Cvoice24.com

কর্মেই অমর সিরাজুল ইসলাম

লিখেছেন : মো. মুজিবুর রহমান ফারুকী

প্রকাশিত: ১৮:২৬, ১২ অক্টোবর ২০২৪
কর্মেই অমর সিরাজুল ইসলাম

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও মুজিবুর রহমান ফারুকী (বাম থেকে)

দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করা ব্যক্তিরা মৃত্যুর পরও অমর থাকেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁদেরই একজন। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশের উন্নয়ন, মানুষের কল্যাণ-সমৃদ্ধি ও মানবসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন। তিনি আজ এ পৃথিবীতে নেই। কিন্তু তাঁর কর্মনিষ্ঠা, বদান্যতা, মানবতা, ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র তাঁকে অমর করে রাখবে। কোন ক্ষুৎপীড়িত প্রজন্ম তাঁর কীর্তিগাথাকে ধ্বংস করতে পারবে না।

শিক্ষানুরাগী, দানবীর, শিল্পপতি, বিদ্যোৎসাহী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ১৯১৯ সালের ৩ মার্চ চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার আহলা শেখ চৌধুরী পাড়ার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এলাকায় তিনি লালু কন্ট্রাক্টর নামে সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর বাবা হাজী করিম বক্স ও মা গুলশান আরা বেগম পরহেজগার আদর্শ দম্পতি ছিলেন। পাড়া প্রতিবেশির বিপদ-আপদে সকলের আগে এগিয়ে আসার পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে শৈশব থেকে এ ধরনের পরিবেশে বড় হন। বড় হয়ে তাই পাড়া-প্রতিবেশিকে ভুলতে পারেননি তিনি। ৭ম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তাঁর মমতাময়ী মা মারা যাওয়ার পর চাচী বিলকিস খাতুনের মাতৃস্নেহে বড় হন। চাচীর উৎসাহে ও বাবার আগ্রহে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আহলা আছাদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত এবং স্থানীয় জুনিয়র হাই স্কুলে ৮ম শ্রেণির পাঠ শেষ করে তিনি শাকপুরা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি হন।

গ্রাম থেকে বিদ্যালয়টি খানিকটা দূর হওয়ায় তাঁকে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা চালাতে হয়। তাই তিনি কাছের করণখাইন গ্রামে লজিং থেকে পড়াশোনা করে ১৯৩৯ সালে ইংরেজী মাধ্যম সিলেবাসে প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলেজ ভর্তির প্রথম ভাগে ওই বছরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর বাবার বৃহৎ সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। বাবা অসহায়ের মতো ম্যাট্রিক পাশ ছেলের মুখের পানে তাকিয়ে থাকেন। চলনে-বলনে, চিন্তা-চেতনায় ব্যতিক্রমী ইসলাম সাহেব বুঝতে পারেন সংসারকে রক্ষা করতে হবে। তাই তিনি সংসার সমরাঙ্গনে নেমে পড়েন। 

বিট্রিশরা যুদ্ধের জন্য সৈন্য সংগ্রহ শুরু করলে তিনি কালবিলম্ব না করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করে ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত লেফটেনেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। যুদ্ধ শেষ হলে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে তৎকালীন আসাম-বেঙ্গল রেলওয়েতে যোগ দেন। সেখানে যে বেতন দেয়া হতো তাতে সংসার চালানো কষ্ট হয়ে পড়ে। দেশ বিভক্তির পর চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরিতে যোগদান করেন তিনি। তাঁর সাথে জেটির বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের পরিচয় ছিল। যখন পরিবারের উন্নতির কথা ভাবছিলেন ঠিক তখনি ঠিকাদাীর কাজে অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব আসে তাঁর কাছে। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন চৌধুরী ওই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন। 

‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি’ তিনি যখন বুঝতে পারলেন ঠিকাদারি কাজে তাঁর আর্থিক অবস্থা উন্নতি হচ্ছে। তখন তিনি বন্দরের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯৫২ সালে নিজ ঠিকাদারি ব্যবসায় নেমে পড়েন। আর ঠিকাদারি ব্যবসা থেকেই কর্মপ্রিয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর উন্নতি হয়।

এদেশ উপনিবেশ শাসন মুক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পায়ন, নগরায়ন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ফলে নির্মাণকাজ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় তাঁর নিজস্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনেক নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পান। তাঁর নিজস্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নির্মিত একটি গৌরবময় নির্মাণকর্ম এশিয়ার অন্যতম দর্শনীয় রেলওয়ে স্টেশন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। যা আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের বিভিন্ন জেটি নির্মাণ কাজও তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গড়া। ‘Practice makes a man perfect’ —এ বাক্যটি তাঁর বেলায় প্রযোজ্য। একের পর এক নির্মাণ কাজ করতে করতে তিনি প্রকৌশল জ্ঞানে এমন অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন যে পাশ করা সিভিল ইঞ্জিনিয়াররাও তাঁর কাজে বিস্মিত হতেন। কর্তব্যনিষ্ঠ ইসলাম সাহেব সামাজিক দায়বদ্ধতায় বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের পাশাপাশি মিল কারখানা গড়ে তোলেন। ঠিকাদারি ব্যবসার মাধ্যমে প্রচুর অর্থাগম হলে তিনি শিল্পোদ্যোগে এগিয়ে আসেন এবং তাঁর স্ত্রীর নামানুসারে ১৯৬৭ সালে সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ড নামক স্থানে ‘আনোয়ারা জুট মিলস’ স্থাপন করেন। এখানে নিজ গ্রাম ও এলাকার বহু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এতে তাঁর দেশপ্রেমী ও জনহিতব্রতি মনোভাবের পরিচয় ফুটে ওঠে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি প্রকৃত কর্মবীরের ন্যায় বিধ্বস্ত চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নে জেটিতে পুননির্মাণ কাজের দায়িত্ব পান। বাংলাদেশ নৌবাহিনী জেটি, বি এন এ ঈশাখাঁ এগার তলা বিল্ডিং, চিটাগাং ফুড সাইলো ইত্যাদি তাঁর নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়। ১৯৭৮ সালের ২ ডিসেম্বর তাঁর বড় ছেলে আখতারুল ইসলাম চৌধুরী মারা যাওয়ায় শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন তিনি। তাঁর ইচ্ছা ছিল বড় ছেলে লেখাপড়া শেষ করে তাঁর ব্যবসার কাজে সহযোগিতা করবে, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। ছেলের বিয়োগ শোক কাটিয়ে উঠতে তাঁর অনেকদিন সময় লাগে।

১৯৮৩ সালের দিকে তিনি শিপিং, শিপ ব্রেকিং শিল্পে পূজি বিনিয়োগ করেন। জাহাজভাঙা শিল্প থেকে প্রাপ্ত কাঁচামাল বাজারজাত করার জন্য চাক্তাই এলাকায় কর্ণফুলী রোলিং মিলস স্থাপন করেন এবং পরে তিনি চট্টগ্রামে দ্বিতীয় স্টীল মিলের স্বত্তাধীকারী হন। যা বর্তমানে ইসলাম স্টীল মিলস নামে পরিচিত।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি শ্রম ও বুদ্ধি দিয়ে অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছিলেন। তাই তিনি অর্থের সদ্ব্যবহার জানতেন। মানুষের কল্যাণে এই অর্থের বড় একটা অংশ তিনি ব্যয় করেছেন অকাতরে। শিক্ষাব্রতী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এলাকার চিকিৎসা সেবায়, শিক্ষা প্রসারে ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বোয়ালখালী উপজেলা সদরে নিজ নামে বোয়ালখালী সিরাজুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠা করে উচ্চ শিক্ষা প্রসারে এগিয়ে আসেন। এছাড়া, শাকপুরা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মিলনায়তন প্রতিষ্ঠা, পূর্ণ চন্দ্র সেন সারোয়াতলী উচ্চ বিদ্যালয়ের চুন-সুড়কি দিয়ে নির্মিত ছাদ থেকে পানি পড়া রোধে ছাদ মেরামত, বেঙ্গুরা সিনিয়র মাদ্রাসায় প্রতি বছর বার্ষিক সভায় মোটা অংকের অর্থ দান করতেন। তিনি কত প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা, গৃহনির্মাণে, কন্যাদায়ে, মেধাবী, গরীব শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় অকাতরে আর্থিক অনুদান দিয়েছেন তার কোন ইয়ত্তা নেই।

গ্রামীণ চিকিৎসা সেবাকে গ্রামবাসীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষে স্থানীয় দাশের দিঘীর পাড়ে নিজস্ব অর্থায়নে বাবা-মায়ের নামানুসারে ৩০ শয্যা বিশিষ্ট কেজিএম দাতব্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। যার কার্যক্রম আজ অবদি চলমান রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সূর্যের মত স্নেহ, নদীর মত বদান্যতা এবং মাটির মত অতিথিপরায়ণ; যা প্রকৃত ধার্মিকের গুণাবলী। প্রতিদিন কোরআন তেলাওয়াত করা ও ওয়াক্ত মতো নামাজ আদায় করা ছিল তাঁর রোজনামচার অঙ্গ।

জীবনে সাফল্যের উচ্চ শিখরে আরোহণ করেও সকলের প্রতি তাঁর ব্যবহার ছিল অমায়িক, কোনদিনই তাঁর ব্যবহারে বড়লোকের দম্ভ প্রকাশ পেত না। প্রতিবছর মুরব্বীদের জেয়াফত উপলক্ষে খানা-মেজবানের বড় আয়োজন করে নিজে উপস্থিত থেকে সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়াতেন। তিনি নিজের গ্রাম ও গ্রামবাসীকে কখনো ভুলতে পারেননি। যখনি গ্রামে আসতেন গ্রামবাসীকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন এবং সকলের খোঁজ-খবর নিতেন।

২০০১ সালের ১২ অক্টোবর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ নশ্বর পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন। তিনি আজ এ পৃথিবীতে নেই। আমি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতের আলা মাকাম দান করুন। মহান আল্লাহর কাছে আমার আরজ তাঁর সুযোগ্য তিন কন্যা, দুই ছেলে, নাতি-নাতনিরা ও যেন তাঁর গুণে গুণান্বিত হয়ে তাঁর স্মৃতিকে অম্লান করে রাখে।

লেখক : মো. মুজিবুর রহমান ফারুকী, সিনিয়র শিক্ষক, পূর্ণ চন্দ্র সেন সারোয়াতলী উচ্চ বিদ্যালয়, বোয়ালাখালী, চট্টগ্রাম।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়

: