নারায়নকে বাঁচাতে শিক্ষা বোর্ডের সময়ক্ষেপণ!
শারমিন রিমা, সিভয়েস২৪
নিজের ছেলের এইচএসসি পরীক্ষার ফল জালিয়াতিতে আলোচিত চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব নারায়ন চন্দ্র নাথের বিরুদ্ধে চার মাসেও ফৌজদারি মামলা করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা স্বত্বেও নানা অজুহাতে গড়িমসি করছে তারা। অভিযোগ উঠেছে— নারায়ন চন্দ্র নাথকে বাঁচাতেই সময়ক্ষেপণ করছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। তবে অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার আগেই মামলা করা হবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান। আর চলতি মাসের শেষে অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার কথা রয়েছে বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেজাউল করিমের।
শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ফল জালিয়াতি কাণ্ডে বোর্ডের পরীক্ষা শাখা ও কম্পিউটার শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম জড়িয়ে যায়। ফলে ১৫ অক্টোবর প্রকাশিত ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশে বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনার কথা জানিয়ে ফৌজদারি মামলা দায়েরে পিছপা হয় বোর্ড কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে একইভাবে পুনঃনিরীক্ষণের অজুহাত দেখিয়ে গড়িমসি শুরু করে তারা। গত ১৪ নভেম্বর পুনঃনিরীক্ষণের ফল প্রকাশ পায়। তারপর প্রায় ২ মাস কেটে গেলেও এখনো পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মানেনি বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
এর আগে, গত দুই বছর ধরে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র নাথের ছেলের এইচএসসি পরীক্ষার ফল জালিয়াতির ঘটনা ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। শিক্ষা বোর্ডের সচিব থাকাকালে ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেন তার ছেলে নক্ষত্র দেবনাথ। পরে তার জিপিএ-৫ পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠে। এমনকি বিষয়টি গড়ায় থানা আদালতেও। শেষে ঘটনা তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। নানা নাটকীয়তার পর তদন্তে ফল জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর তাকে (নারায়ন চন্দ্র নাথ) বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে ফৌজদারি মামলার নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে ছেলের ফলাফল বাতিল করে জালিয়াতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাসহ ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে সেই নির্দেশনার এক সপ্তাহের মাথায় গত ২৩ সেপ্টেম্বর বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয় নারায়ন চন্দ্র নাথকে। তারও এক মাস পর গত বছরের ২৪ অক্টোবর বাতিল করা হয় ছেলের ফলও। তবে এখনো পর্যন্ত অভিযুক্ত নারায়ন চন্দ্র নাথ কিংবা ফলাফল জালিয়াতিতে বাকি জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে, ফল জালিয়াতির তদন্তে নারায়ন চন্দ্র নাথ ছাড়াও বোর্ডের দৈনিক শ্রমিক আবদুর রহমান, প্রোগ্রামার আবদুল মালেক, কম্পিউটার সেলে কর্মরত দৈনিক ভিত্তিক স্ক্যানার শিবলু ও নোমান, সহকারী প্রোগ্রামার আবুল হাসনাত এবং মো. রাজুর নাম ওঠে আসে। এ নিয়ে গত ২০ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের স্বাক্ষরিত এক অভিযোগনামায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর ৩ (খ) ধারা অনুযায়ী নারায়ন চন্দ্র নাথকে অসদাচরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। একই বিধিমালার ৪ (৩) (ঘ) ধারা অনুযায়ী তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার কথা উল্লেখ করা হয়। এমনকি তাকে বরখাস্ত কেনো করা হবে না তা জানতে চেয়ে এরই মধ্যে শোকজ করা হয়েছে। ওই শোকজ নোটিশের জবাব ১০ কার্য দিবসের মধ্যে লিখিতভাবে জানাতে বলা হয়েছিলো। যদিও তিনি (নারায়ন চন্দ্র নাথ) শেষ পর্যন্ত শোকজের জবাব দিয়েছেন কিনা তা জানা যায়নি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে অধ্যাপক নারায়ন চন্দ্র নাথের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও সেটির সংযোগ পাওয়া যায়নি।
একই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান রেজাউল করিম সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। আমরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক ধারাবাহিকভাবে আগাচ্ছি। গত ১৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের একটা নির্দেশনা দিয়েছিল। সেই মোতাবেক আমরা শৃঙ্খলা কমিটির সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে নারায়ণ চন্দ্র নাথের ছেলের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করা হয়। এটা ইজি (সহজ) প্রক্রিয়া ছিল না। দুইটা কমিটির মিটিং শেষে চূড়ান্ত গেজেট করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছি।’
ফৌজদারি মামলা দায়ের করা প্রসঙ্গে বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, ‘এখানে আইনি অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে। তাই বোর্ডের আইন উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি।’
‘নারায়ন চন্দ্র নাথকে বাঁচাতেই সময়ক্ষেপণ করছে বোর্ড’ এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমার মেয়াদকাল আরও ২০-২৫ দিনের মতো আছে। এ সময়ের মধ্যে কী কী করবো তার একটা লিস্ট আছে। তার মধ্যে এ এজেন্ডাটাও গুরুত্বের সঙ্গে আছে। আর বেশি কিছু বলতে চাই না।’
নারায়ণ চন্দ্র নাথের বিরুদ্ধে এ জালিয়াতির জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হবে বলে জানান বোর্ড চেয়ারম্যান।
উল্লেখ্য, নারায়ণ চন্দ্র নাথ সর্বশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) বিভাগের চট্টগ্রামের পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। ২০২৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ওই বছর তার ছেলে নক্ষত্র দেবনাথ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। ফলাফল ঘোষণার পর অভিযোগ ওঠে, নারায়ণ চন্দ্র নাথ তার ছেলেকে জালিয়াতির মাধ্যমে জিপিএ ফাইভ পাইয়ে দিয়েছেন। কে বা কারা নক্ষত্রের ফলাফল পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করলে তার মা বনশ্রী দেবনাথ নগরের পাঁচলাইশ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এর ফলে বিতর্ক আরও জোরালো হয়। এ অবস্থায় জালিয়াতির অভিযোগ তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কমিটি গঠন করা হয়।