সুফিয়া শীলার গুচ্ছ কবিতা
সুফিয়া শীলা
সুফিয়া শীলা
অক্সিজেন
‘কোমা’র শয্যায় ভালোবাসার বসবাস
বহুদিন আগেই
কোনো এক ভোরে তাকে রেখে এসেছিলাম—
কিছুই আজ আর নেই মনে।
বিন্যস্ত বিরহে তাকে ছেড়ে যেতে হয়েছিলো
শাদা বিছানায়!
এলোমেলো যন্ত্রপাতি আর অক্সিজেন
সিলিন্ডারের মাঝেই,
কোনো কথা নেই আজ তার
নেই কোনো নড়াচড়া,
চোখ মেলে দেখে না সে—
ভালোবাসায় এক নজর।
মাঝে মাঝে শুধু চোখ বেয়ে নেমে আসে নোনা ঝরনা
বেয়ে বেয়ে মিশে যায় শাদা বালিশের গহ্বরে;
কখনও কখনও হৃৎপিণ্ডের গতি তার অজান্তে
একটু একটু হাঁটতে চায়,
পারে না সে—
ফিরে যায় শাদা বিছানায়।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে
লাইফ সাপোর্ট খুলে দেই বিদীর্ণ ভালোবাসার
শেষ হয়ে যাক এক অধ্যায়ের খেলা
কিছুতেই পারি না তা;
‘মায়া’— বড় কঠিন বাঁধন!
চাইলেই খুলে দিতে পারি না জন্মান্তরের
সেই অক্সিজেন-মাস্ক।
অপরিচিতা
আজ আর আমি তোমার প্রেমিকা নই
নই কোনো প্রিয়জন কেউ,
অপরিচিত ধূপছায়া রোদ হয়ে আছি আমি আজ!
যাকে ফেলে গেছো ধূসর ভোরের পথে
মুছে দিয়ে চলে গেছো বহমান সুখ;
গতিশীল জীবনের সিঁড়ি বেয়ে চলে গেছো দূরে
সর্বগ্রাসী আকুলতায় অধীর জীবনের পথে।
জাফরান কষ্টের গুঞ্জরণ আজ সোনালি উঠোনে
আবছা আলো আজ আর—
রঙিন ফোয়ারা হয়ে মাতাল সুখ-জলে ভাসে না;
যোগ-বিয়োগের খেলায় আহত আমার সময়,
আজ আর কেউ নই আমি!
সোনালি জরির বেনারসিভাঁজ চুপ আছে আজো
বকুলের মালা শুকিয়ে বিবর্ণ প্রজাপতি-মমি;
মাঝে মাঝে দেখি আর—
দীর্ঘশ্বাসের কষ্ট-আকাশ সাজাই তোমার জন্য।
আজ আর কেউ নই আমি
তোমার কোথাও নেই;
তোমার মহাবিশ্বের আকাশেই আজ—
অস্তিত্বহীন নক্ষত্র আমি!
অচর
বিবর্ণ সময়ের স্রোতে বিলীন হলে না তুমি
এখনও আমার হৃদয়-বৃত্তের পরিধি হয়েই আছো;
আজীবন কেন্দ্রেই রইলাম বসে আমি।
অনেক যুদ্ধ হলো
রক্তপাতের নদী বয়ে গেলো,
ঝড় ঝঞ্ঝা টর্নেডো আইলা সিডর
কিছুই রইলো না বাকি,
অবশেষে শান্তিচুক্তির খসড়া প্রস্তাবও বাতিল;
কিছুই হলো না সফল।
দিনশেষে তোমার সামনে আবার দাঁড়াই
তোমার হৃদয়ের বৃত্ত-পরিধির মাঝে
আবদ্ধ মানুষ আমি একজন;
সময়ের স্রোতে সকল চেষ্টা হয়ে যায় বিফল।
মাঝে মাঝে মনে হয়
আমি য্যানো যুদ্ধবন্দি— কোনো ভালোবাসার দাস;
উড়তে ইচ্ছে করলে তোমার আকাশেই উড়ি
ভিজতে ইচ্ছে করলে তোমার নদীতেই নামি
কাঁদতে ইচ্ছে করলে তোমার শ্রাবণেই ভাসি
দেখতে ইচ্ছে করলে তোমার চোখেই দেখি।
অদৃশ্য এ টান ভীষণ কষ্টদায়ক কখনও কখনও,
যতবারই উঠে দাঁড়াতে চাই;
যতবারই বৃত্তের পরিধি ভাঙতে চাই
ততবারই সামনে এসে দাঁড়াও তুমি,
হয়ে যাও—
একনায়কতান্ত্রিক শাসকের মতো একগুঁয়ে পাগল।
অদৃশ্য শিকল খুলতে গেলে—
গেঁথে যায় হৃৎপিণ্ডের আরো গভীরে
মুক্ত বাতাস খুঁজে খুঁজে—
আমার নিঃশ্বাস খুঁজে পায় তোমার শরীরের ঘ্রাণ,
বৃত্ত-পরিধি উপড়ে ফেলতে গেলে—
রক্তাক্ত হয় নিজের দু’হাত,
হৃদয়ের অদৃশ্য টানের এই যুদ্ধ হয়ে গেছে—
আজ অনাদিকালের স্রোত।
তাই দিনশেষে আবার
আমি তোমার মাঝেই বিলীন হয়ে যাই,
বন্দি ভোরে নতুন করে--
ভালোবাসার পরাধীনতায় জাগবো বলে আবার।
লেখক : সুফিয়া শীলা, বি-৩, পার্সিভ্যাল হিল প্রফেসরস কোয়ার্টার, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম।