বঙ্গবন্ধু ফিরে ফিরে এসেছেন বারবার
লিখেছেন : নাসিরুদ্দিন চৌধুরী; বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের চরম শোকাবহ একটি দিন। ৭৫ সালের এদিন আমরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হারিয়েছি। ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবনে বিপথগামী কিছু সেনা সদস্যের আকস্মিক সশস্ত্র হামলায় পরিবার স্বজন নিকটাত্মীয়সহ তিনি মর্মান্তিক শাহাদাত বরণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সহধর্মিনী বেগম ফজিলাতুন্নেছা নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামালও তাঁর স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকু, শেখ জামালও তাঁর স্ত্রী পারভীন কামাল রোজী, শিশুপুত্র রাসেল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, বঙ্গবন্ধু ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরানিয়াত তাঁর কন্যা বেবী, আরিফ সেরনিয়াবাত (আবদুর রব সেরনিয়াবাতের কনিষ্ঠ পুত্র), নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে জীবন সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত (আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ভাইয়ের ছেলে), বঙ্গবন্ধুর মেজো বোনের বড় ছেলে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্তা বেগম আরজু মনি, আবদুল নঈম খান রিন্টু (আওয়ামী লীগ নেতা আমীর হোসেন আমুর খালাতো ভাই) এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান ও কর্ণেল জামিল উদ্দিন আহমেদ (বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার) ও সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক শহীদ হন।
পৈশাচিকতায়, ভয়াবহতায় নির্মমতায় জাতির অস্তিত্বের ওপর এর আগে এবং পরে এত ন্যাক্কারজনক নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড আর সংঘটিত হয়নি। একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তানও তার আন্তর্জাতিক মুরুব্বী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, যে রাষ্ট্রটি তার মোড়লিপনা ও প্রভুত্ব বিস্তারের জন্য দেশে দেশে অন্তর্ঘাতমূলক তাৎপরতা উস্কে দিয়ে জাতীয়তাবাদী নেতাদের হত্যা করতে ওস্তাদ, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধে শিবিরের ঘাপটি মেরে থাকা মুশতাক, চাষী, তাহের ঠাকুর প্রভৃতি কুচক্রীদের সংঘটিত করে ৭৫-এ প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল।
হত্যা পরিকল্পনা নীল নকশা তৈরি করেছিল ভুট্টো আর অর্থ সাহায্য দিয়েছিল লিবিয়ার গাদ্দাফি ও সৌদি আরব। ইসলামের ধূয়া তুলে তাদেরকে ভুল বুঝানো হয়েছিল।
বাংলাদেশের জন্মকে যারা প্রাণপণে প্রতিরোধ করতে চেয়েছিল এবং তাদের প্রচণ্ড বিরোধিতা ও গণহত্যা সঙ্গেও তাদেরকে হতাশায় ডুবিয়ে পরাজয়ের কালিমা লেপন করে বাংলাদেশ যখন সত্যি সত্যিই আত্মপ্রকাশ করেছিলো, তখন তারা ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে তাঁকে নির্বংশ করতে চেয়েছিলো।
এদেশ ও এজাতির জন্য বঙ্গবন্ধুর এমন কিছু মৌলিক অবদান রয়েছে যা’ তাঁকে বাঙালি জাতির ইতিহাসে চির অমর করে রেখেছে এবং তাঁর সাথে জাতিকে অপরিশোধ্য ঋণে আবদ্ধ করে ফেলেছে।
প্রথমত : জাতিসত্তা নির্মাণ; বাঙালি বহু প্রাচীন জাতি হলেও এই জাতি ছিলো বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন, অসংগঠিত। জাতিসত্তার বোধও ছিলো না। বাংলাদেশ নামে কোনো অখÐ রাষ্ট্র কখনো ছিলো না। বঙ্গ, গৌড়, রাঢ়, পুন্ড্র, বরেন্দ্র, সমতট, হরিকেল ইত্যাদি নানা স্বাধীন বিচ্ছিন্ন জনপদে বিভক্ত ছিলো পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে বাংলা মুুলুক নামে পরিচিত ভূখণ্ডটি।
ইতিহাসে দেখা যায়, গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কালে ষষ্ঠ শতাব্দির প্রথম ভাগে একটি স্বাধীন বঙ্গরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। গোপীচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেব এই রাজ্যের রাজা ছিলেন। কিন্তু তারাও বাঙাল নন। দক্ষিণ এবং পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের কতকাংশ এই স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ষষ্ঠ শতাব্দির শেষভাগে উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের কতকাংশ নিয়ে গৌড়রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজা শশাঙ্ক ছিলেন এর প্রথম সার্বভৌম নৃপতি।
ত্রয়োদশ শতাব্দি থেকে ষোড়শ শতাব্দি পর্যন্ত দুশো বছরের (১২০৪-১৫৭৬) স্বাধীন সুলতানী আমল বাঙালির ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায়। কিন্তু সুলতানরা বাঙালি ছিলেন না এবং সেই বাংলা এই বাংলা নয়। এসব রাজতন্ত্রের কথা। বঙ্গবন্ধু জনগণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গোটা বাংলার ইতিহাসে এমনকি আরেকটি উদাহরণ পাই যখন রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর শতবর্ষব্যাপী অনৈক্য, আত্মকলহ ও বহিঃশত্রুর পুন: পুন: আক্রমণে বাংলার গণতন্ত্র ধ্বংস হয়েছিল। তখন দেশে কোন রাজা ছিলো না, প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, সম্ভ্রান্ত লোক, ব্রাহ্মণ এবং বণিক নিজ নিজ এলাকা স্বাধীনভাবে শাসন করতেন। সংস্কৃতে ওই অরাজক পরিস্থিতিকে বলা হয় মাৎস্যন্যায়।
এই চরম দুঃখদুর্দশা হতে মুক্তিলাভের জন্য বাঙালি জাতি যে রাজনৈতিক বিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছিল, ইতিহাসে তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। দেশের প্রবীণ নেতাগণ স্থির করলেন যে, পরস্পর বিবাদ-বিসংবাদ ভুলে একজনকে রাজপদে নির্বাচিত করবেন এবং সকলেই স্বেচ্ছায় তাঁর প্রভুত্ব স্বীকার করবেন। দেশের জনসাধারণও সানন্দে এই মত গ্রহণ করল। এর ফলে গোপাল নাম এক ব্যক্তি বাংলাদেশের রাজপদে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বাঙালির এই দেড়-দু’হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমাদেরকে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়, তা’হলো ১৯৭১ সালে যে স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি আগে কখনো তা সম্ভব ছিলো না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাঙালির স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন, বাঙালিকে প্রথম জাতি পরিচিতি প্রদান করলেন। বঙ্গবন্ধু নতুন করে ইতিহাস লিখলেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে একটা করে হিমালয়ের উচ্চতা এবং মহাকাব্যের বিশালতা ও গভীরতায় বাঙালির ইতিহাসে এটি একটি অনন্যসাধারণ ঘটনা। বঙ্গবন্ধু বাঙালির নতুন ইতিহাসের স্রষ্টা, মহানায়ক। বঙ্গবন্ধুই ১৯৬৬ সালে ৬ দফা কর্মসূচি দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিস্তার ঘটিয়ে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন।
বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে জাতি পরিচিতি দান করেছেন। আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক। আমরা বিদেশে যেতে পারি দেশের পাসপোর্ট নিয়ে এবং বিদেশে গর্বভরে পরিচয় দিতে পারি আমরা বাংলাদেশের নাগরিক।
দ্বিতীয়ত : বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে পর্যায়ক্রমিক রক্তাক্ত আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করে ৭১ এর ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ করেছিলেন, যার পরিণতিতে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে।
তৃতীয়ত : স্বাধীনতা লাভের তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার। তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের চুম্বক আকর্ষণে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ম্যাডাম গান্ধী তাঁর সৈন্য প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছিলেন। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকালী বিজয়ী সেনাবাহিনীকে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো কঠিন একটা কাজ। কারণ বিজয়ী বাহিনী সহজে বিজিত দেশ থেকে যেতে চায় না।
৭০ সালে নির্বাচনের এমএনএ ও এমপি এদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ৭০ গণপরিষদ গঠন করে ৭২ সালে বাংলাদেশকে একটি সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন। এবং সেই সংবিধানের ভিত্তিতে ১৯৭৩ সালে সদ্য স্বাধীন দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে গণতন্ত্রের পথে দেশের ঐতিহাসিক যাত্রা সূচনা করেছিল।
চতুর্থত : বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনগর্ঠন করে উন্নয়নের উপত্যকায় উন্নীত করেছিলেন।
পঞ্চমত : এদেশের রাজনীতিতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পূর্বে নবাব, জমিদার, জোতদার, খান বাহাদুর, খান সাহেব, রায় বাহাদুর এবং রায় সাহেবরাই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। গ্রাম পঞ্চায়েত, ইউনিয়ন বোর্ড থেকে আইন সভা, আইন বিচরণ ছিলো তাঁদের করায়ত্তে। সমস্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব তাঁদের করতলগত ছিল। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ জনগণ ছিল তাদের প্রজা। এই অবস্থা থেকে সাধারণ জনগণকে নেতৃতের¡ আসনে উন্নীত করা বঙ্গবন্ধুর জীবনের এক মহত্তম কীর্তি।
ষষ্ঠত : রাজনীতি ও দেশ পরিচালনায় সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রভাব গর্ব করে তাদের ওপর রাজনীতিবিদদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা বঙ্গবন্ধু’র আরেক অক্ষয় কীর্তি। গোটা পাকিস্তানি জমানায় আমলরাই দেশ চালাত, রাজনীতিবিদরা ছিলেন কখনো তাদের হাতের পুতুল; যারা পুতুল হতে চাননি, তারা কোণঠাসা হয়ে থাকতেন। একমাত্র বঙ্গবন্ধু এই অবস্থা মেনে নেতে অস্বীকার করেন এবং তার জীবনব্যাপী আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য চ‚র্ণ করে দেন। পাকিস্তানের ২৩ বছর শাসনামলের মধ্যে ১৩ বছরই সেনা শাসনের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে দেশটি। প্রথমে আইয়ুবের শাসনামল (১৯৫৮-১৯৬৯), তারপরে ইয়াহিয়ার আমল (১৯৬৯-১৯৭১), সেজন্য বিচারপতি মালিক রূস্তম কায়ানী ঠাট্টা করে মন্তব্য করেছিলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোন দেশ জয় করতে না পারলেও নিজের দেশকে ও জনগণকে দু’বার জয় করেছে।
বঙ্গবন্ধুর দুর্ভাগ্য তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনী (হোক ক্ষুদ্র অংশ) তার স্থপতি বাংলাদেশে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বাংলাদেশকে জয় করেছে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে (চেতনা ও দর্শনে) হত্যা করেছে। এ কারণে ১৫ আগস্ট একটি কলঙ্কিত দিন, জাতির জন্য একটি গ্লানিময় দিন।
তবে বাঙালি জাতির প্রশংসা করতে হয়। সেই গ্রহণের কাল অতিক্রম করে, সেই অমাবস্যা ভেদ করে আবার সূর্যোদয় হয়েছে। যা কিছুই ঘটুক না কেন, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু কখনো অপাংক্তেয় বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে পারেন না।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এমন অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ যে, একটিকে অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা বিফল হতে বাধ্য। পঁচাত্তরের পরে বঙ্গবন্ধু নাম ভোলার বা ভোলাবার অনেক চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তিনি বারবার ফিরে ফিরে এসেছেন। কারণ জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব যে অনেক বেশি শক্তিশালী। মুজিব এক অজড়, অক্ষয় অবিনাশী চেতনার নাম। বাংলার আকাশ-বাতাস, মৃত্তিকা, নদ-নদী, বৃক্ষমালায় মিশে আছেন বঙ্গবন্ধু।