Cvoice24.com

বাবা মানে নির্ভরতার আকাশ— গণমাধ্যম কর্মীদের স্মৃতিচারণ

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২১:২৪, ২০ জুন ২০২১
বাবা মানে নির্ভরতার আকাশ— গণমাধ্যম কর্মীদের স্মৃতিচারণ

বাবা মানে নির্ভরতার আকাশ।

‘বাবা’ দুই বর্ণের এ ছোট শব্দের অবদান অনস্বীকার্য-অতুলনীয়। বাবা শাশ্বত, চির আপন, চিরন্তন। বাবা মানে নির্ভরতার আকাশ আর অশেষ নিরাপত্তার চাদর। সন্তানের কাছে প্রত্যেক বাবাই প্রিয়। কারও কাছে বটবৃক্ষের মতো আবার কারও কাছে বাবা আলাদিনের চেরাগ। বাবা থাকলে সন্তানের হাতের মুঠোয় থাকে দুনিয়ার সব সুখ। আবার যার বাবা নেই তার কাছে সমস্ত দুনিয়া অন্ধকার। 

যে বাবার শাসনের মুখোমুখি হয়ে সন্তানের চোখে ভয়ের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। আবার সে বাবার আদরে মুহূর্তেই আনন্দে অশ্রুর ঢেউ খেলে সন্তানের চোখে। সন্তানের জীবনকে বাস্তবতার মুখোমুখি এনে সকল প্রতিকূলতা ডিঙিয়েও খাটি যোদ্ধা হওয়ার শিক্ষাও দেন বাবারাই। 

বাবাকে নিয়ে সেলিব্রিটি-তারকাদের কথা-স্মৃতি তুলে ধরতে ব্যস্ত যেই সংবাদিকেরা তাদের অনুভুতি-যন্ত্রণা তুলে ধরা কেউ কি আছে? বাবা নিয়ে তাদেরও আছে আবেগ, আছে আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন। কেউ বাবা হারানোর শোক ভুলতে পারেন না আজও। আবার কেউ সদ্য নবজাতকের জন্মে পেয়েছেন বাবা হওয়ার স্বাদ। 

আজ রবিবার, বিশ্ব বাবা দিবস। আর দশজনের মতো বাবা দিবসে এই গণমাধ্যম কর্মীরা সিভয়েসের কাছে নিজের বাবার স্মৃতিচারণ করেছেন, জানিছেন বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

বাবার স্নেহ, মমতা ও ভালবাসার স্মৃতির কথা জানাতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়েছেন একুশে পত্রিকার সম্পাদক আজাদ তালুকদার। ১৪ বছর আগে বাবাকে (খায়ের আহাম্মদ তালুকদার) হারিয়েছেন। কিন্তু বাবার কাছে পাওয়া সত্য-সততার পথে নিজেকে অবিচল রেখে প্রতিটা মুহূর্তে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করছেন বলে জানান এই সাংবাদিক।

বাবা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, এমন বাবার সন্তান অনেকেই হতে পারেন না। তাঁর সন্তান হিসেবে জন্ম নিয়ে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। তাঁর ইস্পাত-কঠিন আদর্শিক রক্তের উত্তরাধিকার হয়েছি এর চেয়ে বড় পাওয়া আমার কাছে আর কিছু নেই। আমার কাছে বাবাহীন ১৪ বছর শুধু একটি কাল বা সময় নয়, নিরন্তর শোকের বহর, মন খারাপের বিশাল লরি। অনুক্ষণ সেই লরি টেনে নিয়ে যাচ্ছি বাবার দেখানো সৎ, সত্যনিষ্ঠ পথে, অসৎ-অসত্যের বার্লিন প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে। কারণ শুধু একটাই, বাবার আত্মা যেন শান্তি পায়, খুশি হয়। 

আমার সাথে আজ বাবা নেই কিন্তু বাবার ছায়া আছে, আছে তার দেখানো পথ। সেই পথের পথিক হয়ে আমি চলছি ইস্পাত-কঠিন সততা বুকে ধারণ করে। বাবা শিখিয়েছিলেন বিত্তবান মানুষ হওয়ার দরকার নেই, চিত্তবান মানুষ হও। আজ পর্যন্ত সেই চেষ্টায় রণেভঙ্গ দিইনি। বাবার থেকে শেখা সততাকে কেবল চর্চা নয়, ইবাদত করে নিয়েছি। শুধু তার সন্তান বলেই যে এমনটা করছি তা নয় তার আত্মা যাতে শান্তি পায় তাই আমার এই প্রচেষ্টা।

দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকার সহ-সম্পাদক রশীদ মামুন আলাদা করে বাবা দিবস পালন করার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে মনে করেন না। তার কাছে সন্তানের অস্তিত্বের সাথে বাবার সম্পর্ক। আলাদা করে বাবা দিবসে নয়, প্রতিটা দিনই বাবাকে মিস করেন তিনি। 

তিনি বলেন, বাবা তো বাবাই। সন্তানের আপাদমস্তক জুড়ে বাবার অস্তিত্ব বিরাজ করে। বাবা ছাড়া সন্তানের ভবিষ্যৎ বড়ই খুবই ঠুনকো। অনুভূতির জন্ম হয় বাবাকে ঘিরে। আমার আছে অনুভুতি বলতেই বাবা। আমাদের চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ সবকিছু গড়ে উঠে বাবাকে অনুকরণ করে। 

আমার বাবা সবসময়ই খেয়াল রেখেছেন আমার বেড়ে উঠায় যাতে কোনও সমস্যা না হয়। অনেক বাবা-মা আগে থেকেই ঠিক করে রাখে সন্তান বড় হয়ে কি হবে। কিন্তু বড় হয়ে কি হবো সেটা বাবা কখনও আমার উপর চাপিয়ে দেননি। তিনি সবসময়ই আমাকে এটা বলেছেন, ‘মানুষের মত মানুষ হও। নামে নয় সত্যিকারের মানুষ হও।’

প্রত্যেক বাবাই সন্তানের ভালোর জন্য শাসন করে থাকেন। বাবার শাসনকে অনেক সময় সন্তানরা ভিন্ন চোখেও দেখে। কিন্তু তারা বুঝে না এই শাসনের মধ্যেও যে কত ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। বাবা না থাকার পর সন্তানের কাছে শাসনের এই স্মৃতিগুলোই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। বাবা আমাকে যেই শিক্ষা দিয়েছেন চেষ্টা করি নিজের সন্তানদেরও যাতে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারি, ভালো মানুষ করে তুলতে পারি। যদিও আমি শুধু বাবা দিবসের দিন বাবাকে আলাদা করে স্মরণ করার পক্ষে নই, তবে আজ এতটুকুই চাওয়া— ভালো থাকুক সকল বাবারা।

বাবা শব্দ শুনতেই বুকের ভিতর জমাট কান্নার ঢেউ উঠে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন দৈনিক পূর্বকোণের সিনিয়র রিপোর্টার ও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইএউজে) সভাপতি মোহাম্মদ আলী। বাবার নির্মোহ আদরের নিখুঁত সুরের স্মৃতিগুলোই তার কাছে শেষ সম্বল। তাই তো নিজের ছেলের মাঝে বাবাকে বারংবার খুঁজেন এই সংবাদকর্মী। 

বেদনা সিক্ত কণ্ঠে বাবার স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে তিনি বলেন, ‘আমার বয়স যখন সাড়ে ৪ বছর তখন এক্সিডেন্টে বাবা মারা যান। তখন আমি ছোট, বোধশক্তি হয়নি। আমার বাবা আমাকে কোলে-কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো এসব কিছু কিছু মনে আছে। তাও খুবই ঝাপসা। তবে বুদ্ধি হবার পর থেকে বাবাকে অনেক মিস করি। তাকে ছাড়াই বড় হয়েছি। দেখতাম বাবারা সন্তানকে আদর করে স্কুলে বা বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। তখন খুব কষ্ট হতো। হু-হু করে কান্না আসতো।’

‘বাবা দিবসে আজ অনেককেই ফেসবুকে ছবি দিয়ে অনেক কিছু লিখতে দেখছি, কিন্তু আমার কাছে আমার বাবার কোন ছবি নেই। পুরোনো স্মৃতিতে বাবার মুখখানা মনে করার চেষ্টা করি আর নিজের মধ্যেই চাপা কষ্টটা লুকিয়ে রাখি। বাবা কত বড় সম্পদ আমি বুঝি, তাই আমার সন্তানদের সবসময় ভাল রাখার চেষ্টা করি। এমনকি আমার ছেলেকে আমি আদর করে বাবা বলেই ডাকি। কারণ আমি যখন থাকবো না আমার সন্তান যেন বাবার সুন্দর স্মৃতিগুলো পাশে পায়।’

‘বাবা কি জিনিস শুধু বাবারাই জানে। এসব আসলে বলে প্রকাশ করা যায় না। কোন বয়স্ক লোক দেখলে আমি তাদের শ্রদ্ধা করি। তাদেরকে কাজে সাহায্য করি। হাত ধরে রাস্তা পার করে দেই। ভাবি যে উনারাও কারও না কারো বাবা। আজকের এই বাবা দিবসে সকল বাবাদের জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।’

দিপ্ত টিভির চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান ও চট্টগ্রাম টিভি ক্যামেরা জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লতিফা আনসারী রুনা ছোট বেলা থেকেই বড় হয়েছেন বাবা ছাড়া। প্রতিদিনই বাবার শূন্যতা অনুভব করেন রুনা। বাবা দিবসে নিজের বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেন, বাবা যখন মারা যায় তখন আমি খুবই ছোট ছিলাম। বাবাকে হারিয়েছি ৩২ বছর হয়ে গেছে।

‘এই যে বাবারা মেয়েদের নিয়ে বাহিরে যায়, সবকিছুতে খেয়াল রাখে এই জিনিসগুলো বাবা না থাকার পর আমি কখনও পাইনি। এটা নিয়েই আমার আফসোস হয়। বাবা থাকলে হয়তো আমি আরও বেশি সাপোর্ট পেতাম, বেশি মূল্যায়ন পেতাম। তবে বাবা আমার অনেক গর্বের জায়গা। ৭ম শ্রেণির একটা বইয়ে বাবার নাম আছে। বাংলাদেশের অনেক ব্রিজ-কালভার্ট বাবার করা। শুভপুর ব্রিজটাও বাবার করা। তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের ৪ জন নাম করা প্রথম শ্রেণির ঠিকাদারের মধ্যে বাবা ছিলেন অন্যতম।’

‘বাবা দিবসে সবাই নিজের বাবার সাথে ছবি দিচ্ছে। কিন্তু বাবার সাথে কোনো ছবি তো দূরের কথা বাবার কোনো ছবিও আমার কাছে নেই। বাবাকে নিয়ে যে একটা ছবি দিবো সেটাও পারছি না, তাই আমার ছেলেকে নিয়ে ছবি আপলোড দিয়ে তৃপ্তিটা মিটাই। মনে করি সেই আমার বাবা। নিজের ছেলের মধ্যে বাবার প্রতিচ্ছবি খুঁজি।’

‘যাদের বাবা আছে তারা বাবাকে অনেক ভালবাসুক, কাছে রাখুক। কথাটা এ কারণেই বলছি, সন্তানরা বাবাদের অনেক অবহেলা করে। সন্তানদের মায়ের প্রতি বেশি টান থাকে আমি চাই বাবার প্রতিও সমান টান থাকুক। বাবার প্রতি সবার ভালোবাসাটা বেশি বেশি দেখানো দরকার। মায়ের জন্য ছেলে যেমন একটা শাড়ি কিনে আনে বাবার জন্য একটা চাদর কিনে আনবে। মাকে যেমন জড়িয়ে ধরবে বাবাকেও সেইভাবে জড়িয়ে ধরবে।’

মুক্তিযোদ্ধা পিতার সন্তান দৈনিক আজাদীর স্টাফ রিপোর্টার মোর্শেদ তালুকদারের কাছে বাবা শব্দটা ভালোবাসার পাশাপাশি গর্বের। সদ্য বাবা হওয়া এই সাংবাদিক সমাজ-দেশের জন্য এমন কিছু করতে চান যাতে তাকে নিয়ে তার সন্তান গর্ববোধ করতে পারে।

তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবাকে আমি খুব ভয় পেতাম। আজকাল সন্তানের সাথে বাবাদের যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, আমাদের সময় এমনটা ছিল না। তাই ছোটবেলায় বাবার সাথে কখনো একসাথে বসে গল্প করার সুযোগ হয়নি। তবে যেকোনও প্রয়োজনে সবসময়ই বাবাকে পাশে পেয়েছি। আর বাবার সাথে তেমন কোনো ছবি আমার নেই। খুঁজলে হয়তো দু’একটা ছবি পাওয়া যাবে যেখানে আমি আর বাবা একসাথে আছি।’

‘আমার বাবা (মো. জাকারিয়া তালুকদার) মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বাবা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় অন্যদের চেয়ে আমি সন্তান হিসেবে অনেক বেশি গর্ববোধ করি। ২০১৩ সালে বাবা মারা গেছেন। এরপর থেকে প্রতিটি মুহূর্তে বাবাকে খুবই মিস করি। আর আজ বাবা দিবসে সন্তানদের সাথে বাবার বিভিন্ন ছবি বা স্যাটাস সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখে আরও বেশি মনে পড়ছে বাবার কথা। খুব কষ্ট হচ্ছে।’

‘তবে আমার ছেলে সন্তান (ইয়ারা মেহেদিস এলিজা) পৃথিবীতে আসার পর আমি বুঝতে পারছি বাবা হওয়ার মর্ম কতটুকু। আড়াই মাস বয়সের মেয়েটা আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। আজ আমার বাবার পাশাপাশি সন্তানকেও খুব মিস করছি। সে অনেক ছোট আর বাসায় দেখাশোনা করার মতো কেউ না থাকায় তার নানু বাড়িতে আছে। বাবা দিবসে আমার পাশে নেই। এটা আমার জন্য অনেক কষ্টের। আমি সমাজ-দেশের জন্য এমন কিছু করতে চাই যাতে বাবা নিয়ে আমি যেভাবে গর্ববোধ করি সেভাবে আমার সন্তানও আমাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে।’

অন্যদিকে, সদ্য কন্যা সন্তানের বাবা হওয়ায় ‘বাবা’ দিবসটা সবচেয়ে আলাদা ‘দ্যা ডেইলি সান পত্রিকা’র স্টাফ রিপোর্টার ইয়াসির সিলমীর কাছে। বাবা হওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে এই সাংবাদিক বলেন, ‘জীবনে অনেক প্রেম এসেছে। আমি অনেক বার প্রেমে পড়েছি। তবে সন্তানের মুখ দেখার পর জীবনে আমি সেই প্রেমে পড়েছি যেটাতে কোনো ভেজাল নেই। যেই ভালোবাসাটা মনের গভীর থেকে উপলব্ধি করতে পারি। সন্তানের মাধ্যমেই আমি জীবনের শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা পেয়ে গেছি। আমার ছেলের (হামদান মামদুহ) জন্মের এই ৩ মাস আমার জীবনের সেরা সময় পার করেছি।’

‘কাউকে দেখে মুগ্ধ হওয়ার ব্যাপারগুলো কবিতা বা ফিচারে আমরা দেখি। মন থেকে না এলেও সেগুলো হয়তো লেখার জন্য লিখে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে যদি বলি, সন্তানের মুখ হচ্ছে সেই মুখ। যেই মুখের দিকে তাকানো মাত্র সমস্ত ক্লান্তি উধাও হয়ে যায়। বার বার তাকিয়ে থাকতে মন চায়। আমার জীবনের সেরা মোমেন্ট হলো যেদিন আমি বাবা হয়েছি। সন্তানের মুখে হাসি দেখার জন্য যা যা করতে হয় আমি সব করবো।’

-সিভয়েস/জেআইএস

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়