রামগড় পাতাছড়া হত্যা
৩৮ বছরেও বসতভিটায় ফিরতে পারেনি দুই শতাধিক পরিবার
করিম শাহ, রামগড়
১৩ জুলাই রামগড় পাতাছড়া হত্যার ৩৮ বছর পূর্তি আজ। ১৯৮৬ সালের এই দিনে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড়ে পাহাড়ের তৎকালীন সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল শান্তিবাহিনীর হাতে পাতাছড়ার ডাকবাংলা এলাকার ৫ শিশুসহ ৭ নিরীহ বাঙালি নির্মম হত্যার শিকার হন।
হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন আবুল খায়েরের স্ত্রী হালিমা বেগম (৫৫), তার মেয়ে মনোয়ারা বেগম(৬), ছেলে আবুল কাশেম(৫), আনোয়ারা বেগম(১), ছায়েদুল হকের স্ত্রী ছবুরী খাতুন ও মেয়ে রেহানা রেহানা আক্তার এবং লাল মিয়ার মেয়ে মফিজা খাতুন। পরদিন ১৪ জুলাই মো. সাত্তার নামে একজনকে গলা কেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। একই বছরের ১৩ আগস্ট বাড়ির পাশের টিলায় গরু চড়াতে গেলে স্বজনদের সামনে থেকে মো. আদম ছফি উল্লাহ নামে একজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুম করা হয়। পরবর্তীতে তার মরদেহ না পাওয়া গেলেও সন্ত্রাসীরা তাকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেয় বলে জানায় ভারত ফেরত উপজাতি শরণার্থীরা।
সেদিনের বিভীষিকাময় স্মৃতি এখনও ভুলতে পারেননি ডাকবাংলা পাড়ার বাসিন্দারা। প্রথমদিনের ঘটনায় নিহতরা গণকবরে ঠাঁই পেলেও পরবর্তীদের কপালে তাও জুটেনি। নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর পরপর এমন হামলায় ভয়ে পালিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল ২ শতাধিক পরিবার। কয়েক বছর পর তারা নিজেদের বাস্তুভিটায় ফেরার চেষ্টা করলেও তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রশাসন ফিরতে দেয়নি। ফেরা হয়নি গেল ৩৮ বছরেও।
কয়েক বছর আগে শান্তিবাহিনীর হাতে সেদিন নির্মমভাবে নিহতদের স্বজন ও এলাকাবাসী ডাক বাংলা এলাকায় গণকবরটি সংস্কার করে তাতে নিহতদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরে টানানো হয় একটি সাইনবোর্ড। যাতে সরকারিভাবে গণকবরটির স্বীকৃতিসহ নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, দোষীদের বিচার ও নিজভূমিতে ফেরার ব্যবস্থা করতে সরকারের কাছে দাবি জানায় ভুক্তভোগীদের পরিবার।
মো. নাসির উদ্দিন নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ঘটনার দিন মাগরিবের কিছু সময় আগে হঠাৎ করে একদল অস্ত্রধারী শান্তিবাহিনীর সদস্য বাড়িতে ঢুকে পড়ে। কিছু বুঝে উঠার আগে এলোপাঁতাড়ি গুলি ছুঁড়ে। এ সময় গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় কেউ কাউকে উদ্ধারে এগিয়ে আসতে পারেনি। সন্ত্রাসীরা গুলি করতে করতে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। আমার (নাসির) ছোট ভাই আবুল কাশেমকে আগুনে নিক্ষেপ করে। এ সময় আমাকে নিয়ে মা পালানোর চেষ্টা করে। মায়ের কোলে একবছর বয়সী ছোট বোন আনোয়ারা থাকলেও ভুলে আরেক বোন মনোয়ারাকে বাড়ির ভেতর রেখে আসেন। মনোয়ারাকে আনতে মা বাড়ির ভেতর গেলে সন্ত্রাসীরা মাকে গুলি করে এবং ছোট বোন আনোয়ারাকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে আগুনে নিক্ষেপ করে। আর মনোয়ারার মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে খুন করে। পরদিন আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সহ গিয়ে মরদেহগুলো উদ্ধার করে রাস্তার পাশে গণকবরে দাফন করা হয়।
ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী নজরুল ইসলাম জানান, ১৩ জুলাই সকালে পাতাছড়ার ডাকবাংলা গ্রামে বাইরে থেকে কিছু অপরিচিত লোকজন আসে। স্থানীয় এক পাহাড়ির বাড়িতে তারা কাজে এসেছেন বলে জানান। আছরের পরপর যখন হামলা শুরু হয় তখন তাদেরকেও সন্ত্রাসীদের সাথে দেখা যায়। বাড়িতে ঢুকে মা ছবুরী খাতুনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই ও বোন রেহানা আক্তারকে আগুনে নিক্ষেপে হত্যার কথা ভুলতে পারিনি এখনও।
পাতাছড়ার বাসিন্দা ও তৎকালীন আনসার সদস্য মো. মমতাজ মিয়া জানান, ৩৮ বছর অতিবাহিত হলেও নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত গণহত্যার কোন নথিতে উল্লেখ নেই। স্বজন হারানোর কষ্ট বুকে চেপে জীবন রক্ষায় সেদিন কোন মতে একটি কবরে স্বজনদের রেখে চলে যেতে হয়েছিল নিরীহ গ্রামবাসীদের।
এদিকে ১৯৮৬ সালের ১৩ জুলাই গণহত্যার শিকার পাতাছড়ার ডাকবাংলা এলাকার নিহত ৭ বাঙালির স্মরণে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও তাদের রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া-মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার (১৩ জুলাই) সকালে এ আয়োজন করে নিহতদের পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসী।
পাতাছড়া জামে মসজিদের খতিব মাওলানা মো. আবু হানিফের নেতৃত্বে দোয়া মোনাজাতে অংশ নেন গণহত্যায় নিহত আদম ছফি উল্লাহর ছেলে মো. ইয়াছিন ও আবু ইউসুফ, ছবুরী খাতুনের ছেলে নজরুল ইসলাম, হালিমা বেগমের ছেলে মো. নাছিরসহ সমাজ কমিটির সভাপতি মো. মন্তাজ মিয়া, মো. ইব্রাহিম খলির, মো. সেলিম মিয়া, আল-আমিন, শিমুল, সাইফুল ইসলামসহ স্বজন ও স্থানীয় যুবকরা। কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ।
এসময় গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী, নিহতদের স্বজন ও স্থানীয়রা সরকারের কাছে নিহতদের গণকবর সংরক্ষণের পাশাপাশি শান্তি চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ে পার্বত্য জেলায় সংঘটিত বিভিন্ন গণহত্যার নথিপত্রে রামগড়ের পাতাছড়া গণহত্যার ঘটনাও লিপিবদ্ধ করার দাবি জানান। এছাড়া বাস্তুভিটাহীন পরিবারগুলোকে নিজ ভূমিতে ফেরত পাঠানো ও প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থারও দাবি তাদের।