অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা
চাটগাঁর সেই ছেলেকে ঘিরে স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
লিখেছেন : মুহাম্মদ মুসা খান, কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক
১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামের সন্তান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরেই দারিদ্র্য বিমোচনের পথে হাঁটে বাংলাদেশ। হাটহাজারীর জোবরা গ্রাম থেকে তাঁর শুরু করা দারিদ্র্য বিমোচনের বার্তা ছড়িয়ে যায় বিশ্বব্যাপী। পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার নোবেলসহ একাধিক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। এবার চাটগাঁর সেই ছেলেকে ঘিরেই স্বপ্ন বুনছে পুরো বাংলাদেশ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবানুসারে নোবেলবিজয়ী ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের গৌরব প্রফেসর ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান নির্বাচিত হওয়ায় আমরা চট্টগ্রামবাসী সত্যিই আনন্দিত, গর্বিত।
দেশের সর্বোচ্চ ওই পদে চট্টগ্রাম থেকে তিনিই প্রথম। তাই তো চট্টগ্রামের সন্তান হিসেবে প্রফেসর ইউনূসের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা একটু বেশি।
নামে বাণিজ্যিক রাজধানী হলেও চট্টগ্রাম বরাবরই অবহেলিত। চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতিতে সিংহভাগ টাকার যোগান দিলেও চট্টগ্রামের সমস্যাসমূহ সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এখনো সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা হয়, চট্টগ্রাম শহর তলিয়ে যায়। নতুন কালুরঘাট সেতু নির্মাণেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলেও স্থায়ী ক্যাম্পাস তৈরি করা হয়নি।
কয়েকটি বাস-ট্রাক টার্মিনালের অভাবে চট্টগ্রামের সর্বত্র ট্রাফিক অরাজকতা দেখা যায়। নগরজুড়ে যানজট নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা আশা করবো ড. ইউনূস তাঁর উপদেষ্টাদের মাধ্যমে চট্টগ্রামের সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের ব্যবস্থা করবেন। চট্টগ্রামকে একটি আধুনিক সুন্দর শহরে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
ক্ষণজন্মা ও কিংবদন্তিতুল্য এই ব্যক্তিত্বের হাতে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব তুলে দিয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ সমন্বয়ক ও বুদ্ধিজীবীরা অত্যন্ত দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন বলে আমি মনে করি।
বলতে দ্বিধা নেই যে, এতদিন আমরা ‘অদূরদর্শী’ নেতৃত্বের কবলে পড়েছিলাম। এবারই সত্যিকারের একজন উচ্চশিক্ষিত-প্রজ্ঞাবান মানুষের শাসন পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সঙ্গত কারণেই আমরা সবাই আনন্দিত।
নতুন সরকারের সবার প্রতি অনুরোধ থাকবে যেন, বিগত সরকারের যাবতীয় অন্যায় অবিচার চিহ্নিত করে সেসব দূর করে দেশে সত্যিকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই।
আমরা আশা করবো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশে নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করে যাবেন। ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেবেন। ভোট ডাকাতিকে ‘ফৌজদারি অপরাধ’ গণ্য করার জন্য আইন প্রণয়ন করবেন । দেশের মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবেন। সরকারি অফিস-আদালত হতে দুর্নীতি দূর করবেন। সাধারণ মানুষকে যেন কোনো সরকারি অফিসে ঘুষ দিতে না হয়। সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সত্যিকার অর্থে জনগণের সেবক হতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দলীয় দখলদারিত্ব হতে মুক্ত করতে হবে। শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। সরকারি চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আগের সরকার আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম ধ্বংস করে ফেলেছে। পূর্ববর্তী শিক্ষা কারিকুলামের সাথে আধুনিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণে নতুন করে শিক্ষাকারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে।
আমাদেরকে মহান ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে’ একটি ‘অসাম্প্রদায়িক-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ তৈরির জন্য একযোগে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশে কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। মানুষ নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, ধর্মকে রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার নামে উন্মাদনা সৃষ্টি করা যাবে না। আমরা লক্ষ্য করেছি, রাজনীতি ও ধর্মের নামে প্রতিটি দেশেই হিংস্র হানাহানি হয়। যা আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ও ভারতে লক্ষ্য করা গেছে।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের দিন আমাদের এখানেও প্রচুর লুটপাট হয়েছে। যা অবশ্যই নিন্দনীয়। আমরা এসব লুটপাট সংখ্যালঘুর ওপর হামলার তদন্ত ও বিচার দাবি করছি। সরকার ছাত্র আন্দোলন দমনের জন্য যাদের হত্যা ও আহত করেছে, তাদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং সেসব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে বিচার করতে হবে। আমরা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় হানাহানিমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন দেখি।
আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাত ধরে বাংলাদেশ একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী ও মর্যাদাবান দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে এবং সমগ্র পৃথিবীতে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে আমাদের দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস।
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সমগ্র পৃথিবীর মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০২০ সালে যখন করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল, সমগ্র পৃথিবী লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল, টিকার জন্য হাহাকার পড়ে গিয়েছিল, তখন তিনি অন্যান্য নোবেল বিজয়ীদের সাথে নিয়ে ‘করোনা ভাইরাসের টিকা বরাদ্ধ ও বণ্টনে সমতা সৃষ্টির’ ব্যাপারে (ধনী-গরিব সব দেশই যেনো টিকা পায়) উন্নত বিশ্বকে উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন।
তিনি বিশ্বব্যাপী আন্দোলন সৃষ্টি করে জাতিসংঘ ও সব দেশের রাষ্ট্র-সরকার প্রধানদের প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তাঁর এই আন্দোলনের কারণেই টিকা ব্যবস্থাপনায় ধনী দেশগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হয় এবং এশিয়া- আফ্রিকার অনেক গরিব দেশের টিকা প্রাপ্তি কিছুটা সহজ হয়।
প্রফেসর ইউনূসই পৃথিবীতে সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি যিনি ক্রমাগতভাবে মানবতার সুরক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি স্বপ্ন দেখেন দারিদ্র্যকে যাদুঘরে পাঠানোর। ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়ার সময় নোবেল কমিটি বলেছিলেন, ‘দারিদ্র্যতা শান্তির জন্য অন্তরায়।
প্রফেসর ইউনুস দারিদ্র্য বিমোচনের কাজ করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বব্যাপী অবদান রেখেছেন।’ ২০২১ সালে ‘পৃথিবীর সর্বত্র, সবার জন্য একটি শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই সমাজ’ গঠনে জাতিসংঘের লক্ষ্যসমূহ ত্বরান্বিত করতে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘জাতিসংঘ ফাউন্ডেশনের' ‘চ্যাম্পিয়ন অব গ্লোবাল চেঞ্জ’ পুরস্কার দেয়া হয়েছিল।
পুরস্কার দেয়ার প্রাক্কালে ‘জাতিসংঘ ফাউন্ডেশন’ জানিয়েছিল, ‘মানুষের মর্যাদা, সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তাঁর অসামান্য নেতৃত্ব ও উদ্ভাবনের স্বীকৃতি স্বরূপ নোবেল লরিয়েট ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে এ পুরস্কার দেয়া হলো।’ এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও বিল ক্লিনটন, জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান ও বান কি মুন, আর্চবিশপ ডেসমন্ড টু টু এবং শুভেচ্ছাদূত অ্যাঞ্জেলিনা জোলি এই পুরস্কার পেয়েছেন।
সমগ্র বিশ্বের সম্মানিত ব্যক্তিত্ব প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনুস কয়েকশ পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। যা বর্তমান পৃথিবীতে একটি অনন্য সাধারণ ঘটনা। তাঁর পাওয়া পুরস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো (আন্তর্জাতিক)- ১৯৮৪ সালে ফিলিপাইনের র্যামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড, বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার (১৯৯৪), সিডনি শান্তি পুরস্কার (১৯৯৮), প্রিন্স অব অস্ট্রিয়াস অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৮), নোবেল শান্তি পুরস্কার (২০০৬), সিওল শান্তি পুরস্কার (২০০৬), যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম (২০০৯) ও কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল (২০১০), ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার ইত্যাদি। ২৩ জুলাই ’২১ ক্রীড়া জগতের ‘সর্বোচ্চ পুরস্কার’ ‘অলিম্পিক লরেল’ পেয়েছিলেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।
এই পুরস্কার সম্পর্কে চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা শিনহুয়া জানায়, যেসব ব্যক্তি ক্রীড়ার মাধ্যমে শিক্ষা, সংস্কৃতি, উন্নয়ন ও শান্তিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, তাঁদেরই এই সম্মাননা দেয়া হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস হচ্ছেন এই পুরস্কারপ্রাপ্ত দ্বিতীয় ব্যক্তি।
বিশ্বের ইতিহাসে ‘সেরা সাত পুরস্কার’ প্রাপ্তদের মধ্যে প্রফেসর ইউনূস একজন। পৃথিবীর ২০জন সম্মানিত ব্যক্তির তালিকায় তিনি নবম স্থানে ছিলেন। ‘ফোর্বস ম্যাগাজিনের’ ‘টেন মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল বিজনেস গুরুস’ তালিকায় মুহাম্মদ ইউনূসও ছিলেন। ২০১৩ সনের ৫ জুন প্রফেসর ইউনূসের সম্মানের এক অভিনব নজির দেখেছিলেন বিশ্ববাসী।
সেদিন আমেরিকার প্রভাবশালী ‘ফোর্বস ম্যাগাজিন’ আয়োজিত বিশ্বের ‘সর্বোচ্চ সম্পদশালী ব্যাক্তিবর্গের সম্মেলনে’ বাংলাদেশের প্রফেসর ইউনূস ও বিশ্বের সব বিনিয়োগকারীর শিক্ষাগুরু- ‘ওয়ারেন বাফেটকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। জাতিসংঘ ভবনে আয়োজিত জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন-এর উপস্থিতিতে বিশ্বের ‘দুই শতাধিক’ সর্বোচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তিবর্গের এই সম্মেলনে দুজনকে ‘আজীবন সম্মাননা’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
এই সম্মেলনে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের সম্পদের পরিমাণ তিনশত বিলিয়ন ডলারের বেশি। অথচ তাঁদের তুলনায় ড. ইউনুসের সম্পদ বলতে তেমন কিছুই নাই। কিন্তু তিনি ঠিকই সম্পদশালীদের নিকট হতে সম্মান আদায় করে নিতে পেরেছেন, যা বিরল ঘটনা। ‘ওয়ারেন বাফেট’ ছাড়াও এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিল গেটস , বিল এ্যাকমেন, বোনো, রে চেম্বারস, 'রবিনহুডের' প্রতিষ্ঠাতা 'পল টিউডর জোন্স, পিটার জি পিটারসন, সোয়ার্স ম্যান', এবং 'জেফ স্কল' প্রমুখ।
সম্মেলনে ফোর্বস ম্যাগাজিনের চিফ এডিটর ও রিপাবলিকান নেতা 'স্টিভ ফোর্বস' বলেন, 'মুহাম্মদ ইউনূস দারিদ্র্য নিরসনে একজন অসাধারণ অনুঘটক,...একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব’। মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে 'স্টিভ ফোর্বস'-এর ঘোষণাকে টেনে এনে 'ওয়ারেন বাফেট' তাঁর বক্তব্যে রসিকতা করে বলেন , ‘আগামীকাল 'বার্কশিয়ার হ্যাথঅ্যাওয়ের শেয়ার' আকাশচুম্বী হবে, কেননা 'স্টিভ ফোর্বস'-আমার উত্তরসূরি (সিইও) হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূসের নাম ঘোষণা করেছেন।’
উপস্থিত সবাই এই রসিকতা উপভোগ করেন। ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনীদের সম্মেলনে’ তাঁকে নিয়ে এতো আলোচনা ছিল অকল্পনীয় সম্মানের বিষয়।
দূঃখজনক সত্য হলো, বিশ্বব্যাপী এত সম্মান, পুরস্কার ও গ্রহণযোগ্যতা থাকা সত্বেও প্রতিহিংসার কারণে তিনি অবহেলিত ছিলেন দেশে। বায়বীয় সব অভিযোগে সময়ে-অসময়ে, কারণে-অকারণে তাঁকে নিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে গেছে বিভিন্ন মহল। তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক কেড়ে নিয়ে ব্যাংকের ভবন হতে তাঁর ছবি পর্যন্ত নামিয়ে ফেলা হয়েছিল। অথচ এই ব্যাংকের সুউচ্চ ভবন তৈরি করিয়েছেন প্রফেসর ইউনূস। গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাস হতে প্রফেসর ইউনূসের নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টা করা হয়েছিল!
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, তাঁকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হলেও তিনি বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি প্রচুর পুরস্কার পেয়েছিলেন। পুরস্কারগুলো হলো- বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার (১৯৭৮), সেন্ট্রাল ব্যাংক অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৫), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮৭), রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এ খান মেমোরিয়াল গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৪) ও ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম মেমোরিয়াল গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৪), আরসিএমডি অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৫), আইডিইবি গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড (২০০০), কম্পিউটার সোসাইটি গোল্ড মেডেল(২০০৫)। সরকারের এতগুলো পুরস্কারে ভূষিত হয়েও তিনি রোষানল হতে রক্ষা পাননি।
স্মরণ করা যেতে পারে, প্রফেসর ইউনূসই আমেরিকায় অনুষ্ঠিত প্রথম ‘মাইক্রো ক্রেডিট সাম্মিটে’ ১৯৯৭ সনে তৎকালীর প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
আমরা লক্ষ্য করেছি, প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে কখনো সামান্যতমও কোনো নেতিবাচক কাজের অভিযোগ পাওয়া যায়নি (যেমন-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাষ্ট্রীয় তহবিল আত্মসাৎ, ভূমিদস্যুতা, কালো টাকা সাদা করা, অর্থ পাচার, অবৈধ সম্পদ অর্জন ইত্যাদির কোনো অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে কখনো ছিল না)। হ্যাঁ, মামলা-মোকাদ্দমা যা হয়েছে, সেসব রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে, যা ওপেন সিক্রেট।
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর সমালোচকদের সাথে ব্যক্তিগত ঝগড়ার পরিবর্তে ‘মানবাতাবাদি- সৃজনশীল’ কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। তিনি হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। তিনি সর্বশেষ বিশ্বব্যাপী ‘সোস্যাল বিজনেস থিওরি’ ও থ্রি জিরো তত্ত্ব (শূন্য কার্বন নির্গমন, সম্পদের শূন্য পুঞ্জিভূতকরণ এবং শূন্য বেকারত্ব) বাস্তবায়নের কাজ করছেন। আর, বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচনের কাজ করছেন।
বিশ্বের ৪২টি দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের আদলে ১৩২টি প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে। যা আমাদের জন্য গৌরবের। অথচ এই মানুষটা ভয়ংকর রকম প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। কথায় বলে, ‘কিছু সময়ের জন্য বোকা বানানো গেলেও, সব মানুষকে সবসময়ের জন্য বোকা বানানো যায় না। বাংলাদেশের মানুষকেও বোকা বানানো যায়নি। প্রচণ্ড রকম বিরোধিতা ও অপপ্রচার সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষ অবশেষে ড. ইউনূসের প্রতিভার মূল্যায়ন দেখতে পেয়েছেন।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ ইউনূস। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মুহাম্মদ ইউনূস মেধা তালিকায় ১৬তম স্থান অধিকার করেন এবং চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন।
১৯৫৭ সালে মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিএ এবং এমএ পাশ করেন। পড়াশোনা শেষে তিনি ব্যুরো অব ইকোনমিক্স-এ যোগ দেন গবেষণা সহকারী হিসেবে। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন।
১৯৬৫ সালে তিনি স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান। পরে ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন।
১৯৭২ সালে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন। এই সময়ের মধ্যেই ১৯৭৬ সালে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষুদ্রঋণের ধারণার মাধ্যমে সারাবিশ্বে একটি সাড়া ফেলে গ্রামীণ ব্যাংক।