‘আঁই তোঁয়ারারে ডরাই; অ-বদ্দা, আঁই তোঁয়ারারে ডরাই’
লিখেছেন : রিয়াজ হায়দার চৌধুরী
প্রায় ২৫ বছর আগে ড. অনুপম সেন স্যারের একটি সাক্ষাৎকারের নিয়েছিলাম। অতঃপর মুঠোফোন কিংবা সশরীরে হাজির হয়ে টেলিভিশন ও পত্রিকায় অনেক সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছে স্যারের। গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা ছাড়াও সামাজিক সাংগঠনিক কর্মপথে স্যারের সাথে আমার কেটেছে অনেক মূল্যবান সময়। সঙ্গতকারণেই তাঁর সাথে আমার ছবির পরিমাণ হাতে গুণবার মত নয়।
আর্কাইভ ঘেঁটে পেলাম, প্রায় ১৫ বছর আগে আমি একুশে টেলিভিশনের বিভাগীয় দায়িত্বে থাকা অবস্থায় স্যারের বেশ কিছু ছবি। এরপরে NEWS24 টেলিভিশনে টকশোতে কিংবা এর অনেক আগে, প্রায় ১৮ বছর। আমি চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায়ও স্যারের বাসা কিংবা বিভিন্ন স্থানে প্রোগ্রামে আমাদের অনেকগুলো ছবি হাতে পেলাম।
বিজয়মেলা, একুশমেলা, বইমেলা, পিঠা উৎসব, বসন্ত উৎসব, জন্মাষ্টমী উৎসব, শারদীয় দুর্গাপূজা, ঈদ পুনর্মিলনী, জাতির পিতার জন্ম উৎসব, শেখ রাসেলের জন্মদিন, কয়েকটি টেলিভিশনে টকশো, বিভিন্ন সংগঠনের অভিষেক বর্ষপূর্তি কিংবা জাতীয় দিবসের প্রচুর ছবি আছে আমাদের। কিছুক্ষণ ধরে ছবিগুলো বারবার করে তাকিয়েছি স্যারের চেহারার পরিবর্তন নেই। একইভাবে ব্যক্তি মানুষটিও এই কটা বছর একদম বদলাননি। সেই শিশুর সারল্য, সেই দরদ, স্নেহ মমতা এখনো এই বয়সেও তিনি দিয়ে চলেছেন আমাদের।
আমাদের সমাজ বিবর্তন, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা, গণঅভ্যুত্থান, গণআন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধিতা, সামাজিক জীবনমান উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, অসাম্প্রদায়িক চেতনাসহ এমন কোনো বিষয় নেই যে স্যারের বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়নি।
সামাজিক সাংস্কৃতিক পেশাগত কিংবা জনমানুষের যেকোনো আয়োজনে অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক বরেণ্যজনদের মধ্যে চট্টগ্রামে ড. অনুপম সেন স্যারই সম্ভবত আমার দেখা সবচেয়ে সহজ অতিথি। যাঁর কোনো দম্ভ নেই। অহংকার নেই। শ্রেণীবিভাগ কিংবা জাতপাত বিচার নেই। আছে কেবল শিশুসুলভ সারল্য ও উদার আন্তরিকতা।
এরশাদ এর জমানায় সব ধরনের মর্যাদা, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। কারো কারো ভাষায় ‘মন্দ লোকেরা’ অবশ্য বলেন, ধর্মীয় বিভক্তি বা বৈষম্যের দৃষ্টিতেই তাঁকে সেই সময়গুলোতে বঞ্চিত করা হয়।
শেখ হাসিনার আমলে এই বরেণ্য শিক্ষাবিদকে ডেকে এনে সম্মান দেন মরহুম জননেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টগ্রামের এই সাবেক মেয়র প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে ড. অনুপম সেনের মত একজন বরেণ্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিকে উপাচার্যের পবিত্র চেয়ারে বসিয়ে স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দিতে চেয়েছিলেন।
ড. সেনের এ প্রাপ্তিতে নিজের অতিরিক্ত প্রাপ্য কিংবা লোভের কিছু ছিল না। অর্পিত দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন সর্বোচ্চ দরদে। দীর্ঘকাল পত্নী উমা সেন গুপ্তের দুরারোগ্য ব্যাধি এবং শেষ পর্যন্ত বিয়োগ বেদনায় চরম মানসিক যন্ত্রণা পেলেও মানুষের জন্য তাঁর অকাতর নিবেদনে কখনো ছেদ ঘটেনি। চট্টগ্রামবাসীর দেওয়া পবিত্র দায়িত্ব পালনে তিনি কোনো ব্যত্যয় ঘটাননি।
শুনতে পেলাম হালের বিপ্লবীরা (কারো কারো ভাষায়, ‘শুক্কুরবাইজ্জ্যা বিপ্লবী’) ডক্টর অনুপম সেন স্যারকেও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে সরিয়ে দিতে মরিয়া হয়েছেন। এই গোষ্ঠিটি এর মধ্য দিয়ে কার্যত সাধারণ সচেতন শিক্ষার্থীদেরকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন। অভিভাবকদের যেন চপেটাঘাত করলেন।
আপনাদের উদ্দেশ্যে শুধু এটুকু বলতে পারি, যেই বাংলাদেশের উপর দাঁড়িয়ে আপনারা আজ দম্ভ করছেন, সেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের একজন সাহসী সেনানী ড. অনুপম সেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৬ জন বরেণ্য নাগরিক নিয়ে গঠিত মুক্তিযুদ্ধেরপক্ষের নাগরিক সমাজের কমিটির তিনি অন্যতম প্রতিনিধি।
অবশ্য যারা বাংলাদেশের মানচিত্র কিংবা পতাকা পরিবর্তন করতে চান; তাদের কাছে এই মুক্তিযুদ্ধের আঁতুড়ঘরের কথা বড় বেশি বেমানান। ৩০ লক্ষ শহীদের বিয়োগ বেদনাটা'ই তাদের কাছে হয়তো অনেক ঠুনকো! তাদের আবার ডক্টর সেন পাঠ করতে হবে কেন!
আমি অবশ্য তাদেরকে বহুল আলোচিত-সমালোচিত সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদির ভাষায় দুই হাত জোর করে বলতে পারি, ‘আঁই তোঁয়ারারে ডরাই; অ-বদ্দা, আঁই তোঁয়ারারে ডরাই’!
লেখক : রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, সাবেক সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য, চট্টগ্রাম মেডিকেল ইউনিভার্সিটি।