Cvoice24.com

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল
অর্ধেকের বেশি চর্মরোগী, চিকিৎসক মাত্র দুজন

শারমিন রিমা, সিভয়েস২৪

প্রকাশিত: ১৫:২৪, ২৪ নভেম্বর ২০২৪
অর্ধেকের বেশি চর্মরোগী, চিকিৎসক মাত্র দুজন

আড়াইশো শয্যার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল। টিকিট কাউন্টারের ঝুলানো —‘শিশু ও পুরুষ চর্ম ও যৌন ডাক্তার ছুটিতে আছেন।’ ‘রবিবার, সোমবার, মঙ্গলবার পুরুষ ও শিশু চর্ম ও যৌন রোগের ডাক্তার থাকবে না।’ মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) হাসপাতালের চিত্র ছিল এমনই। অথচ রোগীতে ‘গিজ গিজ’ করছিলো হাসপাতাল।

হাসপাতাল সূত্র বলছে, বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ থেকে ১২০০ রোগী আসেন। এরমধ্যে অর্ধেকের বেশি চর্মরোগে আক্রান্ত। তবে চর্মরোগ বিভাগে চিকিৎসক মাত্র দুজন। দুজনের কেউ প্রশিক্ষণ কিংবা ছুটিতে গেলে হাসপাতালের অবস্থা হয় ‘ভয়াবহ’। রোগীরা ফিরে যান বিনা চিকিৎসায়।

ঘড়ির কাঁটায় তখন ১টা ছুঁই ছুঁই। কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান ইউনিয়ন থেকে এলার্জির সমস্যা নিয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন ৩০ বছর বয়সী মোহাম্মদ মোস্তফা। কিন্তু টিকিট কাটতে গিয়েই তার মাথায় হাত! জানতে পারলেন ডাক্তার আজ ছুটিতে।

এরপরও বিষণ্ণভাবে কাউন্টারে থাকা টিকিট সহকারীকে অনুনয় করে শ্রমজীবী মোস্তফা বলছিলেন, ‘দেখেন না যদি কোনোভাবে ম্যানেজ করা যায়? এর আগেও একবার এসে পাইনি। আবার আসতে হবে?’

টিকিট সহকারী যখন জানালেন আগামীকাল দুপুর ১২টার আগে আসতে। তখনই ডাক্তার দেখানোর আকুতির কথা জানান মোস্তফা। না সূচক জবাব পেয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে ডাক্তার পাবেন কিনা তাও সহকারীর কাছে জানতে চান তিনি। 

মোস্তফা সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। আগে জানতাম না। যদি জানা থাকতো তাহলে কাল আসতাম। এখন মেডিকেলে গিয়েও (চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে) গিয়েও আর ডাক্তার পাবো কি না জানি না।’

এদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত হাসপাতালে এসেও ডাক্তার দেখাতে না পেরেচর্ম রোগের সমস্যা নিয়ে আসা অন্তত ১১০ জন রোগী ফেরত গেছেন বলে জানা গেছে।

চার বিভাগে সপ্তাহের ৬ দিন অস্ত্রোপচার বর্হিবিভাগের সেবা বন্ধ!

সপ্তাহে ২ দিন করে অস্ত্রোপচার চলে সার্জারি , নাক কান ও গলা (ইএনটি) ও অর্থোপেডিক্স ও গাইনি বিভাগে। সপ্তাহের এ ৬ দিন বর্হিবিভাগ খোলা থাকলেও থাকে না কোন চিকিৎসক। ফলে এ চার বিভাগের রোগীদেরও ফেরত যেতে হয় অস্ত্রোপচারের দিনে। এসব বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ থেকে ৬০০ রোগী আসেন চিকিৎসা সেবা নিতে। 

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারে ব্যস্ত থাকেন। রবিবার ও বুধবার নাক, কান ও গলা (ইএনটি) ও অর্থোপেডিক্স বিভাগের চিকিৎসকরা অপারেশনে ব্যস্ত থাকেন। একইভাবে সোমবার ও বৃহস্পতিবার অপারেশনে ব্যস্ত থাকেন গাইনি বিভাগের চিকিৎসকরা। যে কারণে এসব দিনে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকরা বর্হিবিভাগের রোগী দেখেন না।

ক্ষোভ ঝাঁড়েন টিকিট কাউন্টারে

দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার পর টিকিট নিতে এসে ‘আজ ডাক্তার নেই, কাল আসেন’ শুনে কাউন্টারে থাকা সহকারীর সঙ্গে বাক-বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন কেউ কেউ। 

জানতে চাইলে আক্ষেপ জানিয়ে টিকিট সহকারী জয়নাল আবেদিন সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘ডেইলি কম করে হলে প্রায় হাজার বারোশ রোগী আসে। আমাদের এখানে সাপ্তাহিক একটা রুলস আছে। যেমন শনি মঙ্গলবার হলো সাজার্রির ওটি, রবি ও বুধবার ইএনটি ওটি আর সোম ও বৃহস্পতিবার গাইনি ডিপার্টমেন্টের ওটি। এইদিনে ডাক্তাররা ওটিতে ব্যস্ত থাকায় আউটডোরে রোগী দেখেন না। যে কারণে ওই সময়ে অনেকে ফেরত যায়। তখন রোগীরা আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। আমার কি দোষ! ডাক্তার না থাকলে তো কোনোভাবে আমার দেখানোর সুযোগ নেই। অনেকে এই বিষয়টা বুঝতে চান না।’

তিনি আরও বলেন, ‘একটা মানুষ কতক্ষন লোড নিতে পারেন? দেখা যায় রোগী আসে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ কিন্তু আমাদের ডাক্তার হচ্ছেন একজন বা দুইজন। যখন তাদের কেউ একজন ছুটিতে থাকেন তখন তো আরও চাপ পড়ে যায়। সেসময় অনেকে ফেরত যান। তখন তো আসলেই আমাদের কিছু করার থাকেনা।’ 

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুল মন্নান সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রতিদিন আউটডোরে ১২’শ থেকে ১৩’শ রোগী আসছে। এরমধ্যে স্কিনের সমস্যা নিয়ে ৩০০ রোগী আসছে অথচ আমার দুজন ডাক্তার। একজনের ভাগে দেড়শ বা দুইশো রোগী পড়ছে। অনেক সময় আরও বেশিও হয়। এখন রোগীদের সবাই চাচ্ছে আমি আগে দেখাবো। আবার কোনো কোনো সময় দেখা যায় সমস্যা বিবেচনায় কোনো রোগীকে একটু বেশি সময় দিলে অথবা কারও ক্ষেত্রে কম সময় হলে বাকি রোগীরা ক্ষেপে যায়। তাহলে এখন কোন দিকে যাবো?’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের স্ক্রিনের দুইজন চিকিৎসক আছেন। এরমধ্যে একজন মেডিকেল অফিসার অন্যজন সংযুক্তিতে আছেন। এরমধ্যে যদি কোনো একজন ছুটিতে থাকেন তাহলে অন্যজনের উপর চাপ পড়ে যায়। এছাড়া গত সপ্তাহে একজনকে পদায়ন করা হয়েছে। তিনি এখনো যোগদান করেননি। তিনি যোগদান করলে কিছুটা চাপ কমবে এবং রোগীরাও তাদের কাঙ্খিত সেবা পাবেন।’

উল্লেখ্য, ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নিমাই চরণ দাতব্য চিকিৎসালয় থেকেই চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু। তার ছয় দশক পরে নগরের আন্দরকিল্লার রঙমহল পাহাড়ের উপরে স্থাপিত হয় বর্তমান চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল। ১২২ বছরের বেশি সময় ধরে টিম টিম করে কোনমতে টিকে আছে এ হাসপাতাল। শতাব্দী পুরনো এ হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা কেবলই আড়াইশো। ২৫ শয্যা দিয়ে শুরু করে গত এক শতাব্দীতে হাসপাতালের শয্যা বেড়েছে কেবল ৩ বার। শয্যসংখ্যা বাড়লেও বিপরীতে বাড়েনি পর্যাপ্ত লোকবল। প্রায় এক যুগ আগে সংখ্যার লোকবল দিয়ে চলছে প্রাচীন এ হাসপাতালটি। চিকিৎসকের ঘাটতি ছাড়াও হাসপাতালে পর্যাপ্ত সংখ্যক নার্স ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী নেই। যদিও আগের হিসেবে হাসপাতালটিতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর অভাব নেই। কিন্তু আড়াইশো শয্যার জন্য এ জনবল কাঠামো মোটেও পর্যাপ্ত নয় বলে জানাচ্ছেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। শুধু চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীই প্রয়োজন ৫০ জনের বেশি। তবে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বর্তমানে ৩৬ জন কাজ করছে হাসপাতালটিতে।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়

: