Cvoice24.com

অবসরের পরও ‘মিষ্টি’ চেয়ারটি ছাড়েননি নুর মোহাম্মদ
প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে এত মধু!

সিভয়েস২৪ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১১:৩২, ৭ নভেম্বর ২০২৪
প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে এত মধু!

# জনবল সংকটের কথা বলছেন ঊর্ধ্বতনরা # ‘স্যারের অনুরোধে আমি অফিস করছি’ # ‘কোনো নথিপত্রে স্বাক্ষর করি না’

চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সহকারী মনিটরিং অফিসার নুর মোহাম্মদ। অবসোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) গেছেন ৮ মাস আগে। তবে তাঁর পিআরএল শুধু কাগজে কলমে, এখনো দিব্যি অফিস করছেন তিনি। যদিও সরকারি কর্মচারী আইন ২০১৮ অনুযায়ী, কোনো কর্মচারী অবসর গ্রহণের পর ওই পদে থাকতে পারবেন না।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বলছেন, জনবল সংকটের কারণে অনুনয়-বিনয় করে অভিজ্ঞ হিসেবে তাঁর সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘদিনের কর্মস্থলের প্রতি ভালোবাসার জায়গা থেকে তিনি তাদের অনুরোধের ঢেঁকি গিলেছেন। একদিকে জনবল সংকট, তার ওপর অভিজ্ঞ কেউ নেই। এমন পরিস্থিতিতে তিনি ‘না’ করলে অফিসই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি তাঁর শূন্য পদে এখন পর্যন্ত কাউকে পদায়ন করা হয়নি।

প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম জেলায় ৬টি থানা শিক্ষা অফিস ও ১৫টি উপজেলা শিক্ষা অফিসসহ মোট ২১টি শিক্ষা অফিস রয়েছে। শিক্ষা অফিসের সকল বিষয়ে মনিটরিং করার দায়িত্বে আছেন নুর মোহাম্মদ। গত ২০ বছর ধরে সহকারী মনিটরিং অফিসার পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এ কর্মচারী অবসরে যাওয়ার পর থেকে গত ৮ মাস ধরে শূন্য রয়েছে এ পদ। এমনকি ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বও দেওয়া হয়নি অন্য কাউকে। এ নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে কয়েক দফা চিঠি দিয়েও সাড়া মেলেনি বলে জানান কর্তৃপক্ষ।

জেলা শিক্ষা অফিস থেকে জনবল সংকটের কথা বললেও শিক্ষা অফিস ঘিরে বদলি বাণিজ্য, বিল-ভাউচার পাসসহ নানান বিষয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে ‘উৎকোচ’ নেওয়া অনেকটা ওপেন সিক্রেট। শিক্ষকরা প্রশাসনিক জটিলতা, শাস্তির মুখে পড়ার ভয়ে এসব নিয়ে কখনো মুখ খুলতে চান না। মূলত এসব ঘিরেই চেয়ার খালি করছেন না সংশ্লিষ্টরা— এমনই বলছেন কেউ কেউ। তবে অবসরে যাওয়া সহকারী মনিটরিং অফিসার নুর মোহাম্মদের অফিসজুড়ে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবার কাছে তিনি পরোপকারী হিসেবে শ্রদ্ধার প্রাত্র। তাই তাঁর ক্ষেত্রে এসব কথা উড়িয়ে দিয়েছেন সবাই।

জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সাবেক সহকারী মনিটরিং অফিসার মো. নুর মোহাম্মদ সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘গত মার্চ থেকে আমার পিআরএল চলছে। নতুন কাউকে এখনো দেওয়া হয়নি। যার কারণে জরুরি কাজের ক্ষেত্রে স্যার আমাকে আসতে অনুরোধ করেছেন। এজন্য ১২টার দিকে যাই আবার দুপুর তিনটার দিকে চলে আসি।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘২০ বছরের ওপরে এ অফিসে কাজ করেছি। অফিসের সব মুখস্ত আছে আমার। আমি যেদিন থেকে পিআরএলে চলে আসছি সেদিন থেকে কোনো নথিপত্রে স্বাক্ষর করি না। এখন লোক নাই আবার আমার কাজ অন্য কেউ জানেও না তাই স্যারের অনুরোধে আসি। না হয় আমার এখানে কাজ কী? আমি তো বাসায় আরাম করে থাকতে পারি।’ 

অবসরে যাওয়ার পরেও সহকারী মনিটরিং অফিসারের নিয়মিত অফিস করার বিষয়টি স্বীকার করে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এস এম আব্দুর রহমান সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘আমাদের দক্ষ কর্মচারির অভাব আছে। সেটা শুধু এখন না, অনেক বছর ধরেই। তিনি দীর্ঘদিন এ অফিসে ছিলেন; সেজন্য আমরাই বলছি যে আমাদের কাজেকর্মে যেন একটু সহযোগিতা করেন। তবে ব্যাপারটা যে অফিসিয়ালি অফিস করছেন তা কিন্তু না।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অন্য কাউকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিলেও দেওয়া যেত। কিন্তু উনার মতো দক্ষতার সাথে পারতো না। ওই কর্মচারীই উল্টো দায়িত্বের ভারে নুয়ে যেত। উনি (নুর মোহাম্মদ) কোনো কাজ লিখিতভাবে করছেন না, স্বাক্ষরও করছেন না। যারা অফিসিয়াল আছেন তারাই করেন। উনি শুধু কাজে সহযোগিতা করেন। আর উনার পদে আমাদের কোনো লোক নাই। আসার কোনো ওয়েও নাই। এমনিতেই আমাদের বিস্তর শূন্য পদ রয়েছে। এমনও উপজেলা রয়েছে যেখানে পদ রয়েছে ৫টি অথচ আছে মাত্র একজন। প্রায় সব উপজেলায় এমন চিত্র।’ 

অফিস করার কোনো সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না জানিয়ে এ শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘তিনি বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। এমনকি এই অফিসের আসার জন্য কোনো বেতন ভাতাও তাকে আমরা দেই না। মূলত তিনি খুব দক্ষ কর্মচারী। অফিসিয়াল প্রায় সব ফাইল সম্পর্কে বা যেকোনো নথির বিষয়ে তার জানাশোনা আছে। কোনো একটা ফাইল খুঁজে পাচ্ছি না। জানতে চাইলে দেখা যায় অন্য কেউ বলতে পারেন না, সেটা নুর মোহাম্মদ জানেন। এজন্য আমরাই তাকে অনুরোধ করেছি যাতে সময় সুযোগ করে এসে আমাদের সহযোগিতা করেন। তিনি সহযোগিতা না করলে আমরা সাফারার হবো।’

এদিকে, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে অনুমোদিত পদের বিপরীতে খুব একটা সংকট না থাকলেও কেবল মনিটরিং অফিসার ও সহকারী মনিটরিং অফিসারের পদ দুটি শূন্য রয়েছে। তবে থানা শিক্ষা অফিস ও উপজেলা শিক্ষা অফিসে অনুমোদিত পদের বিপরীতে প্রায় ৫০ শতাংশ পদ দীর্ঘ অনেক বছর ধরেই শূন্য রয়েছে। নতুন নিয়োগ না দেওয়ায় পাঁচজনের দায়িত্ব একজনকে দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর শূন্য পদের সংখ্যাই সবচাইতে বেশি।

প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে আরো জানা যায়, চট্টগ্রামের ২১টি থানা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসে তৃতীয় শ্রেণির অনুমোদিত পদের সংখ্যা ৭৭। অথচ এখানে শূন্য পদই রয়েছে ৪৩টি। এছাড়াও শিক্ষা অফিসারের অনুমোদিত পদ রয়েছে ৯৭টি; আর বর্তমানে কর্মরত আছে ৪৯ জন। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে শূন্য রয়েছে ৪৮টি পদ। শূন্য পদের তথ্য জানিয়ে গত ১৪ আগস্ট ও ১৫ আগস্ট প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে এ সংক্রান্ত দুটি চিঠি পাঠায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়

: