Cvoice24.com

ডেঙ্গুতে আলাদা মা-মেয়ে

সিভয়েস২৪ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৩:৩৬, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
ডেঙ্গুতে আলাদা মা-মেয়ে

ফেনী সোনাগাজীর বাাসিন্দা শারমিন আক্তার। চারমাস বয়সী মেয়েকে ১০৭ কিলোমিটার দূরে খালার কোলে রেখে ডেঙ্গু জ্বরে কাতরাচ্ছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গত চারদিন ধরে চিকিৎসাধীন শারমিন।

সপ্তাহখানেক জ্বরে ভোগার পর শারমিনকে ফেনী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। অবস্থার অবনতি দেখে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গত শুক্রবার থেকে চমেকে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি। তারপর থেকে ৬ বছরের ছেলে আয়মানকে নিয়ে হাসপাতালের বাইরে রাত কাটাচ্ছেন শারমিনের স্বামী আর বাবা-মা। 

চমেকের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে কথা হয় শারমিনের স্বামী ওমর ফারুকের সঙ্গে। পেশায় গাড়ি চালক। তিনি সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘ডাক্তার বলছেন ফেনীতে চিকিৎসা সম্ভব না, যত দ্রুত সম্ভব চট্টগ্রাম নিয়ে যাইতে হবে। তার হার্টের সমস্যা দেখা দিছে, খালি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। অবস্থা খারাপ দেখে এইখানে নিয়ে আসছি। আমার দুইটা বাচ্চা। ছোটটা মেয়ে, ওর বয়স চার মাস। তার (শারমিন) তো ডেঙ্গু হইছে, এখন বাচ্চারও যদি ডেঙ্গু হয় এজন্য ওর খালার কাছে বাড়িতে রেখে আসছি।’ 

শিশুটির নাম জানতে চাইলে কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে যান শারমিনের স্বামী ওমর ফারুক। এরপর তিনি বলেন, ‘আসলে টেনশনে মেয়েটার নামটাই ভুলে গেছি। কি নাম রাখছি মনে নাই। হাসপাতালে তো খালি একজনকে রোগীর সঙ্গে থাকতে দেয়। তাই আমার শাশুড়ি থাকেন তার সঙ্গে আর আমরা ওয়ার্ডের বাইরে কোনোমতে রাত কাটাই।

এসময় কাছে এগিয়ে শারমিনের মা পেয়ারা আক্তার বলেন, ‘আমার মেয়েটার অবস্থা খুব একটা ভালো না। নাতি-নাতনি দুইটা। ওর হার্টে নাকি সমস্যা পাইছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। আর সারাদিন শুধু ঘামায়। মাইয়াটা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে গেলেই শান্তি। কিছু ভালা লাগছে না।’ 

সেবা নিয়ে অভিযোগ নেই রোগীদের

শুধু শারমিন আক্তারই নয়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন ৪৪ জন। এসময় ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা রোগীদের অন্তত ২৫ জন হাসপাতালের সেবা নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ নেই বলে জানিয়েছেন। 

ফারুক নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘এখানকার ডাক্তার নার্সরা অনেক আন্তরিক। যখন যে সমস্যার কথা বলতেছি উনারা সবোর্চ্চ চেষ্টা করছেন দেখতে। এর বাইরে রোগী বাড়লে একটু এদিক-সেদিক হয়। কিন্তু এটা কোনো বিষয় না।’ 

এসময় ডেঙ্গু ওয়ার্ডের ভেতরে কথা হয় কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারিহা তিলক নোভার সঙ্গে। নগরের শোলকবহর এলাকায় বাবা-মা আর ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন তিনি। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ২১ সেপ্টেম্বর সকালে ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গত তিনদিন ধরে চিকিৎসাধীন আছেন সেখানে।

ফারিহার বিছানায় বসে ছিলেন ফুফু রুনা বেগম। তিনি বলেন, ‘তিন সপ্তাহ আগে হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হলে ডাক্তারের পরামর্শে এন্টিবায়োটিক খাওয়ার পর সুস্থ হয়ে যায় ফারিহা। কিন্তু ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে আবারও জ্বর আসে, সঙ্গে বমি আর শ্বাসকষ্ট। জ্বর ১০৩ ডিগ্রির ওপরে। জ্বর কমছে না দেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানা যায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ফারিহা। বমি বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।’

হাসপাতালের সেবা নিয়ে অভিযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে রুনা বেগম বলেন, ‘না তেমন কোনো অভিযোগ নেই। ডাক্তার নার্স সবাই এসে এসে দেখে যায়। টেস্টও এখানে করানো হয়। স্যালাইনও দেয়া হয়। কিন্তু প্রচুর গরম। বাচ্চাটা ঘেমে ঘেমে আরও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। রোগীর চাপ কম-বেডও খালি তাই নার্সদেরকে কয়েকবার বলছি বেড চেঞ্জ করে দিতে কিন্তু তারা এখনো দেয় নাই। এটাকে আবার অভিযোগও বলা যাবে না। আমরাও বুঝতে পারছি রোগী দেখতে দেখতে তারা ক্লান্ত।’ 

এ সময় ফারিহার বড় ভাই চবি শিক্ষার্থী ইমন বলেন, ‘বাসার সবারই জ্বর। তবে আমরা সবাই এখনো ঠিক আছি। শুধু ওর অবস্থা খারাপ। বমি আর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে নিয়ে আসি। একটু রিকভারও করছিলো। ভাবছিলাম রিলিজ দিয়ে দিবে। গতরাত থেকে আবার জ্বর আসছে। এখানে প্রচুর গরম। ঘেমে ঘেমে আরও কাশি বেড়ে গেছে।’ 

কীভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে ইমন বলেন, ‘অনেকদিন ধরে স্কুলে যাওয়া হয় না তার। বাসাতেই ছিল। আমরা ধারণা করছি বাসাতেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। তাছাড়া আমরা যে এলাকায় থাকি সেখানের আশপাশ একেবারেই অপরিচ্ছন্ন। কখনো মশার ওষুধ ছিটাইছে কিনা তাও চোখে পড়ে নাই।’ 

হাসপাতালে রোগীর চাপ ‘কিছুটা কম’

ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকায় গত বছরের মতো এবারও মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্তরা চিকিৎসা নিচ্ছেন চমেক হাসপাতালসহ নগরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে। তবে প্রতিদিনই শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন যাদের শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিয়েছে। এরমধ্যে দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া রোগীর সংখ্যাই বেশি। যাদের অনেকেই এর আগেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর চাপ কিছুটা কম। কেননা ভর্তি রোগীর পাশাপাশি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার হারও বেশি। 

মিরসরাইয়ের বাসিন্দা পারভীন আক্তারের সঙ্গে। তার পাশেই শয্যাশয়ী মাদ্রসা পড়ুয়া ১৩ বছরের তামীম রায়হান। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর তামীমের প্লাটিলেট নেমে আসে পনেরো হাজারের ঘরে। অবস্থা বেগতিক দেখে মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট থেকে নিয়ে আসে চমেক হাসপাতালে। আগের রাতে হাসপাতালে ভর্তির পর দুইব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে তামীমকে। 

করুণ চোখে তামীমের মা পারভীন আক্তার বলেন, ‘ওর বাবা নাই। আমার দুইটা ছেলে। ও ছোটজন। একটু জ্বর থেকে যে এমন অবস্থা হয়ে যাবে সেটা বুঝে উঠতে পারি নাই। অনেক সমস্যা নাকি দেখা দিছে। আর এইসব আমি ঠিকঠাক বুঝিও না, জানিও না। ছেলেটার অবস্থা ভালো না। ছেলেটা তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে গেলে ভালো হইতো। ওর কষ্ট দেখতে ভালো লাগতেছে না।’ 

চিকিৎসাধীন রোগীর বিষয়ে জানতে চাইলে ডেঙ্গু ওয়ার্ডের কতর্ব্যরত নার্স জয়া চৌধুরী সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘গতরাতে ভর্তি ছিল ৪২ জন। আজকে আরও দুইজন ভর্তি হইছে। বর্তমানে মোট ৪৪ জন চিকিৎসাধীন আছেন। এরমধ্যে ৬ নম্বর আর ৩৩ নম্বর বেডের রোগীদের অবস্থা ক্রিটিকাল। একজন আইসিইউতে আছেন।’ 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডেঙ্গু ওয়ার্ডের এক চিকিৎসক বলেন, ‘যেসব রোগী মারা যাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুব খারাপ অবস্থায় হাসপাতালে আনা হচ্ছে। তখন দেখা যায় রোগীর লিভার, কিডনি, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। পরে রোগী শকে চলে যায় এবং মৃত্যু ঘটে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দিন খান সিভয়েস২৪-কে বলেন, 'ডেঙ্গুর মোট ৪টি ধরন আছে। দেখা যাচ্ছে এবার ডেঙ্গুতে দ্বিতীয়বার আক্রান্তের হার বেশি। আগের বছর কেউ একটি ধরনে আক্রান্ত হলে পরেরবার যদি ওই একই ধরনে আবার আক্রান্ত হন তাহলে তেমন ঝুঁকি থাকে না। কিন্তু পরেরবার অন্য কোনো ধরনে আক্রান্ত হলে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এবার সেটাই বেশি ঘটছে। তবে বিগত বছরগুলোর তুলনায় সংখ্যার বিচারে এখনো পর্যন্ত কম আক্রান্তের হার কিছুটা কম। আর মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে অনেক রোগীকে সংকটাপন্ন হয়ে ওঠার পর হাসপাতালে আনা হচ্ছে। যে কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার পেছনে এটাও একটি কারণ হতে পারে।'

একই প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘চট্টগ্রামে নতুন করে আরও ৪৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে চমেকসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ৪০ জন রোগী। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় ব্যবস্থা নিতে চসিককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’ 

উল্লেখ্য, চলতি বছরের শুরু থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ২৩২ জন আর মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। এরমধ্যে চলতি মাসের প্রথম ২৪ দিনে মোট ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে ৬২৪ জন। এ সময়ে আটজনের মৃত্যু হয়েছে।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়

: