সুফিয়া শীলা’র গুচ্ছ কবিতা
সুফিয়া শীলা । ছবি : সিভয়েস
মহার্জন
ভিসুভিয়াসের আঙ্গুল নিচে মানুষ স্রোতের আসন
হুঙ্কারে তাই বাংলা স্বাধীন বলে তর্জনী-ভাষণ,
কেউ নেই আজ চার দেয়ালের আয়তক্ষেত্রে বন্দি,
পথ নেই আর, পালাবে কোথায়- আর হবেই না সন্ধি।
বাংলা যখন ভরা পূর্ণিমা, লাল জোছনার জোয়ারে
ঘাতক তখন কাফন কাপড়ে অমাবস্যার দুয়ারে,
অগ্নিদাহের মৃত্যু প্রহরী হানছে আঘাত অলখে
শিকড়ের মাটি শীতল হবেই শপথ নিয়েছে আলোকে।
মুক্ত এখন ধূপছায়া মাঠ, মুক্ত হলুদ সকাল
মুক্ত আমার হাতুড়ি-শাবল, মুক্ত কাস্তে কোদাল,
বহতা মেঘনা অতন্দ্র সুখ, পদ্মা ক্ষিপ্ত প্রেমিক
বাংলা এখন অগ্নি-উগারি, সৈনিক এক অভীক।
সোনালি ধানের সামিয়ানা আজ লাল-সবুজের মাটিতে
লাউয়ের ডগা লৌহ কঠিন উন্নত শির ঘাঁটিতে,
অলয় কবির কবিতার আলো উদ্ভাসে আজ প্রভাসে
পরাধীনতার শিকল ভেঙেই মানুষ-মুক্তি প্রকাশে।
পোস্টমর্টেম
মানুষ-আত্মার বহুমাত্রিক পোস্টমর্টেম চাই আমি।
পৃথিবীর সব ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্র দিয়ে হোক
আমার আত্মার ব্যবচ্ছেদ,
তাতে আমার কিছুই যায় আসে না এখন;
ব্যবচ্ছেদকৃত আত্মার অংশগুলোকে মাইক্রোস্কোপের নিচে
আবাদ করতে পারো অনায়াসে।
কোনো বাধা নেই আমার!
অনাদিকাল থেকে অপমৃত্যুর যে প্রবহমান ধারা
পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে,
আমি তার প্রকৃত সত্য জানতে চাই।
আমি মানুষ-আত্মার বহুমাত্রিক পোস্টমর্টেম চাই।
আমার আত্মা আজ আবদ্ধ, অসাড়, কোণঠাসা।
নিঃশ্বাস নিতে বড় কষ্ট,
হাঁটতে পারি না, বলতে পারি না;
এমন কি দৃশ্যমানও হতে পারি না!
জানতে চাই—
আমি কী ভণ্ড, নাকি ভদ্র?
আলো-অন্ধকারে আমি কি অভিন্ন?
কথা-কাজে আমি কি এক?
আমি কী অন্যের ভুলকে রাজপথে পোস্টার বানাতে চাই;
নাকি
নিজের ভুলকে মাথার বালিশের খোলসে লুকাই।
আসলে কী আমি?
মাঝে মাঝে যখন কোনো আয়না এসে সামনে দাঁড়ায়—
মনে হয় আমি এক মহান মানুষ!
আর সবাই কী তাই ভাবে,
নাকি অন্য কিছু?
আমার আত্মার ভেতরে বাস করে যে চড়ুই-মন,
সে কি দ্বিচারী মন নয়?
প্রতিনিয়ত সে কী খুঁজে বেড়ায়,
কী পেতে চায়;
কাকে পেতে চায়?
জানতে চাই সবই তার।
মাঝে মাঝে অসাড় আত্মাটাকে বৃক্ষ মনে হয়।
মাথা উঁচু করার ব্যর্থ চেষ্টায়—
ভেতরের শিকড়কে গভীর থেকে গভীরতর
মাটিতে প্রোথিত করেছি,
যেনো কেউ উপড়ে ফেলতে না পারে।
তারপরও—
কেউ আমার ডাল ভাঙে,
কেউ আমার ছাল তোলে;
আবার ছায়া খোঁজে কেউ কেউ,
বাতাসের দোলে খুঁজে ফেরে হারানো জীবন
কেউ কেউ জ্বলন্ত আগুনের শেষ অংশটুকু
চেপে ধরে দেহের মাঝে,
ক্ষত-বিক্ষত আমি অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করি।
কখনও নিজের আত্মাকে নষ্ট নদী মনে হয়,
স্রোতহীন, বদ্ধ, দূষিত এক অন্ধকার জলাধার!
চেপে রাখো আমার আত্মার আজন্ম অস্তিত্বকে,
নোংরা আবর্জনার চেতনায় যাকে ভরাট করছো প্রতিদিন।
মাঝে মাঝে খুঁড়ে আনো আমার তলদেশের
পলিমাটি-সোনা;
নিঃস্ব করছো যাকে প্রতিনিয়ত, প্রতিক্ষণ।
নিজের বদ্ধ আত্মাকে পাহাড়ের মতো অসহায় মনে হয়।
আমার দেহের ভাঁজে ভাঁজে অনায়াসে চালাও
শাবল-কোদালের আঘাত,
ইচ্ছেমতো ক্ষত-বিক্ষত করো আমার অবয়ব;
প্রতিরোধ করার কোনো ক্ষমতাই আজ আর নেই আমার,
সভ্য-সভ্যতার লেবাসধারী এই আমি
মিশে গেছি পৃথিবীর পথ-পথান্তরে লক্ষ শতাব্দী আগেই।
আমি জানতে চাই—
পৃথিবীর কোন হাসপাতালে আত্মার পোস্টমর্টেম হয়?
আমার ভেতরের—
অত্যাচার, অনাচার, ক্ষত-বিক্ষত রক্ত-স্রোতের সময়,
পঁচা-গলা দুর্গন্ধ ছড়ানো সভ্যতার আসল স্বরূপ
আমি জানতে চাই।
আমি মানুষ-আত্মার বহুমাত্রিক পোস্টমর্টেম চাই।
দ্রোহ
হৃদয়ের বাস্তুভিটার মাটি পদ্মার জঙ্গমতায়
অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে বিনা নোটিশেই,
ধূপছায়া মন শত চেষ্টায় ঠেকাতে পারছে না
সর্বগ্রাসী বিপ্লবে আজ দিশাহারা পায়ের জমিন।
আমার হৃদয় যেনো— আজ তার আপন ক্রীড়াক্ষেত্র,
দুচোখের প্রেম বর্শার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত, আহত
শোণিতের বর্ণচ্ছটায় লাল অন্তরীক্ষ শোকে মাতম করছে,
ব্ল্যাকহোলের ঘূর্ণায়নে গিলে নিচ্ছে অস্তিত্বের শেষ বিন্দু
পিছু হটা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই আর।
এতোদিনের কাঙ্ক্ষিত সাজানো রঙধনু বাগান,
ঝকঝকে বারান্দায় ইজিচেয়ারের এলোমেলো উদাসী দোল
ধোঁয়া ওঠা কফির পেয়ালায় নীল চামচের টুংটাং শব্দ,
বসার ঘরের প্রিয় ঝাড়বাতির নক্ষত্র-আলো,
ইরানি কার্পেটের খানদানি কারুকাজের নকশা
দোল খাওয়া অর্কিডের টব,
দেয়ালে টাঙানো প্রিয়জনের আনন্দ-মুখচ্ছবি
ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে দিনের উজ্জ্বল আলোতেই।
নিতলে তলিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে সব।
সর্বোচ্চ মহলে আবেদন করেও নিষ্ফল হলাম
বিক্ষুব্ধ হরতালের উত্তাপ বিফলে গেলো,
চলমান আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ নিভে গেলো
তীব্র স্রোতের ভয়ঙ্কর তোড়ে।
শহরের অলিগলি আর রাজপথ পোস্টারে ছেয়ে দিলাম
লৌহমনের শক্তি নিয়ে
কাঠফাটা রোদে মানব বন্ধনে দাঁড়ালাম
বুকের বাঁ পাশে কালো ব্যাজ ধারণ করে
শান্তির আঁচলে সারা আকাশ ঢেকে দিলাম।
কিছুতেই টলানো গেলো না তাকে
প্রচণ্ড ক্ষোভ আর মৃত্যুবান নিয়ে মুহুর্মুহু আঘাত হানছে
হৃৎপিণ্ডের রক্তান্ত দেয়ালে।
সাজানো সবুজ-সোনালি জনপদ
এখন তার প্রিয় যুদ্ধক্ষেত্র
প্রার্থনা পূঁজা আরতি— সবকিছুকে দুমড়ে মুচড়ে
এখন সে উত্তাল অপ্রতিরোধ্য,
এক বিদ্রোহী সেনাপতির ধারালো খোলা তরবারি
এখন সে এ্যাকিলিস কিংবা স্পার্টাকাস!
যেনো কালোত্তীর্ণ সব্যসাচী এক অজেয় যোদ্ধা।
আর আমি,
সেন্ট হেলেনায় নির্বাসিত—
পরাজিত এক সময়ের দাস!
লেখক : সুফিয়া শীলা, পার্সিভ্যাল হিল প্রফেসরস কোয়ার্টার, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম।