Cvoice24.com

ইউক্রেন সংকট: চীন-আমেরিকার শীতল যুদ্ধ

ফারুক আবদুল্লাহ

প্রকাশিত: ২১:৫৫, ২৩ মার্চ ২০২২
ইউক্রেন সংকট: চীন-আমেরিকার শীতল যুদ্ধ

করোনা মহামারীর কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা পুরোপুরি এখনো কাটেনি। ২০২০ সাল জুড়ে মন্দার প্রভাব কাটিয়ে ২০২১ সালে উত্তরণের কিছু লক্ষণ ছিল। কিন্তু নতুন বছরের দুই মাস না যেতেই বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুন করে সংকটে ফেলে দিয়েছে। সেই সংকটটি হলো— রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। প্রায় চার সপ্তাহ ধরে চলছে রক্তক্ষয়ী হামলা এবং পাল্টা হামলা। তবে যুদ্ধ বিরতির নামগন্ধ নেই। যুদ্ধ কখন থামবে? বিশ্ব জুড়েই এমন প্রশ্ন আমজনতার।

ইউক্রেনে হামলার ইস্যুতে রাশিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপানো নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞার কোপ দিয়েছে। রাশিয়ার উপর তা কতটা পড়বে তার অনেকটাই চীনের ওপর নির্ভর করছে। ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়া দখলের পর রাশিয়ার ওপর চাপানো নিষেধাজ্ঞার ধার কমে গিয়েছিল চীনের কারণেই। সে কারণেই এবার যুক্তরাষ্ট্র চীনকে সরসারি হুমকি দেওয়ার পথ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা ভেঙে রাশিয়াকে সাহায্য করার চেষ্টা করলে চীনকে অবশ্যই এর পরিণতি ভোগ করতে হবে। 

আমেরিকার হুমকিকে চীন কতটা গুরুত্ব দেবে? গত দুই দশক ধরে চীন এবং রাশিয়ার কৌশলগত সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেন সংকটে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয়। এসব নিয়ে চীনের কৌশল স্পষ্টই পরিলক্ষিত হচ্ছে। কারণ চীন এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে হামলার জন্য রাশিয়ার সমালোচনা করেনি। একাধিকবার বলেছে নিরাপত্তা নিয়ে রাশিয়ার 'উদ্বেগ বৈধ' এবং তাকে বিবেচনায় নেওয়া দরকার। নিরাপত্তা পরিষদে এবং পরে সাধারণ পরিষদে রাশিয়াকে নিন্দা করে নেয়া প্রস্তাবের পক্ষে তারা ভোট দেয়নি। আবার রাশিয়া অস্ত্র চেয়েছে বলে যে খবর আমেরিকাতে বেরিয়েছে তা বারবার অস্বীকার করেছে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা বলেছেন আমেরিকা ইচ্ছা করে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।

আর চীন ও রাশিয়ার মধ্যে যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে তা ধরে রাখতে চীন উদগ্রীব কারণ এর পেছনে রয়েছে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়। চীনের জ্বালানি, খাদ্যশস্য এবং অস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ জোগানদাতা রাশিয়া। এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো- বিশ্বে বিশেষ করে ইউরোপ এবং এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব খাটো করার অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে দুই দেশেরই। তাছাড়া যদি কখনো তাইওয়ান প্রশ্নে রাশিয়ার সমর্থন দরকার হয় সেটিও চীনের অন্যতম একটি বিবেচনা।

চীন ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউএনএসসিতে ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল, তার একটি কূটনৈতিক বিভ্রান্তি তৈরি করার অভ্যাস রয়েছে। অতীতে আফগানিস্তান ও মিয়ানমারের ক্ষেত্রে চীনের চরিত্রের এমন স্বতন্ত্রতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেখেছে। বিশেষ করে আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কাবুলে তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে চীন প্রধান ভূমিকা পালন করবে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন প্রত্যাহারের পর বেইজিংয়ের নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপ একটি ধারণা দিয়েছে যে বিদ্রোহ-বিধ্বস্ত দেশটিতে আমেরিকার রেখে যাওয়া শূন্যতা চীন পূরণ করবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর প্রায় আট মাস অতিবাহিত হয়েছে, চীন এখনও আফগান জনগণের জন্য অর্থপূর্ণ সাহায্যে ল্যান্ডলকড দেশটিতে পা রাখতে পারেনি। চীন প্রথম বিদেশি দেশ যারা আফগানিস্তানে ২০০ মিলিয়ন ইউয়ান মূল্যের জরুরি মানবিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইউক্রেন সংকটের ক্ষেত্রে চীন ঠিক এটাই করছে। 

অন্যদিকে বিশ্বকে দেখানোর জন্য এটি বারবার বলছে, ‘আমরা সর্বদা সমস্ত দেশের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং উদ্দেশ্য ও নীতির ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে। বিপরীতপক্ষে, এটি ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়ার চীনের সমালোচনা হিসাবে দেখা হয়। এটি বেইজিংয়ের ভারসাম্যমূলক কাজ হিসাবেও দেখা হয়। বাজার এবং ডলার-কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার স্বার্থে, এটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার সম্পর্ককে বিপদে ফেলতে চায় না।

মোট কথা হচ্ছে চীন স্পষ্টতই একটি ভারসাম্য রেখে চলার চেষ্টা করছেন। সরাসরি রাশিয়ার সমালোচনা করছেন না, কিন্তু মানবিক দুরাবস্থা লাঘবে ইউক্রেনে সাহায্য পাঠিয়েছেন। নিষেধাজ্ঞার নিন্দা করেছেন। কারণ মস্কোর সাথে কোনো ব্যবসায়িক চুক্তি অব্যাহত থাকলে মার্কিন কোষাগারে পড়ে থাকা বেইজিংয়ের ৩.২ ট্রিলিয়ন রিজার্ভ প্রায় জমে যাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। 
বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সালে চীনা অর্থনীতি ৫.১ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে। ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠান আরও সতর্ক করেছে যে উচ্চ ঋণ, ক্রমাগত সরবরাহ শৃঙ্খলে বাধা এবং করোনাভাইরাস-সম্পর্কিত বিধিনিষেধ চীনের অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে বিপন্ন করবে। একইভাবে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ২০২২ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির জন্য ৪.৮ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে ৫.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির অনুমান করেছে। আইএমএফ তার সর্বশেষ প্রতিবেদনে ভোক্তা ব্যয় এবং সম্পত্তির বাজারের মন্দার উপর কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের প্রভাব উল্লেখ করেছে চীনা অর্থনীতির মন্থর বৃদ্ধির কারণ হিসেবে। এই পটভূমিতে, চীন যদি স্পষ্টতই রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা অব্যাহত রাখতে চায় যা বহু সংখ্যক নিষেধাজ্ঞার সাথে চাপা পড়ে যাবে।

লেখক: সাংবাদিক

সিভয়েস/এএ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়