চাকরিচ্যুত ব্যাংকারদের চাকরি ফিরিয়ে দিন
‘বাবা, তুমি নাকি বেতনের টাকা তুলতে পারছ না’
লিখেছেন : রশীদ এনাম
“বাবার পকেট, মায়ের রান্নাঘর
ভালোবাসামাখা এক চিলতে স্বপ্ন প্রহর।
বেঁচে থাকা স্বপ্নের অভিলাষী মন
পাওয়া- না পাওয়ার ব্যবধানে
হারিয়ে যায় জীবনের কবিতা-গান।
মাঝে মাঝে হাসি-খুশিতে নেমে আসে ঝর
সংসার জাহাজের পাইলট পিতা-মাতার চাপা অভিমানে
নয়নসিক্ত অশ্রু ভেসে যায় বুক-ফাটা ক্রন্দনে।
চলার বাঁকে দুঃখ কষ্টগুলো ভাগাভাগি করি
মনের আকাশে আনন্দগুলো আমরা শেয়ার করি।
বৃত্তের গণ্ডিতে বন্দী নিত্য চিত্ত
তবুও মানিয়ে সব আমরা মধ্যবিত্ত।”
মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন যুবকের স্বপ্ন থাকে পড়ালেখা শেষ করে ভালো একটা চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। বাবা-মা, পরিবার-পরিজনদের মুখে হাসি ফোটাবে। চাকরি শুধু আয়ের উৎসহ নয়; এটা সম্মান, প্রত্যাশা এবং সামাজিক মর্যাদা। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে চাকরি নামক সোনার হরিণটি একজন চাকরিজীবীকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়। কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়ার পর মানুষের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়। কেউ বাড়ি করে কেউ বা নতুন দাম্পত্য জীবনের সূচনা করে। শাদি-সংসার পরবর্তীতে বাচ্চা-কাচ্চা এ আরেক নতুন অধ্যায়ের যাত্রা। সবকিছুর সাথে কিন্তু চাকরি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে।
একজন মানুষ নাকি চাঁদের আলোতে স্বপ্ন খুঁজে নিতে পারে। তারাই নাকি আবার সবার আগে ভোরের সূর্য ওঠা দেখতে পায়। সূর্যের আলোর মধ্যে দিয়ে শুরু হয় দিবসের কর্ম ব্যস্ততা। অফিস নামক কারাগারে সহকর্মীদের সাথে ছুটির দিন ব্যতিত ৮/১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কর্মব্যস্ততার মধ্যে থাকতে হয়। মাস শেষে বেতনটা যখন পায় আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে মাসের সমস্ত ক্লান্তি যেন নিমিষে দূর হয়ে যায়।
চাকরির পারিশ্রমিকটা আমাদের অর্থনৈতিক সফলতা, স্বচ্ছল জীবন, পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ সবকিছুর মাঝে আনন্দ, হাসি-খুশি, সুখ দুঃখের মাঝে চলে জীবন নামক রেলগাড়িটা। চাকরি যেন একটা মানুষের জীবনকে উপভোগ করতেও সময় দেয় না। কত বিশেষ দিন না হারিয়ে যায় ব্যস্ততার মাঝে। অফিসে প্রবেশ করলে ইদানীং সারাক্ষণ অস্থিরতার মধ্যে থাকতে হয়। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ফলে বাংলায় কি বসন্ত নেমে এসেছে নাকি খড়া এসেছে— কি জানি!
সম্প্রতি চট্টগ্রামের এক ঝাঁক সম্ভাবনাময়ী মেধাবী তরুণ-তরুণীদেরকে বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাঁরা সবাই ব্যাংকার; সবাই বয়সে তরুণ। ওরা সবাই স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসিতে গত ৮ মাস আগে চাকরি পেয়েছিল। কত স্বপ্ন, প্রত্যাশা নিয়ে চাকরিতে যোগদান করেছে। চাকরিজীবী সন্তানদের নিয়ে বাবা-মায়ের কত আশা-আকাঙ্ক্ষা। চাকরিচ্যুতদের মধ্যে অনেকে বিয়ে-শাদি করে নতুন সংসার পেতেছেন। কারো বা শিশু সন্তানও রয়েছে। কেউ বা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ’ -এ নির্দেশনা আছে, সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত অভিযোগ ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা যাবে না। এছাড়া অদক্ষতা অজুহাত দেখিয়ে কর্মীদের পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত অথবা পদত্যাগে বাধ্য না করার নির্দেশনা আছে। একটা প্রাইভেট ব্যাংকে এ্যাসিস্টেন্ট অফিসার/ক্যাশ বা এন্ট্রি লেভেলে কর্মকর্তাদের বেতন স্কেল উল্লেখ করা আছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি কর্তৃপক্ষ কোন কারণ ছাড়া ইচ্ছেকৃতভাবে প্রতিহিংসাবশত ৬৭২ জন কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করেছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। একটা স্বাধীন দেশে নজিরবিহীন ঘটনা এবং সম্পূর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে এই ঘৃণিত কাজটি করা হয়েছে। এটা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের জন্য যেমন লজ্জাকর, ঠিক তেমন দেশের জন্য হুমকিস্বরূপও বটে।
আপনাদের চাকরি দেয়ার সুযোগ না থাকতে পারে কিন্তু অন্যায়ভাবে চাকরি থেকে ছাঁটাই করতে পারেন না। দেশে যে শ্রম-আইন আছে তাও আপনারা ভুলে গেছেন। চাকরিচ্যুত ব্যাংকাররা সম্প্রতি ৩ দফা দাবিতে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে শান্তিপূর্ণভাবে চাকরি ফিরিয়ে দেয়ার জন্য মানববন্ধনও করেছে। এদের মধ্যে অনেকে আছে পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। যার আয়ের টাকায় সংসার চলে, অসুস্থ পিতা-মাতার চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করতে হয়।
সম্প্রতি চাকরি হারানো এক ব্যাংকারের সাথে কথা বলেছিলাম। তিনি কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘তাঁর শিশু সন্তানটি জানে বাবা ব্যাংকে জব করে। পহেলা নভেম্বর মাসুম শিশুটি তার বাবাকে ফোনে বলেছে, বাবা! বাবা বাবা! ঢাকা থেকে আসার সময় চকলেট আনিও। বাবা কখন আসবে? খুব পরান পুড়ছে তোমার জন্য। বাবা ওপাশ থেকে কথা বলে না, বাকরুদ্ধ হয়ে, কান্নাজড়িত কণ্ঠে উত্তর দেয়, বাবা চকলেট আনব আর কটা দিন পর এখনও বেতন পায়নি।’
মিথ্যা শান্তনা দিতে হয় অবুঝ শিশুকে। আহা শিশু সন্তানটি জানে না তাঁর বাবার চাকরি নামক সোনার হরিণকে জোরপূর্বক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জবাই করে দিয়েছে। চাকরিচ্যুত ব্যাংকার ভাইটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মুখ লুকিয়ে অঝোরে কেঁদেছে। তিনি বললেন, ‘আমি কিভাবে আমার ছোট মাসুম শিশুর জন্য চকলেট কিনব? কতদিন মিথ্যার বাণী শুনাব পরিবারকে? আমরা কোন অপরাধ করিনি। দয়া করে আমাদের চাকরি ফিরিয়ে দিন।’
আহা সোনার হরিণ! কারো মাসুম বাচ্চা, কারো বা অসুস্থ পিতা-মাতার ওষুধ খরচ, কারো বা সদ্য বিবাহিত সংসার, কারও ভাই-বোন, সন্তানদের লেখাপড়া টিউশন ফি সবকিছু থমকে গেছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ওদের কথা একবারও ভাবল না। ব্যাংকারদের ছাঁটাই করার নিউজটি শুনার পর বাকরুদ্ধ ছিলাম। ওদের মাঝে নিজের চেহারাটি বার বার কল্পনা করেছি।
আমার ছোট মেয়েকে যখন ফোনে বলি মা মণি বাবা তোমার জন্য কি আনব? সে আমাকে ইদানিং বলে বাবা আমার জন্য কিছু আনতে হবে না। বাবা তোমার তো টাকা নেই। তুমি নাকি বেতনের টাকা তুলতে পারছো না। তোমাদের নাকি অনেকের চাকরি চলে গেছে। কে বলেছে মা এসব কথা? সে বলল, ‘বাবা ইশকুলের বন্ধুদের কাছে শুনেছি। চোখ ভিজে গেল আবেগ আপ্লুত হলাম।’
সম্প্রতি যে সকল ছোট ভাই-বোনদেরকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাদের শান্তনা দেয়ার ভাষা নেই। দু’হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুধু নীরবে নির্ভৃতে বলেছি, হে মওলা আপনার কাছে ফরিয়াদ করছি। আপনি রাহমানুর রহিম ওদের প্রতি রহম করুন। হে আল্লাহ মধ্যবিত্ত পরিবারের মাসুম শিশুর ক্রন্দন ধ্বনি কি আপনি শুনতে পান না। মওলা রিজিকের ফয়সালা হয় নাকি আসমানে। আপনি রহমতের চাঁদর দিয়ে ওদের রিজিকের ফয়সালা করে দিন।
ব্যাংক কর্তৃপক্ষের প্রতি সবিনয় নিবেদন, বিনা অপরাধে কারো রিযিকে দয়া করে হাত দিবেন না। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়ের সু-দৃষ্টি কামনা করছি।
# রশীদ এনাম, লেখক ও প্রাবন্ধিক।