চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
নার্স খুঁজতে খুঁজতে নাকাল
শারমিন রিমা, সিভয়েস২৪
সোমবার রাতে চালানো স্যালাইন শেষ হয়েছে, নতুন স্যালাইন লাগাতে ডেঙ্গু আক্রান্ত ওমর ফারুকের বাবা এদিক ওদিক ছুটছিলেন নার্সের খোঁজে। কয়েক দফা ছোটাছুটি করে হয়রান, কিন্তু ওয়ার্ডে কেউ নেই। পরে জানতে পারলেন নার্সদের কর্মবিরতি চলছে। সেই স্যালাইন লাগানো হয়েছে দুপুর আড়াইটার দিকে।
মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) নার্সদের কর্মবিরতি চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের চিত্র ছিল এমনই। এক দফা দাবিতে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত নার্স ও মিডওয়াইফদের কর্মবিরতি চলে।
হাসপাতালে চিকিৎসকদের পরামর্শ ও নির্দেশনা অনুযায়ী রোগীদের ইনজেকশন দেওয়া, ওষুধ খাওয়ানো, শরীরের তাপমাত্রা মাপা, ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করাসহ রোগী ব্যবস্থাপনার কাজগুলো নার্সরাই করেন। তাদের কর্মবিরতির ফলে সকাল থেকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে বেশিরভাগ ওয়ার্ডের ভর্তি রোগীদের। কোথাও কোথাও বিঘ্নিত হয়েছে চিকিৎসকদের রাউন্ডও।
সরেজমিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালে সকাল থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন নার্স ও মিডওয়াইফরা। দুই একটি ওয়ার্ডে দুয়েকজন নার্সকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেলেও বেশিরভাগ ওয়ার্ডে কেউই ছিলেন না। এ সময়ে বন্ধ ছিল রোগীদের সেবাদান কার্যক্রম।
চারদিন আগে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন ১৭ বছর বয়সী ওমর ফারুক। ম্যালারিয়া, ডেঙ্গু, টায়ফয়েডের পরীক্ষা শেষে গতকাল ওমর ফারুকের শনাক্ত হয় ডেঙ্গু। তারপর থেকে স্যালাইন চলছে তার। সকালে স্যালাইন শেষ হয়ে যাওয়ার পরে নতুন স্যালাইন লাগাতে নার্সদের খুঁজছিলেন তাঁর বাবা জসিম উদ্দিন।
জসিম উদ্দিন বলেন, ‘কতবার করে নার্সদের রুমে গেছি। পরে একজন নার্স ছিল উনি বলছে আজকে উনাদের কর্মবিরতি। সবাই আন্দোলনে গেছে। এজন্য এখন কাউকে পাওয়া যাবে না। কাল রাতে ডেঙ্গু ধরা পড়ছে এখন ছেলেটার নতুন স্যালাইন লাগানোর সময় হয়েছে। এছাড়া অন্য কোনো ওষুধ লাগবে কিনা বা আর কোনো টেস্ট লাগবে কিনা এইসব জানার দরকার ছিল। কিন্তু নার্সরা নাই। এখন আবার আছে। উনারা এখন রোগী দেখতে আসতেছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ছিল না।’
ডেঙ্গু ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আরেক রোগী চবি শিক্ষার্থী আলাউদ্দিন বলেন, ডেঙ্গু পজিটিভ হয়ে গতরাতে হাসপাতালে ভর্তি হই। সকাল থেকে সার্ভিস নেওয়ার জন্য অনেকবার নার্সদেরকে বলে আসি। কিন্তু নার্সরা না থাকায় সেটা পাইনি। পরে আমি নিজেই স্যালাইনের স্ট্যান্ড হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটে উনাদের রুমে গিয়ে বলে আসি, এখনো পর্যন্ত আসেননি।'
শিশু ওয়ার্ডের এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘বাচ্চাটা নাড়াচাড়া করে ক্যানুলা খুলে ফেলছে। এজন্য ডাকতে গিয়ে শুনি সবাই আন্দোলন করতে গেছে। রুমে একজন ছিল। ওনি বলল ১টা পরে আসতে। এজন্য অপেক্ষায় আছি উনারা কখন আসবেন।’
ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে কথা হয় সিনিয়র স্টাফ নার্স জয়নাবের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা মানবিক দিক বিবেচনায় মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য কর্মবিরতি পালন করছি। অথচ আমাদের যৌক্তিক দাবি মানছে না। আমাদের নার্সিংয়ে যোগ্য লোক থাকার পরেও সেখানে আমাদের পদায়ন করা হচ্ছে না।’
আরেক সিনিয়র স্টাফ নার্স জয়া শিকদার বলেন, ‘এখানে অনেক জরুরি রোগী আছেন। হঠাৎ কারো জরুরি প্রয়োজন হতে পারে। এজন্য আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডে দুজন করে ডিউটি করছি। অন্য সময় এখানে ৮-১০ জন থাকেন। কিন্তু আমাদের আন্দোলন যৌক্তিক তাও আমরা ঢিলেঢালা কর্মবিরতি পালন করছি। আমরাও চাইনা রোগীরা যাতে ভোগান্তিতে পড়ুক।’
এদিকে কর্মবিরতির সময়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, ডায়ালাইসিস, জরুরি অস্ত্রোপচার, আইসিইউ, পিআইসিইউ, এনআইসিইউ এ কর্মসূচির বাইরে রাখার কথা বলা হয়। যদিও সেখানে হাতেগোনা দুয়েকজন নার্স কর্মরত ছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স বলেন, ‘আমরা কর্মবিরতি পালন করছি। এ সময় যদি সার্ভিস দিই তাহলে তো আর হল না। আমাদের দাবির গুরুত্ব বোঝানো যাবে না। এজন্য তিনজন ছাড়া বাকিরা নাই, আমরাও খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলে সেবা দিচ্ছি না। রোগীদের সাময়িক ভোগান্তি হচ্ছে আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু দাবি আদায়ে আমাদের আর কোনো পথ নেই।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দিন খান বলেন, 'জরুরি বিভাগসহ কিছু জায়গা কর্মবিরতির বাইরে ছিল। তারপরও কেউ সেখানে না থাকলে আমরা খোঁজ নিয়েছি, নার্সদের পাঠিয়েছি। তবে কোনো ওয়ার্ড থেকে তেমন কোনো অভিযোগ পাইনি।'
উল্লেখ্য, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিচালক এবং কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ও রেজিস্ট্রার পদে যোগ্য ও অভিজ্ঞ নার্সদের পদায়নের দাবিতে গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে কর্মসূচি পালন করে আসছেন নার্সরা। ৩০ সেপ্টেম্বর এবং ১ অক্টোবর সারাদেশে ৩ ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করেন তারা। পরে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে ১ অক্টোবর সন্ধ্যায় কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। কিন্তু ৬ অক্টোবর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সাময়িকভাবে দুজন নার্সিং কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে পরিচালক পদে পূর্ণ দায়িত্ব না দিয়ে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্বে পদায়ন করে। এ কারণে ফের কর্মবিরতির ডাক দেওয়া হয়।