরে চসিক। এ নিয়ে কমিটিও গঠন করা হয়। দফায় দফায় মিটিং শেষে সর্বশেষ গত ২৩ নভেম্বর চসিকের শিক্ষা স্থায়ী কমিটির এক সভায় একটি রেজুলেশন করা হয়। যদিও এরমধ্যে শিক্ষার্থী বাড়ানোর কোনো পদক্ষেপই নেয়নি কর্তৃপক্ষ। তবে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো বন্ধের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে তড়িগড়ি করে আগামীকাল (৬ ডিসেম্বর) সকালে শিক্ষা স্থায়ী কমিটির একটি জরুরি সভাও ডাকা হয়েছে।

এদিকে, চসিকের শিক্ষা স্থায়ী কমিটির ওই রেজুলেশনে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্ডারগার্টেন স্কুলটি ছালেহ জহুর সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পরিচালিত হচ্ছে। স্কুলের পাশে সরকারি ন্যাশনাল প্রাইমারি স্কুলটিতে বিনাবেতনে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত থাকায় আশেপাশের অসংখ্য শিক্ষার্থী ওই প্রাইমারি স্কুলটিতে ভর্তি হয়। যার কারণে ধীরে ধীরে এ স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। 

জানা যায়, বন্ধের তালিকায় থাকা তিন স্কুলের মধ্যে ছালেহ জহুর সিটি করপোরেশন কিন্ডারগার্টেন স্কুলের বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯০ জন। অন্য দুই স্কুলের একটিতে বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫১ জন এবং অন্যটিতে ৬১ জন। যদিও এ তিন স্কুলে বর্তমানে শিক্ষক রয়েছেন ৫ থেকে ৬ জন করে। স্কুল বন্ধ করার প্রক্রিয়া শুরুর আগে থেকেই প্রায় সব কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে শিক্ষকদের বদলির প্রক্রিয়া শুরু করে চসিক। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্বপ্নই হচ্ছে এই কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো। এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয় নিয়ে সমালোচনা হওয়ার কারণে তারা (কর্তৃপক্ষ) এখন অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত করার চেষ্টা করবেন। স্কুল সংযুক্ত করা মানেই স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়া। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো লাভজনক প্রতিষ্ঠান নয়। তাই শিক্ষা থেকে লাভ না খুঁজে একে কি করে মানসম্মত করা যায় চসিকের সেই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’

এই কর্মকর্তার সাথে একমত পোষণ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি করপোরেশন স্কুলের এক শিক্ষক সিভয়েসকে বলেন, ‘এর আগে কোনো মেয়রই এই রকমভাবে স্কুলকে বাণিজ্যিক চিন্তা ভাবনায় নেয়নি। সাবেক মেয়র আজম নাছির উদ্দিন, মন্জু সাহেব সকলেই স্কুল কলেজ বাড়িয়েছেন। তারা শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সেটা ভর্তুকি দিয়ে হলেও। কারণ বর্তমান সরকারও শিক্ষার মান বাড়ানো এবং শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করছে। কিন্তু চট্টগ্রামের মেয়র চলছে বিপরীত দিকে। আমি মনে করি বর্তমান মেয়রের এই স্কুল বন্ধের চিন্তাটা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। একইসঙ্গে যা সামনের নির্বাচনে তার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে আমি মনে করি। মেয়রের স্কুল বন্ধে এই নীতি কখনোই সমথর্ন যোগ্য নয়।’

আরেক শিক্ষক বলেন, ‘কী বলবো বলেন। দু:খজনক হলেও সত্যি যে এখন সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীলরা আমাদের শিক্ষকদের কোনো মূল্যায়ন করে না। প্রয়াত মেয়রের প্রতিষ্ঠিত যে স্কুলগুলো আছে সেটা বন্ধ করার জন্য অনেকে উঠে পড়ে লাগছে। তারা বলছে যে স্কুলে ভতুর্কি দিয়ে দিয়ে নাকি করপোরেশন ফকির হয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে এক টাকাও আসছে না তাই বন্ধ করে দেওয়াই উচিত। যেখানে সরকার শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্য কোনো চেষ্টার কমতি রাখছেন না; সেখানে আমাদের করপোরেশন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে স্কুল বন্ধ করার। স্কুল কি ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান? আমাদের আসলে বলার কিছু নেই।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বরাবরের মতো এড়িয়ে যাওয়া মনোভাব নিয়ে চসিকের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফর নাহার সিভয়েসকে বলেন, ‘কই এমন কিছু তো আমার নলেজে নাই। আমি জানি না।’

আগামীকালের মিটিং প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে কিছুসময় চুপ থেকে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আসেন অফিসে। ফোনে ফোনে আর কি তথ্য নিবেন।’ —এই বলেই মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা। 

প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে সদুত্তর না পেয়ে চসিকের শিক্ষা স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর নিছার উদ্দিন আহমেদ মন্জুর কাছে জানতে চাইলে তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘আমরা এখনো সেরকম সিদ্ধান্ত নেয়নি। এটার আরও সম্ভাব্যতা যাচাই করবো। স্টুডেন্ট কীভাবে বাড়ানো যায়। সেসব আগে বিবেচনা করে দেখবো। এরপর প্ল্যান অনুযায়ী বাকি সিদ্ধান্ত। যদি আমরা নিতান্তই না পারি তাহলে আমাদের অন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সেগুলোর সঙ্গে একত্রিকরণ করবো। 

প্রয়াত মেয়রের প্রতিষ্ঠিত বলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা একটা রিউমার। এটা সত্য নয়। প্রয়াত মেয়র বা অন্য যারা মেয়র এসেছেন সকলেই শিক্ষার দিকে নজর দিয়েছেন। এখানে কেউ কিন্তু বন্ধ করেনি। আশা করি আগামীতেও বন্ধ হবে না। তবে পার্শ্ববর্তী সব কারণ বিবেচনা করে যদি দেখি শিক্ষার্থীই নাই বা আমরা শিক্ষার্থী না পাই তাহলে ভতুর্কি দিয়ে আর কত?। এখন এখানে যদি অন্য স্কুলের সাথে মার্চ করা হয় তাহলে তো আর অসুবিধা থাকলো না।’

একই বিষয়ে জানতে চাইলে চসিকের শিক্ষা স্থায়ী কমিটির সদস্য কাউন্সিলর আবুল হাসনাত মো. বেলাল সিভয়েসকে বলেন, ‘একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া কোনো ইতিবাচক দিক না। এখন যদি শিক্ষার্থী কম থাকে তখন সে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। যদি ছাত্রছাত্রী না থাকে তাহলে মাসের পর মাস ভতুর্কি দিয়ে তো করপোরেশন চলতে পারে না। তবে আমাদের চেষ্টা থাকবে যে যেকোনো অবস্থায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না হয়।’

শিক্ষার্থী সংকটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া যুক্তিসংগত নয় উল্লেখ করে শিক্ষাবিদ ড. আনোয়ারা আলম সিভয়েসকে বলেন, ‘শিক্ষার্থী সংকটের অজুহাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এই সিদ্ধান্তটা আমি মনে করি চসিকের একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এটা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। যারা শিক্ষা কমিটিতে আছেন তারা সবাই মিলে বসে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ না করে কীভাবে শিক্ষার্থী বাড়ানো যায় সেই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষাক্ষেত্রে ভতুর্কি নতুন কোনো বিষয় না। সরকার সবসময়ই দিচ্ছে। আর শিক্ষাক্ষেত্রে ভতুর্কি দেওয়া মানে আমাদের এসডিজি গোলে একধাপ এগিয়ে যাওয়া। আমি মনে করি চসিকে কিছু সমন্বয়হীনতা আছে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে যে কারণে ভতুর্কির দোহাই দেখানো হয়েছে। এখানে শিক্ষার্থীর অভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত কোনো সমাধান নয়। কীভাবে এ সংকট উত্তোরণ করা যায় সেই বিষয় গুলো নিয়ে চসিকের ভাবতে হবে।’

একই বিষয়ে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল এন্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, ‘করোনা পরবর্তী আর্থিক সংকটের কারণে অনেক কিন্ডারগার্টেন স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই ছিল ভাড়া বাসায়। যে কারণে আর্থিক সংকট প্রকট আকারে দেখা দেয়। কিন্তু সিটি করপোরেশনের তো বাসা ভাড়া দেওয়া লাগে না বা এই ধরনের সমস্যা নেই। তাও শিক্ষার্থী সংকটের দোহাই দিয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত খুবই বাজে সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত থেকে চসিকের অবশ্যই সরে আসা উচিত।’

সিভয়েস/এসআর
 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়