Cvoice24.com

কাগজকলের বদ্ধ রুমে বন্দি চট্টগ্রামের ‘জ্ঞানভাণ্ডার’

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৩:৩২, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১
কাগজকলের বদ্ধ রুমে বন্দি চট্টগ্রামের ‘জ্ঞানভাণ্ডার’

চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন ‘মুসলিম হল সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স’

‘আমি লাইব্রেরিকে স্কুল-কলেজের উপরে স্থান দিই এ কারণে যে, এ স্থলে লোকে স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দচিত্তে স্বশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়। প্রতিটি লোক তার স্বীয় শক্তি ও রুচি অনুসারে নিজের মনকে নিজের চেষ্টায় আত্মার রাজ্যে জ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।’

জাতীয় জীবনে পাঠাগারের গুরুত্বের কথা অনুধাবন করে কথাটি বলেছিলেন প্রমথ চৌধুরী।  

পাবলিক লাইব্রেরি বা গণগ্রন্থাগারকে বলা হয় জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়, যেখান থেকে জ্ঞান আহরণ করতে পারেন সমাজের সব স্তরের লোক। কিন্তু প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রাম নগরীর ঐতিহ্যবাহী গণগ্রন্থাগারটি। নতুন করে ভবন নির্মাণের জন্য সরকারি এই জ্ঞানভাণ্ডারে থাকা ১ লাখ ২১ হাজার বই সরিয়ে রাখা হয়েছে একটি পেপার মিলের ভবনে। দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে অযত্ন  অবহেলায়। বিকল্প গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা না রাখায় বঞ্চিত হচ্ছেন পাঠক। আর এতে ক্ষুব্ধ নানা পেশাজীবী ও বইপ্রেমিরা।    

তথ্য মতে, চট্টগ্রামের কিছু সাংস্কৃতিক ব্যক্তি ও সমাজসেবীর উদ্যোগে ১৯২৫ সালে নগরীর প্রাণকেন্দ্রে গড়ে উঠে ‘মুসলিম ইনস্টিটিউট’। ১৯৬৩ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটিতে স্বল্পপরিসরে শুরু হয় গ্রন্থাগারের কার্যক্রম। পুরোপুরিভাবে যাত্রা করে ১৯৮৯ সালে। সেই থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রামের জ্ঞানপিপাসু শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বিভিন্ন পেশাজীবীদের জ্ঞান আহরণের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান এটি। তবে ১৯৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভবনের বিভিন্ন জায়গায় ফাটল সৃষ্টি হয়। বৃষ্টির পানি চুইয়ে নষ্ট হয় অনেক মূল্যবান বই। 

বর্তমানে নতুন ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। তাই স্থগিত রয়েছে গণগ্রন্থাগারটি প্রায় সব কার্যক্রম। বিগত তিন বছর ধরে অনলাইনে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন ছাড়া কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো কাজই চোখে পড়েনি। 

চট্টগ্রাম বিভাগীয় সরকারি গ্রন্থাগারের একটি সূত্র জানায়, নগরের নন্দনকাননের পুরানো গণগ্রন্থাগারটি ভেঙে ফেলা কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের জুন থেকে। প্রস্তাবিত ১৫ তলা এই ভবনের চতুর্থ তলার কাজ চলছে বর্তমানে। বিকল্প উপায়ে গ্রন্থাগার চালু রাখা সম্ভব না হওয়ায় বইগুলো সদরঘাটে কর্ণফুলী কাগজ মিলের ভাড়া করা রুমে রাখা হয়েছে। সেলফে সেলফে সংরক্ষণ করলেও সেখানে পাঠকদের পড়ার কোনো জায়গা নেই। 

এ বিষয়ে গণগ্রন্থাগারের সহকারী পরিচালক মো. আব্বাছ আলী সিভয়েসকে বলেন, ’গ্রন্থাগার চালু রাখার জন্য বিকল্প কোনো জায়গা পাওয়া যায়নি। এমনকি জেলা প্রশাসন, বিভাগীয় প্রশাসন ও গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের মাধ্যমে টেন্ডার করেও লাভ হয়নি।’

জানা যায়, ২০১৭ সালের নভেম্বরে ‘মুসলিম হল সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স’ নামে প্রকল্পটি একনেকে পাস হয়। বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় চট্টগ্রাম গণপূর্ত অধিদপ্তরকে। ২৩২ কোটি ৫২ লাখ টাকার এ প্রকল্পে প্রথমপর্যায়ের ১৬৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা চুক্তিমূল্যে কাজ করছে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এনডিই)। ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্নের কথা থাকলেও চার ভাগের এক ভাগও হয়নি।   

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রস্তাবিত মুসলিম হল সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স ভবনের চতুর্থ তলার কাজ চলছে কেবল। এখনো বাকি ১১ তলা। এছাড়া সড়কের বিপরীতে শহীদ মিনারের উন্মুক্ত মঞ্চের কাজও শেষ হয়নি।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনডিইয়ের নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা সিভয়েসকে বলেন, ‘গণপূর্ত বিভাগ থেকে আমাদের কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় ২০১৮ সালের ১ আগস্ট। আর মূল কাজ শুরুর আগে পুরাতন ভবনগুলো ভাঙতে হয়েছে। এ কারণে সময়টা বেশি লাগছে। তাছাড়া ওয়াসার চলমান কাজের জন্য রাস্তার কাজটিও বন্ধ ছিল কয়েক মাস। চলমান করোনা পরিস্থিতিও সামগ্রিক প্রকল্পে ধীরগতির আরেকটি অন্যতম কারণ।' 

তিনি বলেন, ‘কাজটি দ্রুত শেষ করার জন্য দিনে-রাতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে ২৫০ থেকে ৩০০ শ্রমিক কাজ করছে। গতবছরের জুলাইয়ে নতুন ভবনের নিচতলার বেজ ঢালাই শেষ হয়েছিল। বর্তমানে চারতলার কাজ চলছে।’ 

চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ সিভয়েসকে বলেন, ‘প্রকল্পের টেন্ডার হয়ে যাওয়ার পরও পাবলিক লাইব্রেরির বই ও আসবাব স্থানান্তর করতে বিলম্ব হয়। কারণ সুবিধা মতো বিকল্প জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে সদরঘাটের কর্ণফুলী কাগজে কলের একটি রুমে সেগুলো রাখা হয়। এসব করতেই একবছরের বেশি সময় চলে যায়। এছাড়াও করোনায় তিনমাস এবং ওয়াসার রাস্তায় পাইপ বসানোর কারণে বেশকিছু সময় নষ্ট হয়েছে।'

তিনি বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তবে এখন যেভাবে ও যে গতিতে কাজ চলছে আশা করছি আগামী বছরের শেষে সম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন হতে পারে।'  

চূড়ান্ত নকশা অনুযায়ী, চট্টগ্রামের বিভাগীয় সরকারি গণগ্রন্থাগারের জন্য ১৫ হাজার ২১২ দশমিক ২৮ বর্গফুট জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। কমপ্লেক্স ভবনের নিচতলায় থাকবে সার্ভিস সেকশন; যেখানে বই বাছাই, ফিউমিগেশন হবে। গ্রাউন্ড ও প্রথম ফ্লোরে থাকবে অফিস, দ্বিতীয় ফ্লোরে সেমিনার ও মিটিংরুম, প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ থাকবে তৃতীয় ফ্লোর। চতুর্থ ও পঞ্চম ফ্লোরে জেনারেল লাইব্রেরি, ষষ্ঠ ফ্লোরে চিলড্রেন লাইব্রেরি, সপ্তম ফ্লোরে পেপার লাইব্রেরি, অষ্টম ফ্লোরে রেফারেন্স লাইব্রেরি, নবম ও দশম ফ্লোরে সায়েন্স লাইব্রেরি, এগারোতম ফ্লোরে ট্রেনিং ইউনিট, বারোতম ফ্লোরে আইসিটি ইউনিট, তেরতম ফ্লোরে স্পেস ফর ফিউচার প্রোভিশন, চৌদ্দতম ফ্লোরে নির্মাণ করা হবে গেস্ট হাউজ।

গ্রন্থাগার অংশে সাধারণ পাঠাগারে ২৫০, বিজ্ঞান পাঠাগারে ১৫০, রেফারেন্স পাঠাগারে ১০০, পত্রিকা বা সাময়িকী পাঠাগারে ১০০, প্রতিবন্ধী পাঠাগারে ৫০, উন্মুক্ত পাঠাগারে ১৫০, শিশু-কিশোর পাঠাগারে ১০০ পাঠক একসঙ্গে বসে বই পড়তে পারবে। 

এছাড়া ৪০ থেকে ৫০ আসন বিশিষ্ট সভাকক্ষ ও সেমিনার কক্ষ, ১৫০ আসন বিশিষ্ট একটি বড় সেমিনার কক্ষ নির্মাণের কথা বলা হয়েছে নকশায়। আইসিটি লাইব্রেরিতে ৩০টি কম্পিউটার থাকবে। এখানে একটি রেস্ট হাউজ, দুটি ভিআইপি কক্ষ ছাড়াও থাকবে সাধারণ ডরমেটরি কক্ষ।     

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এম এম রিজাউল ইসলাম সিভয়েসকে বলেন, ‘মুসলিম হলের পাশের এই গণগ্রন্থাগারটি বহু পুরোনো। এখানে সাহিত্য, ইতিহাসসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই ও পুঁথি রয়েছে। তবে নির্মাণকাজের কারণে পাঠকেরা সেই বইগুলো থেকে জ্ঞান আহরণে কয়েক বছর ধরে বঞ্চিত। কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল বিকল্প উপায়ে পাঠকদের বইপড়ার সুযোগ করে দেওয়া।’ 

জ্ঞানের ভাণ্ডারটি একরকম হুমকির মধ্যে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই গ্রন্থাগারের পুরাতন বইগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে না পারলে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’

সার্বিক বিষয়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় সরকারি গ্রন্থাগারের প্রিন্সিপাল লাইব্রেরিয়ান কাম উপপরিচালক এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান সিভয়েসকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে গ্রন্থাগারের সংকট, এটা সত্যি। কিন্তু পাঠকদের জন্য বিকল্পভাবে সরকারি এই পাঠাগারটি চালু রাখার জন্য চারতলা বিশিষ্ট ভবন দরকার। আমি দায়িত্বে আসার আগে এটা নিয়ে অনেক চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু নগরে এরকম সুবিধামত ভবন ভাড়া পাওয়া যায়নি। বই স্থানান্তরেও বেশ বেগ পেতে হয়েছিল এ কারণে।’

প্রকল্পের অগ্রগতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নির্মাণাধীন কমপ্লেক্সটি চট্টগ্রামবাসীর জন্য হবে একটি মূল্যবান সম্পদ। নগরবাসীর সুবিধার্থে আগামী একশ বছরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে এতে। নতুন গ্রন্থাগার ভবনটিও হচ্ছে অত্যাধুনিক ও সুসজ্জিত। ২০২২ সালের শেষ দিকে এটির কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করছি।’

-সিভয়েস/এইচবি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়