Cvoice24.com

`ভূতিনিয়াম` সাহিত্য সমালোচনা  

শাহাদত হুসেন রাসেল, এডিসি, সিএমপি 

প্রকাশিত: ২২:২৯, ১৭ মার্চ ২০২২
`ভূতিনিয়াম` সাহিত্য সমালোচনা  

নিতান্তই প্রচ্ছদের প্রেমে পড়ে বইয়ের মলাট উল্টাতে গিয়ে ভূতিনিয়াম গল্পটা পড়া হল। অংকন আমার মেধার আওতাধীন নয় বিধায় সবসময় পাশ কাটিয়ে গিয়েছি। ভান ভণিতা ছাড়াই বলি, এই বইয়ের অংকন দেখে মনে হয়েছে ইহা জ্ঞানেন্দ্রিয় আর অন্তরিন্দ্রিয়ের মিলনস্থল (Meeting point of all senses). অংকন দেখে আমার আনন্দ হয়েছে তবে তা জন রাসকিন এর নন্দনতত্ত্বের বহুল আলোচিত কৌতূহলশূন্য আনন্দ (Disinterested pleasure of the non-intellectual part of mind).  

গল্প পড়ে বেমালুম শৈশবে ফিরে গিয়েছিলাম। একদম ব্লেকিয়েন ইনোসেন্স বা অপতিত পৃথিবীর (Uninformed Innocence) শৈশবে। বইয়ের মলাটের গন্ধ, প্রচ্ছদ, গল্পের বিজ্ঞানময়তা আমাকে ভীষণ ভাবিয়েছে। 

উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় যে গলদ তা হল একাডেমিক মডিউলগুলো বেদ-ভিত্তিক অর্থাৎ অতীন্দ্রিয় ও আধ্যাত্মিক। ফেনোমেনন এর অভাব। বাহ্যবস্তু নিরপেক্ষতার কারনে বাস্তবতার পরিমন্ডলে বিদ্যমান সাইন ও সিম্বলস মূল্যায়ন করতে সহায়তা করেনা। 

ভূতিনিয়াম এর লেখকের সাথে প্রকাশনা সংক্রান্তে কোন আলাপ আমার হয়নি বিধায় সমালোচনা হয়ত সহানুভূতিশীল কিংবা নিমিত্ত না হতে পারে। টেক্সটের কনস্ট্রাকশন বা উপরিকাঠামো এমন এক ধরনের এলগরিদম উপস্থাপন করেছে যা শিশুদের পড়ার বিষয়কে পৃথিবীতে নামিয়ে আনতে উৎসাহিত করবে। এই  মেটেরিয়াল অ্যাপরিসিয়েশন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ইলেকট্রন বিন্যাসের উপর ভিত্তি করে মৌলসমূহের আনুভূমিক ও লম্বিক পর্যায় ও স্তম্ভ দিয়ে যে পর্যায় সারণী তৈরি তার তের ও চৌদ্ধ নম্বরের অ্যালুমিনিয়াম কিংবা ফসফরাসের আচার-আচরণের সাথে আমার প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় থাকলেও ভূতিনিয়াম আমার কাছে একদম নতুন মৌল, হয়ত পর্যায় সারণীতে এর জায়গা হবেনা। ভূতিনিয়ামকে আচরনে কখনও আমার অ্যালুমিনিয়াম নাইট্টেট কখনও নাইট্রাইট মনে হয়েছে।  অধ্যাপকের ল্যাবরেটরিতে লবণ শনাক্তকরণ পদ্ধতি বেশ মজাদার। লবণের এহেন অরাসায়নিক আচরনও বেশ রসের উদ্রেক করে। 

শিশু সাহিত্য কি শিক্ষা নিরপেক্ষ হবে না রস নিরপেক্ষ হবে? নাকি হবে মিউচুয়েলি এক্সক্লুসিভ কিংবা ইনক্লুসিব? এর একটা সুরাহা লেখক করেছেন এই বইয়ে। 

লেখক কি শিশু নাকি শৈশব আরোপিত মুহূর্তের তাড়নায় লিখেছেন তা আমার জানা নাই। তবে আমি জানি, সব জিনিয়াস ভেতরের দিক থেকে শিশু। লিখতে হলে শৈশবে যেতে হয়, কারন শৈশবের জিজ্ঞাসা আছে, বিস্ময় আছে, একটা নিদাগ মানস ফলক আছে। 
শিশুর একটা দার্শনিক মনস্তত্ত্ব আছে। এটা বৈশ্বিক, সংস্কার কিংবা সমাজ নিরপেক্ষ। এই দার্শনিকতায় ভূতিনিয়াম এক রহস্যময় আলোক সম্পাতের মাধ্যমে অভিঘাত প্রতিষ্ঠা করেছেন। এটা জরুরি নানাবিধ কারন ও মাত্রায়। সিগনিফাইড ও  সিগনিফায়ার  মূল্যায়ন করতে পারা একটি শিশুর যথাযথ  শিক্ষা ( Informed learning) প্রক্রিয়ার অংশ। মনস্তাত্ত্বিক, জীবতত্ত্বমূলক ও জাগতিক প্রকৃতির যে ধারনা জ্যাঁ জ্যাকস রুশো তাঁর 'এমিল' গ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন, সেখানে একটি শিশু, সন্নিহিত সমাজ, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও প্রকৃতির  মধ্যকার একটি চলমান ডিসকোর্স এর কথা বেশ গুরুত্বের সাথে  তুলে ধরা হয়েছে। 

রুশোর মতে, "Nature wills that Children should be children before they are men". শিশুর মানসিক পুষ্টি ও উপচিতি প্রকৃতি থেকেই আসবে। প্রকৃতি সহজ, সাবলীল ও সংহত। সুতরাং, প্রকৃতিকে শিশুর কাছে সাহিত্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করার যে ঢং লেখক দেখিয়েছেন তা আমাকে বিমোহিত করেছে।

সমালোচনামূলক বয়ানের বিপদ ও বিপত্তির জায়গা হল লেখক যে বোধি, বিদ্যা, আর বুদ্ধির মিশেলে সৃষ্টিকর্মের জন্ম দিলেন, তা বিশ্লেষণে সমানুপাতিক মনন না থাকা। আমরা সবাই হয়ত শুনেছি পার্সি বিশি শেলি ক্রিটিকদের সমালোচনায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন, নয়ত এত অল্প বয়সে কেন।  

যাই হোক, সমালোচনা সাহিত্যে লেখক ও ক্রিটিক স্বাধীন। সুতরাং, নিরর্থক কিংবা সমার্থক বা অনুগামী সমালোচনার মুখোমুখি হওয়ার ভয় ভূতিনিয়ামের লেখকের আছে বলে বই পড়ে আমার মনে হয়নি। অত্যন্ত সাবলীলভাবে ক্লিনিক্যাল সেটিং থেকে কিভাবে শিশুদেরকে সাহিত্য পাঠে উৎসাহিত করা যায় তার একটা নজীর হল ভূতিনিয়াম। 

সাহিত্যে এ মৌল আছে, জৈব কিংবা অজৈব যৌগের রসায়নে নাই। লেখকের নতুন কোন বইয়ে নতুন কোন মৌল উদ্ভাবিত হয়ে নতুনভাবে শিশুদের আনন্দ দিবে এই প্রত্যাশা করি। আনন্দই সবচেয়ে জরুরি মৌল। আনন্দই জীবনের নিউক্লিয়াস।  

বলে রাখি, সমালোচনা আমার বিদ্যার বলয় ও পরিধির বাইরে। তারপরও শিল্পের অভ্যন্তরীন শৃঙ্খলা (Integrity) বিশ্লেষণের আবেগে আপ্লূত হয়ে করলাম। শ্রী অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় আমাকে সাহস যুগিয়েছেন। তাঁর মতে, "সৌন্দর্যানুভূতি আমাদের আপাত আকুল ও উদ্ভ্রান্ত করে তোলে, সমালোচনা সুন্দরের উপর বিচারের আলোকপাত করে তাকে বুদ্ধিগ্রাহ্য করে তোলে।" 

লেখক সিনিয়র সিভিল সার্ভেন্ট। বয়সের একটা সুবিধা আছে। মন, দেহ আর অধ্যাত্ম একাকার হয়। সাহিত্য রচনার জন্য এটা জরুরি। সংবেদনা, তন্ময়ীভবনযোগ্যতা ও গল্পের চিৎস্বভাবসম্বিতের সাথে মিলেমিশে একাকার হওয়ার মেজাজ (Identify) ধারন করতে পারেন। আমাকে অবাক করেছে লেখক কিভাবে পেশাগত ব্যবহারিক সত্তাকে নিস্ক্রিয় করে সবাইকে ফিকশনে যুক্ত করলেন। ফিকশন ফ্যাক্ট এর চেয়ে শক্তিশালী।  লেখা শুদ্ধতম মানবিক কার্যাবলির একটি।  পাঠ ও সমানতালের।  সাহিত্য বিচারের মানদণ্ড কখনো স্থির বা ধ্রুব নয়। লেখকের সাহিত্য আরো সমালোচিত হোক নতুন মাত্রায়।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়