সুফিয়া শীলার ‘সুখ যন্ত্রণা’
সুফিয়া শীলা
অনন্তান্বেষণ
প্রজাপতি মন বাস করে
মেহগনি কাঠের আলমারিতে,
অনন্তকাল ধরে চুপ করে বসে আছে
মেহেদি রঙের বুনোহাঁস প্রেম;
অভিসারে ব্যর্থ অন্তরাত্মায়
ঘুমপাড়ানি গান শিশির হয়ে ঝরে পড়ে
বিষন্ন শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে।
নির্বাক নিস্তেজ সময় ফণীমনসার ঝাড় হয়ে
আহত করে সোনালি হৃৎপিণ্ড,
অন্তহীন করাঘাতে জন্মান্ধ আজ
আলমারির নীলাভ তালা;
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতায় হারিয়ে
উদগ্রীব রুপালি চাবিটা।
লাল বেনারসির ভাঁজে ভাঁজে হয়ে আছে
সবুজ শ্যাওলার চাষাবাদ,
গহনার উদাস চাহনি ঘুরপাক খায়
চারকোণা সিন্দুকের ত্রিপদী বিছানায়;
চকচকে অলঙ্কারের দেহে জমে আছে
অভিমান আর অনাদিকালের তিমির বিচ্ছেদ,
জামদানির সোনালি কারুকার্যে বাসা বেঁধেছে
একদল নিদ্রাহীন ছত্রাক;
কুঁড়ে কুঁড়ে নিঃশব্দে নিঃশেষ করছে
জন্মান্তরের রেশমি সুতোর বাঁধন।
মাঝে মাঝে আলমারির শরীরে
ঝিঁ ঝিঁ পোকা সুর তোলে আপন মনে,
ভালোবাসার বকুলমালা
শুকিয়ে মমি হয়ে গেছে কবেই;
তার দেহে এখন ছারপোকার সংসার,
একবার খুলে দাও—
মেহগনির ছায়াঘন কালো ডালা,
আমার প্রজাপতি মন—
নিরন্তর হয়ে ছুটে যাক মহাজাগতিক
ভালোবাসা-নক্ষত্রের খোঁজে।
সুখ যন্ত্রণা
হৃদয়ের কুঁড়েঘরে বাসা বাঁধে
পুবালি হাওয়ার কামনা চাদর,
হাওয়ার আঘাতে ঘরের চালায়
গোখরা সাপের মনি নক্ষত্র হয়ে জ্বলে।
পূর্ণিমা রাতে অভিমান করে
একঝাঁক জোনাকির দল,
কুঁড়েঘরের সবুজ দরজায় জন্ম নেয়
হলুদ রঙের সুখ-দহনের নির্বাণ আলো;
সে আলোয় হৃদয়ের পাটাতনে আঁকা পদচিহ্ন
একসময় নীলপদ্ম হয়ে দীঘির কালোজলে নাচে।
গোপন কর্ষণে মনের উর্বর জমিন তখন
দিগন্ত জুড়ে সোনালি ফসলের মাঠ,
প্রোজ্জ্বল সুখে দিশাহারা কৃষক;
চোখ বুঁজে থাকে গভীর উষ্ণতায়
ভালোবাসার ময়ূরকণ্ঠী বুকে।
জীবনের উচ্ছ্বাস হয়ে ঋদ্ধ কোকিল
ফিরে আসে হৃদয়ের কুঁড়েঘরে,
শৃংগার উল্লাসে কেঁপে উঠে উঠানের মাটি;
রঙধনু হাতের নিশীথ ভালোবাসা
সোনালি কাঁকনের শরীর বেয়ে নেমে যায়
অনাদিকালের স্রোতে।
উত্থান
প্রচণ্ড হাওয়ায় নক্ষত্ররা ঝরে পড়ে
টুপটাপ শিশিরের শব্দে,
ভেজা পাতার ফাঁকে উঁকি দেয় ঘোলাটে চাঁদ;
মধ্যরাতে দখিনা হাওয়া অহংকারী পুরুষের মতো
হেঁটে যায় সদর্পে,
নিমিষেই শুকিয়ে যায় হৃৎপিণ্ডের ভেজা মাটি।
অট্টহাসিতে উত্তাল হয় অনাদিকালের প্রেমিক,
যদিও আজ তার চোখ মৃত আগ্নেয়গিরির পেয়ালা;
জমে জমে জন্মান্তর—জল
সৃষ্টি করছে ধূসর এক হ্রদের,
হ্রদের চারপাশের জল নীলাভ আজ ফেলে
যাওয়া জীবন-দহনে।
নীলাভ সেই জল হ্রদের ধার বেয়ে নেমে আসে
জীবনের সবুজ গালিচায়,
হ্রদের জলে জন্ম নেয় অমূল্য সব রত্ন;
হৃদয়ের তলদেশ থেকে বেড়িয়ে তারা
ভালোবাসার ঘাসফুল হয়ে ফোটে হৃদয়প্রান্তর জুড়ে,
ঘাসফুলগুলো একসময়—
নীল শাড়ি পড়া রমণী হয়ে যায়;
হাত বাড়িয়ে দেয় অনাদিকালের প্রেমিকের দিকে।
লেখক : সুফিয়া শীলা, পার্সিভ্যাল হিল প্রফেসরস'কোয়ার্টার; চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম।