Cvoice24.com

কবিতার হালচাল 

শুভ্রজিৎ বড়ুয়া

প্রকাশিত: ২১:২০, ২২ জানুয়ারি ২০২১
কবিতার হালচাল 

এটা স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই যে, জীবনের জন্য জীবিকা প্রয়োজন। জীবিকা না থাকলে পাকস্থলীকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। আর এই পাকস্থলী বড্ড বে-রসিক। এর পরেও অনেককে দেখি নিজের থুথু গিলে পানির তৃষ্ণা মেটাতে। আমি প্রচণ্ড অপমানিত হই, যখন দেখি কবিরা নিজের দাম হাঁকিয়ে ল্যাম্পোস্টের নিচে দাঁড়ানো সোডিয়ামের আলোতে উপচে পড়া সৌন্দর্য নিয়ে পার করে দিচ্ছে জীবনের কিছু ব্যর্থ বসন্ত।

আমি লজ্জাবোধ করি, তার মানে এই না যে লজ্জাবোধ আপনার থাকতে হবে। আমাদের সবার বোধ এক হবে, এমন বোকা ভাবনা আমার নেই। যাক, এবার কবিতা নিয়েই অন্য একটা প্রসঙ্গে যাই। আজকাল কবিতা হচ্ছে না, অনেকেই বলে থাকেন। কেন হচ্ছে না! কেন আমরা পাশ্চাত্য সাহিত্যের সাথে পাল্লা দিতে বরাবরই হোঁচট খাচ্ছি? এর প্রথম কারণ আমাদের, কবিদের ভেতরে চাটুকারিতা, লোভ, পার্থিব মোহ, সংঘবদ্ধ হবার চিন্তন বাসা বেঁধেছে।

একজন কবির সঙ্গে অন্য কবিরর বন্ধুত্ব থাকতেই পারে, জমজমাট সকাল-দুপুর-রাতের আড্ডা হতেই পারে। কিন্তু আড্ডা দিতে গিয়ে চিন্তার নিজস্বতা হারালে আর যাই হোক কবির মৌলিকতা থাকে না। অনেক বড় বড় দার্শনিকদের ভাষ্যানুযায়ী- কবিরা শয়তান, কেননা কবিরা মিথ্যে বলে, আবার কবিরা ঈশ্বর- কেননা কবিরা সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে আমার এক কবিবন্ধু আলীমের একটি কাব্যাংশ ব্যবহার করছি,

‘একনায়করাই শ্রেষ্ঠ। ঈশ্বর একক ও একা, সংঘবদ্ধরা শয়তান।’

একটু ভেবে দেখলে নিশ্চিত হবেন যে, আশি বা নব্বই দশকের পর কবিতায় একটা ভাটা পড়ে গেছে। তার তিনটি কারণ উল্লেখ করার মতো। প্রথমত কবিরা এখন সঙ্গবদ্ধ, দ্বিতীয়ত বেচা-কেনার হাটে উঠে যায়, তৃতীয়ত তাদের অনেকেই চাটুকার। কবিদের ভেতর তাদের লেখনীর দম্ভ নেই, সুতারাং প্রাচুর্য নেই। মনে হয় যেন, এই বুঝি তার শেষ লেখা। সকালের ঘুম ভাঙার পর সে লিখতে লিখতে সিদ্ধান্ত নেয় মরে যাবার, কিন্তু মরে না। স্নান সেরে ভাবে মরার আগে একটু ঘুমায়। ঘুম ভেঙে লিখে কবিতা। তারপর সন্ধ্যা নামলে ভাবে- একটু মাতাল হই। এরপর লিখে বা না লিখেই ঘুম। জীবনের প্রতি আসক্তি কিন্তু একটা নির্মম হতাশা তাদের ঘিরে রেখেছে। তাই তারা জানে তাদের শেষের গল্পটা প্রারম্ভের নামান্তর। অন্যদিকে ভাবনাগুলোও গোছালো।

এ কারণেই আশির দশকের কবিতা আজো যে হারে পাঠপ্রিয়তায় আছে, তা নব্বই বা তার পরের সময়ে নেই বললেই চলে। এরমধ্যে আরো একটা ব্যাপার আছে, সেটা হলো অপেক্ষা। কবিরা রীতিমতো অপেক্ষা করাটাই ভুলে গেছেন। প্রেম বা প্রণয় যেন এক ধরনের নেশা। সবকিছুতেই একটা হেয়ালিপনা। বলতে আপত্তি নেই যে, অনেকে কবিতা সম্পর্কেও খুব একটা না জেনে লিখেন। এতে আপত্তি থাকলেও অশ্রদ্ধা নেই। কেননা তারা তাদের প্রকাশ শব্দে করছে বা করার চেষ্টা করছে; অস্ত্র তুলে নিচ্ছে না।

সবকিছু ছাপিয়ে বর্তমান সময়ে যারা লেখালেখি করছে আমি তাদের ওপর আস্থা রাখি। নিজের সময়কাল বলে নয়, তারা অনেকেই নিজস্ব ধ্যান-কৌশলে সাধনা চালিয়ে নিচ্ছেন। তাদের লেখাতে ত্রিকালের নানান বিষয় প্রতিপাদ্য। অথচ মূল্যায়ন কম। এ নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। কেননা সব সময়ের কবিদের এ ধরনের প্রতিকূলতা ছাপিয়ে লিখতে হয়েছে, হয়তো আগামীতেও হবে। আমাকে যদি বলতে বলা হয় কবিতা কী? কবিকে কেমন হতে হবে? আমি বলবো, নিজের বিশালতম ইচ্ছার সংক্ষিপ্ততম প্রকাশ হলো কবিতা। কবি বিনয়ী হতে পারে কিন্তু কবিতা কখনোই নয়।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়